১২ অক্টোবর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১২:০০

আইসিইউ যেন সোনার হরিণ!

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ভর্তির জন্য খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের সুপারিশ নিয়ে এক রোগীর স্বজন গত ৩১ আগস্ট একটি আবেদন জমা দেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মন্ত্রীর সুপারিশসহ ওই আবেদন জমা হওয়ার আগে আইসিইউতে শয্যা পেতে আরও ১৫ জন নাম নিবন্ধন করেন। একই দিন আরও ১০ রোগী ভর্তির জন্য নাম নিবন্ধন করেন। কিন্তু শয্যা খালি না থাকায় কাউকেই ভর্তি করা সম্ভব হয়নি। ঢামেক হাসপাতালের ২০ শয্যার আইসিইউর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ২০ থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ১০ দিনে ভর্তির জন্য ২৪৯ রোগী নাম নিবন্ধন করলেও সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ৫ জন।
দূই হাজার ৬০০ শয্যার এ হাসপাতালে আইসিইউ পাওয়া যেন সোনার হরিণ! শুধু এই হাসপাতাল নয়, সব সরকারি হাসপাতালেই একই চিত্র। আর এই সুযোগে বেসরকারি হাসপাতালে চলছে আইসিইউর নামে অনৈতিক বাণিজ্য; যার বেশিরভাগের আবার অনুমোদনই নেই।

সারাদেশে ৬০৬ সরকারি হাসপাতালে ৪৭ হাজার ২২১ শয্যার বিপরীতে আইসিইউ আছে মাত্র ২২১টি। অর্থাৎ প্রায় ২১৪ শয্যার বিপরীতে একটি করে আইসিইউ রয়েছে। সরকারি ৩০টি মেডিকেল ও একটি ডেন্টাল কলেজের মধ্যে মাত্র ১৪টিতে আইসিইউ ইউনিট আছে। সব মিলিয়ে সারাদেশে ৩৪ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে আইসিইউ শয্যা আছে। আরও ৭৭টিতে আইসিইউ স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে বলে জানান সংশ্নিষ্টরা। ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, মাত্র ২০ শয্যার আইসিইউতে ভর্তিপ্রত্যাশীর সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০০ জন। অথচ গড়ে দু'জনও ভর্তির সুযোগ পায় না। সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের পরামর্শক ডা. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান সমকালকে জানান, হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ১২০ থেকে ১৫০ রোগীর অস্ত্রোপচার হয়। তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জনের আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। কোনো রোগী আইসিইউতে ভর্তির পর সুস্থ অথবা মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত শয্যা খালি হয় না। এ কারণে নতুন রোগী ভর্তি করা কঠিন হয়ে পড়ে।

একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে ডা. আসাদুজ্জামান জানান, একজন রোগী আইসিইউতে গড়ে পাঁচ দিন পর্যন্ত ভর্তি থাকেন। এই পাঁচ দিনে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ রোগীর সিরিয়াল পড়ে যায়। চক্রাকারে প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ কারণে চাহিদা অনুযায়ী আইসিইউ সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব হয় না। আবার আইসিইউ শয্যা সংকটের কারণে অনেক সময় রোগীর অস্ত্রোপচারও পিছিয়ে যায়। বাড়তে থাকে ভোগান্তি।
একই বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোজাফফর হোসেন সমকালকে বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ঢাকা মেডিকেলের মতো টারসিয়ারি লেভেলের হাসপাতালের জন্য ২০ শতাংশ এবং সেকেন্ডারি ও অন্যান্য হাসপাতালের জন্য ৭ থেকে ১০ শতাংশ আইসিইউ থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় হাসপাতালের মোট বেডের এক শতাংশও আইসিইউ শয্যা নেই।

সরকারি হাসপাতালের চিত্র :সরকারি ৩৪ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঢামেকে ২০ শয্যা, হূদরোগ ইনস্টিটিটে ২৮ শয্যা, ওসমানী মেডিকেলে ১৬ শয্যা এবং চট্টগ্রাম মেডিকেলে ১২ শয্যার আইসিইউ ইউনিট রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুর, গোপালগঞ্জ, বক্ষব্যাধি ও ঢামেকের বার্ন ইউনিটে ১০টি করে আইসিইউ শয্যা রয়েছে। মিটফোর্ডে ৯টি, শেখ আবু নাসের, পঙ্গু ও ক্যান্সারে ৮টি, নিউরোসায়েন্সে ও সাতক্ষীরায় ৬টি, মানিকগঞ্জ, জামালপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ মেডিকেল কলেজে দুটি এবং গাজীপুর, জামালাপুর, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে দুটি করে আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ৩৭ শয্যার আইসিইউ ইউনিট রয়েছে।

