১৩ অক্টোবর ২০১৭, শুক্রবার, ৩:২৮

মিয়ানমার সরকারের ইঁদুর বিড়াল খেলা

অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে মিয়ানমার সরকার ইঁদুর বিড়াল খেলা খেলছে। উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি থেকে নিজেদের অপরাধগুলোকে তারা লুকিয়ে রাখতে পারছে না। ফলে তারা মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বকে শান্ত করছে। একসময়ের সমৃদ্ধ অঞ্চল আরাকান ধ্বংস হয়ে গেছে। এখানে ঘরবাড়ি আর নেই। অনেক লোককে মেরে ফেলা হয়েছে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। ওখানেই তাদের ধুঁকে ধুঁকে মরতে হচ্ছে। বেশির ভাগ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
বিগত দিনগুলোতে সমঝোতা স্মারকে বেশ কিছু লক্ষণীয় বিষয় আছে, যেমনÑ বাংলাদেশের আগত রোহিঙ্গারা জন্মসূত্রে মিয়ানমারের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও স্মারকে Lawful citizen of Burma না বলে lawful Resident of Burma বলা হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি পরিষ্কার নয়। কেননা, Citizen শব্দের অর্থ রাষ্ট্রের নাগরিক, A person who has full rights as a member of a country, either by birth or by being given such rights. পান্তরে resident অর্থ হলো, বসবাসকারী বা বাসিন্দা, অর্থাৎ A person who lives or has a home in a place, not a visitor. বাংলাদেশ সরকার বরাবরই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করলেও স্মারকে এমন ধরনের শব্দের ব্যবহার ছিল রহস্যজনক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ১৯৯২ সালের ২১ মার্চ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব ভুট্রোস ঘালির সাথে সাাৎ করেন। সে পরিপ্রেেিত জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত, আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল কে এলিয়াসন মিয়ানমার এবং বাংলাদেশে মোট ছয় দিন সফর করেন। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল বার্মার পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ অন গিয়াও ১৪ জন সদস্য নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকল্পে একটি ত্রিপীয় চুক্তি স্বারিত হয়।

দ্বিপীয় আলোচনার প্রথম পর্যায়ে মিয়ানমারে বসবাস করা কিংবা নাগরিকত্বের সামান্যতম প্রমাণ থাকলেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ও স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে সম্মত থাকলেও জাতিসঙ্ঘকে এ ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে জড়িত রাখার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকার রাজি ছিল না। ছয় দিনব্যাপী বেশ কয়েক দফা আলোচনা চলে। কিন্তু স্থায়ী চুক্তির ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারকে রাজি করানো যায়নি।

বার্মার রাজনীতিক উ নু ১৯৬০ সালে মতা গ্রহণ করে বার্মা ফেডারেশনের অধীনে সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ ল্েয তিনি উত্তর আরাকানের রোহিঙ্গা প্রধান অঞ্চল নিয়ে ‘মেউ ফ্রন্টিয়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ গঠন করেন। আরাকানের মগ গোষ্ঠীর নির্যাতন থেকে রা করার জন্য মূলত এ ব্যবস্থা নেয়া হয়। রোহিঙ্গারা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। রাখাইন বা মগ সম্প্রদায় একে বার্মা সরকারের Divide and Rule নীতি বলে অভিহিত করে এবং একে আরাকানের Kala (বিদেশী) রার উদ্যোগ বলে পরিহাস করেছিল। উ নুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গ্রুপ অস্ত্র সমর্পণ করে ১৯৬১ সালের ৪ জুলাই। এতে বার্মার চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার অং জিং বেতার ভাষণে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা বার্মার শান্তিপ্রিয় নাগরিক। বার্মা সরকারের তরফ থেকে শুধু ভুল বোঝাবুঝির কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতি বহু অন্যায় করা হয়েছে। আজ সেই ভুল বোঝাবুঝির অবসানের মাধ্যমে সব সমস্যা দূরীভূত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর সব সীমান্তে একই জাতি সীমান্তের দুই পারে বাস করেন। এ জন্য কোনো নাগরিকের জাতীয়তা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া উচিত নয়।’
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকুু কার্যকর হয়েছে বর্তমানে তাই আমাদের দেখার বিষয়। বাংলাদেশ ও বর্মি কর্তৃপ ১৯৭৮ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়ে বাংলাদেশ-বার্মা সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের পে পররাষ্ট্র সচিব তোবারক হোসেন এবং বার্মার পে বর্মি প্রতিনিধিদলের নেতা উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী টিন অং স্মারকে স্বার করেছিলেন।

