১৩ অক্টোবর ২০১৭, শুক্রবার, ৩:৩৭

রোহিঙ্গাদের পালিয়ে বাঁচার পথও বন্ধ

সাগর থেকে ভেসে এলো আরো ২ রোহিঙ্গার লাশ

আরাকানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চলমান উচ্ছেদ অভিযানের পরও অনেক রোহিঙ্গা বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে আসতে চাননি। সেনাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকেই আরাকান রাজ্যের বন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু খাদ্য ও পানির সঙ্কটের কারণে এখন আর তারা থাকতে পারছেন না। প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদীর ওপারে সীমান্তে জড়ো হচ্ছেন। বাংলাদেশে আসার জন্য অনেকেই সেখানে প্রায় ১৫ দিন ধরে অপেক্ষা করছেন। কিন্ত নাফ নদী পাড়ি দেয়ার জন্য সেখানে কোনো নৌকা নেই। অপর দিকে সীমান্তে মিয়ানমারের সেনারা রোহিঙ্গাদের এখন বাধা দিচ্ছে এপারে পালিয়ে আসতে। তাই পালিয়ে আসতে যারা ঘর ছেড়েছেন তারা পড়েছেন মহাবিপাকে।

নিরুপায় হয়ে গত বুধবার ১১ রোহিঙ্গা যুবক জীবন বাজি রেখে সাঁতার কেটে নাফ নদী পাড়ি দিয়েছেন। তাদের বাড়ি বুচিডং শহরের আশপাশে। কারো স্বজনরা আগেই এপারে চলে এসেছেন, আবার কারো স্বজনরা ওপারে রয়ে গেছেন। তারা সীমান্তের নাইক্ষ্যংদিয়ায় জড়ো হয়েছিলেন নৌকায় নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ আসতে। কিন্তু সীমান্তে এখন রোহিঙ্গা পারাপারে ব্যাপক কড়াকড়ি। নৌকা বা অন্য কোনো বাহন মিলছে না। সে কারণে ১১ জনের সবাই ছোট তেলের শূন্য জারিকেন চেপে ধরে প্রায় আড়াই ঘণ্টা নাফ নদে সাঁতার কেটে শাহপরীর দ্বীপ জেটির কাছাকাছি চলে আসতে সক্ষম হন। দৃশ্যটি নাফ নদে টহলরত কোস্ট গার্ডের নজরে এলে তারা তাদের উদ্ধার করে নিজেদের ট্রলারে নিয়ে তুলে তীরে আনেন।
নাফ নদী সাঁতরিয়ে এপারে আসা রোহিঙ্গা যুবকেরা হলেন বুসিডংয়ের সিন্ডং গ্রামের ফয়েজুল ইসলাম (১৭), ইসমাইল পাড়ার হামিদ হোসেন (১৯), কামাল হোসেন (৩০), আনসার উল্লাহ (১৬), হরমুড়া পাড়ার মোহাম্মদ উল্লাহ (২৩), পোহমের ইমাম হোসেন (২২), মো: রিয়াজ (১৯), রমজান আলী (২২), কাইন্দা পাড়ার সৈয়দ হোসেন (৩০), আজলী পাড়ার মো: আরফ (১৮) ও টারম পাড়ার আব্দুল মতলব (২৮)। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন কোস্ট গার্ড টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লেফট্যানেন্ট কমান্ডার মো: জাফর ইমাম সজীব।

সাঁতরিয়ে নদী পার হওয়া আরকানের বুচিডং ইসমাইল পাড়ার রোহিঙ্গা যুবক কামাল হোসেন বলেন, আমরা সাত দিন আগে ঘর থেকে বের হয়েছি বাংলাদেশ আসতে। কিন্তু হঠাৎ করে মিয়ানমার সেনারা আমাদের পালাতে বাধা দিচ্ছে। সেনারা নদীতে কোনো নৌকা নামাতে দিচ্ছে না। এ পারেও নাকি এখন অনেক কড়াকড়ি। তাই আমরা সাঁতার কেটে চলে এলাম। সাঁতার কেটে এপারে আসা কাইন্দা পাড়ার সৈয়দ হোসেন (৩০) বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা সাঁতার দিয়ে বাংলাদেশে এসেছি। আমাদের মা, বোন, স্ত্রী-সন্তানরা ওপারেই রয়ে গেছে। আমাদের রাখাইনে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে চলে এসেছি।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মতে, আরো অন্তত তিন লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসার জন্য নাফ নদীর ওপারে জড়ো হচ্ছেন। নৌকা না পেয়ে সেখানে সবাই কান্না করছে। শিশুদের অবস্থা গুরুতর। তারা বৃষ্টিতে ভিজছে, রোদে পুড়ছে।
এদিকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার সময় গত রোববার রাতে নৌকা ডুবে মারা যাওয়া দুই রোহিঙ্গার লাশ সাগর থেকে ভেসে কূলে এসেছে। বৃহস্পতিবার সকালে সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপের সাগর মোহনা থেকে লাশ দু’টি উদ্ধার করা হয়। ওই নৌকাডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৬টি শিশু, ১৪ জন নারী ও চারজন পুরুষ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড।
স্থানীয় কোস্টগার্ড জানায়, আরাকান রাজ্যের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা থেকে রোববার সন্ধ্যায় অতিরিক্ত রোহিঙ্গাবোঝাই একটি নৌকা টেকনাফে আসছিল। রাত ৯টায় নৌকাটি টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের ঘোলারচর এলাকায় নাফ নদী ও সাগরের মোহনায় ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে ডুবে যায়। তখন অনেকে নিখোঁজ ছিল।

কোস্টগার্ড শাহপরীর দ্বীপ স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জাফর ইমাম সজীব বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টায় শাহপরীর দ্বীপের ঘোলারচর এলাকা থেকে ২৫ থেকে ৩০ বছরের এক যুবকের ও সেন্টমার্টিনের উত্তর বিচ থেকে এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: মাইন উদ্দিন বলেন, লাশ দু’টি স্থানীয়ভাবে দাফন করা হয়েছে। গত ২৯ আগস্ট থেকে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গা বহনকারী ২৭টি নৌকাডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৬৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশী। তিনি নৌকার মাঝি ছিলেন। উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্যে উখিয়া থেকে ২৮টি ও টেকনাফ থেকে ১৩৮টি উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৮৫টি শিশু, ৫৩ জন নারী ও ৩০ জন পুরুষ।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/259518