১৩ অক্টোবর ২০১৭, শুক্রবার, ৩:৩৯

বিআইবিএমের কর্মশালায় বক্তাদের উদ্বেগ

রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থা

ব্যাংকিং খাতে ঋণ অনিয়ম, জালিয়াতি, আর দুর্র্নীতি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এ দুরবস্থার জন্য রাজনৈতিক প্রভাব আর হস্তক্ষেপই দায়ী। এর নেতিবাচক প্রভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেড়ে চলেছে। যা বর্তমানে ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তবে এ হিসাবেও ফাঁকি আছে। সরকারি ব্যাংকে অবলোপনসহ প্রকৃত খেলাপি ৫০ শতাংশেরও বেশি, যা উদ্বেগজনক। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) অডিটোরিয়ামে এক গবেষণা কর্মশালায় ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, গবেষকরা এসব কথা বলেন। তাদের মতে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিমুক্ত রাখতে পারলে সমস্যার ৮০ শতাংশই সমাধান করা সম্ভব।

কর্মশালার মূল বিষয় ছিল ‘দেশের ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণ’ (এক্সপ্লোরিং মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিশন ইন দ্য কনটেক্স অব দ্য ব্যাংকিং সেক্টর অব বাংলাদেশ)। প্রধান অতিথি হিসেবে কর্মশালার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী। বক্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, গত ৫ বছরে আমরা অনেক পেছনে চলে গেছি। যার অন্যতম কারণ ব্যাংকিং খাতে অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। আর এর ফলেই ব্যাংকগুলো এখন মুদি দোকানে পরিণত হয়েছে। প্রস্তাবিত ব্যাংক কোম্পানি আইন পাস হলে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আরও খারাপের দিকে চলে যাবে বলেও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এতে মালিকদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও অন্যায় প্রভাব বাড়বে। ব্যাংকাররা পেশাগত দায়িত্ব পালনে আরও বেশি সমস্যার সম্মুখীন হবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, দেশের এত উন্নয়ন হচ্ছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু খেলাপি ঋণ কমছে না; বরং বাড়তে বাড়তে তা ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। যা উদ্বেগজনক। নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইনে এক পরিবার থেকে ৪ জন পরিচালক থাকার সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে বর্তমানে একই পরিবার থেকে ২ জন পরিচালক থাকার আইন রয়েছে। তবে ব্যাংক কোম্পানি আইনে নতুনভাবে একই পরিবার থেকে ৪ জন পরিচালক রেখে সংশোধিত আইন পাস হতে যাচ্ছে। এতে ভালো ব্যাংকও খারাপ হয়ে যাবে। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বেশি। কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না। নতুন এ ব্যাংক কোম্পানি আইনের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এ আইন পাস হতে দেয়া যাবে না। বাধা দিতে হবে। সবাইকে আরও সমালোচনা করতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে বিতর্কিত এ আইন নিয়ে আমরা লেখালেখি করব, সেমিনার করব।

কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত (মার্জার) করা সম্পর্কে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বিদেশে ব্যাপক হারে ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বড় হওয়ার জন্য এটা করে থাকে। তবে আমাদের দেশে ছোট ব্যাংকগুলোর ধারণা এমন, বড়দের সঙ্গে একীভূত হলে বড়রা তাদের খেয়ে ফেলবে। এর ফলে ভালো কিছু নাও হতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে। দুটো খারাপ প্রতিষ্ঠান মিলে নতুন একটি বড় খারাপ প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছে।
বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াছিন আলি বলেন, ব্যাংক খাতের খেলাপির জন্য শুধু ব্যাংক কর্মকর্তারাই দায়ী নন। এর জন্য সরকারের মন্ত্রীরাও দায়ী। সরকার তাদের ধরছে না কেন? তিনি প্রশ্ন করেন, সরকার যদি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো চালাতে না পারে তাহলে এগুলো প্রাইভেট সেক্টরে ছেড়ে দিচ্ছে না কেন? শুধু সোনালী ব্যাংককে রেখে অন্য ব্যাংকগুলোকে প্রাইভেট খাতে ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এ মূহূর্তে একীভূত একটি বার্নিং (জ্বলন্ত) ইস্যু। দুর্বল ব্যাংকগুলোর শেয়ার ভ্যালু কম হওয়ার কারণে অনেক ব্যাংক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী বলেন, একীভূত করা অর্থনীতির জন্য ভালো কিছু নয়, তবে এটাকে আমরা বাদ দিতে পারি না। এ জন্য যে কোনো সময় আমরা প্রস্তুত আছি। এ বিষয়ে আমরা একটা খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছি।

বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, মার্জার সব সময় খারাপ হয় না। এর ইতিবাচক দিকগুলো দেখতে হবে। আমাদেরকে গ্লোবালাইজেশনের অংশ হতে হলে মার্জারে যেতে হবে।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলো একীভূত বা মার্জারের মাধ্যমে বেঁচে যায় কিনা সেটা দেখতে হবে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমবে না। কেননা, মার্জার হলেও ম্যানেজমেন্ট পরিবর্তন হয় না। এসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে মার্জারের গাইডলাইন করা উচিত।

কর্মশালায় এক্সপ্লোরিং মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিশন ইন দ্য কনটেক্স অব দ্য ব্যাংকিং সেক্টর অব বাংলাদেশ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বিআইবিএমের অধ্যাপক এবং পরিচালক মো. মহিউদ্দিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭২ শতাংশ ব্যাংক কর্মকর্তা মনে করেন, বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ ব্যাংক রয়েছে তা কমাতে হবে। তবে ১১ শতাংশ ব্যাংকার মনে করেন ব্যাংকের সংখ্যা ঠিক আছে। আর ১৭ শতাংশ ব্যাংকার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ ছাড়া মার্জারের ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল সুশাসনের অভাব, বোর্ডের গোপন সুবিধা, রাজনৈতিক দুর্বলতা, মানসিকতার পরিবর্তন, পরিচালকদের দুর্বলতা, সঠিক নেতৃত্ব এবং কৌশলগত চ্যালেঞ্জ।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/10/13/162881