কিন্তু এ চুক্তি স্বারের পরপরই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় যৌথ সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে মিয়ানমারের মন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ ভিত্তিহীন, মূলত গুজবের ওপর ভিত্তি করেই তারা দেশত্যাগ করেছে।’ এ চুক্তিতে ইউএনএইচসিআর’কে শরণার্থীদের জন্য ত্রাণসামগ্রী জোগান দেয়া ছাড়া প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা হয়নি। ১৯৯২ সালের ২২ আগস্ট চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ওমর ফারুক এবং মিয়ানমারের অভিবাসন ও জনশক্তি বিভাগের ডাইরেক্টর উ মং অং-এর মাঝে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে রোহিঙ্গাদের আরাকানে সফরের অনুমতি দান এবং তাদের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ রদ করা হয়। নামাজের সময় মুসল্লিদের মসজিদে মাইক ব্যবহার করতে দেয়া হবে বলে জানানো হলো। ইউএনএইচসিআর’কে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার বিষয়টি বিবেচনায় আছে বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশের পর্যবেক্ষক মহলেও চুক্তির ব্যাপারে মতপার্থক্য দেখা গেছে। তাদের মতে, রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের কার্যত চুক্তি হয়নি; যদিও সরকারি পর্যায়ে এটাকে চুক্তি হিসেবে ফলাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে। যে ঘোষণাকে চুক্তি বলা হয়েছে, এটিকে প্রথমে যৌথ ঘোষণা (joint statement) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো বিষয়ে দুই দেশ চুক্তি করলে সেটা পালনে বাধ্য থাকে। একটি অতি গুরুত্বপূর্র্ণ বিষয়ে দীর্ঘ দিন আলোচনার পর কেবল যৌথ ঘোষণা চালিয়ে দিয়ে সমস্যা সমাধান আদৌ হবে কি না সন্দেহ রয়েছে। শরণার্থী বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের ওপর অনেক চাপ সৃষ্টি করলেও তাদের রাজি করাতে পারেনি। ১৯৯২ সালে ২৭ এপ্রিল সোমবার রাতে দীর্ঘ বাগি¦তণ্ডার পর আলোচনা ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত joint statement-এ রাজি হয়ে স্বার করে।
জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরির কথা এবারও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার বলে গেছে। উভয়ে সম্মত হয়েছে। পারস্পরিক সম্প্রীতির কথা কখনো খারাপ নয়, কিন্তু মিয়ানমার সরকারের ইতিহাস ঘেঁটে এবং তাদের কর্মকাণ্ডের খতিয়ান দেখে বাংলাদেশকে এগোতে হবে। আন্তর্জাতিক চাপ পড়লেই জয়েন্ট এগ্রিমেন্ট ইত্যাদি বলে কালক্ষেপণ করা তাদের অভ্যাস। যেমন ১৯৯৪-৯৫ সালের ১২০০ জন রিফিউজির কিয়ার কেস, অর্থাৎ তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের কোনো আপত্তি নেই এ রকম কাগজ মুখ থুবড়ে ইউএনএইচসিআরের দফতরে পড়ে আছে। তাদের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকার কিছু করেছে কি? আরো ব্যাপার হলো জয়েন্টে ওয়ার্কিং গ্রুপ করা হবে, উভয় দেশের প্রতিনিধি থাকবেন। যেখানে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা মিয়ানমারের উচ্চ প্রতিনিধি অস্বীকার করে চলেছেন, সেখানে কাগজপত্রবিহীন হাজার হাজার রিফিউজি শতবার আর্তনাদ করে গলা ফাটালেও মিয়ানমার স্বীকার করবে কি তাদের অধিকার? কাগজপত্র তো ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার সময় হারিয়ে গেছে। কিংবা বর্মি বাহিনী কেড়ে নিয়েছে। সেই কাগজপত্র দেখাবে কিভাবে? এভাবে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হবে। গতবারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কত শ্লথগতিতে হয়েছে মিয়ানমার সরকারের অনমনীয় সিদ্ধান্তের ফলে। ১৯৯৫ সালে হেড কাউন্ট জরিপে দীর্ঘ ইন্টারভিউ রিফিউজি থেকে নেয়া হয়েছিল। মনে হয়, এ যাবৎ যত ইন্টারভিউ হয়েছে, এটিই সবচেয়ে পারফেক্ট। ২০ হাজারের কিছু বেশি রিফিউজির ইন্টারভিউ (আইএফকিউ) নেয়া হয়েছিল। এই ইন্টারভিউ প্রায় আট থেকে দশ পাতার মতো দীর্ঘ হবে। তাদের ছবিসহ সব ডাটা তৈরি করে রাখা হয়েছিল। পরে ইউএনএইচসিআরের অন্যান্য কার্যক্রমের ডামাডোলে তা বিস্মৃত হয়ে গেছে। এভাবে দীর্ঘসূত্রতা করা হলে তা বাংলাদেশের জন্য ভালো নয়।
যা হোক, এখন যেভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, তা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। যাবতীয় এনজিও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে হওয়া উচিত। তাহলে কালক্ষেপণ হবে না বলে আমাদের বিশ্বাস।


 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/259476