বিএসএমএমইউর অ্যানেসথেসিয়া অ্যানালজিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক সমকালকে বলেন, আইসিইউতে ভর্তি থাকা একজন রোগীর প্রয়োজনীয় ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ প্রতিদিন সরকারি হাসপাতালে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন নেই- এমন রোগীকেও আইসিইউতে ভর্তির জন্য রেফার করা হয় এবং উচ্চ পর্যায়ে তদবির করে আইসিইউ বাগিয়ে নেওয়া হয়। সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ পুরোপুরি ফ্রি থাকা উচিত নয় জানিয়ে ডা. বণিক আরও বলেন, আইসিইউ ব্যবস্থাপনা সার্বক্ষণিক সচল রাখার জন্য নূ্যনতম একটি ফি ধার্য করা প্রয়োজন। তাহলে আইসিইউ শয্যা আরও সম্প্রসারণ এবং যথাযথ মান নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।
অনৈতিক বাণিজ্য : সরকারিতে সংকটের সুযোগ নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলো আইসিইউ নিয়ে বাণিজ্য করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢামেক, মিটফোর্ড, সোহরাওয়ার্দী, হূদরোগসহ সরকারি হাসপাতাল থেকে গ্রিন রোডের ধানমন্ডি হাসপাতাল, মগবাজারের রাশমনো হাসপাতাল, ধানমন্ডির কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল, ইডেন মাল্টিকেয়ার, ইউরো বাংলা, ধানমন্ডি ক্লিনিকসহ রাজধানীতে গড়ে ওঠা অর্ধশতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে আইসিইউর রোগী ভর্তি করা হয়। সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির চিকিৎসক ও নার্স কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে কমিশনের বিনিময়ে রোগী বাগিয়ে মানহীন এসব হাসপাতাল-ক্লিনিকে পাঠান। বাসাবাড়িতে ফ্লোর ভাড়া নিয়ে শয্যা পেতেও কেউ কেউ আইসিইউ বাণিজ্য করছে। কোনো কোনো ক্লিনিকে দৈনিক ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকাও বিল করা হয়।

আবার সরকারি হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক নিজেরাই ক্লিনিক খুলে আইসিইউ বাণিজ্য করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজধানীর উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করে এমএইচ শমরিতা হাসপাতাল অ্যান্ড মেডিকেল কলেজের ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সৈয়দ তারিক রেজা বলেন, ওই হাসপাতালের আইসিইউ পরিদর্শন করে বিস্ট্মিত হয়েছি। আইসিইউর সঙ্গে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের যে যন্ত্র রয়েছে, সেটি বেশ পুরনো ও বিকল। অথচ প্রতিদিন একজন রোগী ভর্তি করে ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকা বিল তোলা হয়। সরকারি হাসপাতাল থেকে একশ্রেণির কর্মচারীই রোগী বাগিয়ে এসব হাসপাতালে নিয়ে যান উল্লেখ করে ডা. রেজা আরও বলেন, রোগীপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা ওইসব দালালকে দেওয়া হয়।

রাজধানীর লালমাটিয়ার এশিয়ান কার্ডিয়াক অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের এক সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মনসুর বলেন, ২০০৪ সালে ওই হাসপাতালে তারা আইসিইউ চালু করেছিলেন। কোনো চিকিৎসক ও নার্সের রেফারেন্সে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে রোগী ভর্তি করা হলে ওই সময়ে পাঁচশ' টাকা টোকেন মানি দেওয়া হতো। পরে তা বৃদ্ধি হতে হতে ৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তাই বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক মালিকদের উচ্চহারে বিল আদায় করা ছাড়া মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়। মানবিক কারণে রোগীর কাছ থেকে উচ্চহারে বিল আদায় করতে না পেরে তিনি লোকসানের মুখে পড়েছিলেন। এ কারণে তিনি হাসপাতাল থেকে মালিকানা প্রত্যাহার করে নেন।

রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগ পরিচালিত এক জরিপে এই দু'জনের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেল। ওই জরিপে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে স্থাপিত ৭০ শতাংশ আইসিইউতে শয্যার সঙ্গে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই। ৬০ শতাংশ আইসিইউতে প্রতি শয্যার বিপরীতে একজন করে নার্স নেই। আবার যেসব নার্স আইসিইউতে কর্মরত রয়েছেন, তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেই।
আইসিইউতে চিকিৎসক, রোগী ও নার্সের পরিসংখ্যান তুলে ধরে ওই জরিপে বলা হয়, দেশের মোট আইসিইউর ৬৪ ভাগ অ্যানেসথেসিয়োলজি বিভাগের অধীনে আর ১২ শতাংশ ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগের অধীনে পরিচালিত হয়। এদের মধ্যে ২৮ ভাগ আইসিইউতে প্রতি ৪ জন রোগীর বিপরীতে একজন চিকিৎসক, ২৪ ভাগ আইসিইউতে ৫ রোগীর বিপরীতে একজন চিকিৎসক এবং ১২ শতাংশ আইসিইউতে ৩ রোগীর বিপরীতে একজন নার্স রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ সমকালকে বলেন, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যেসব হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট চালু করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন নেই। সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে এসব আইসিইউ ইউনিট চালু করা হয়েছে। শিগগিরই তালিকা করে এসব অবৈধ আইসিইউ বন্ধ করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সমকালকে বলেন, সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের তালিকা করা হয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আইসিইউ স্থাপনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পর্যায়ক্রমে জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। অবৈধ আইসিইউর বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে বলে জানান মন্ত্রী।

http://www.samakal.com/bangladesh/article/1710714