১২ অক্টোবর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৫১

অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন চিমিয়াও ফান

বিশ্বব্যাংকের ঋণে সুদ বাড়ছে ১৬৬ শতাংশ!

ঋণ পরিশোধের চাপসহ প্রকল্প ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে

হঠাৎ করে ঋণের সুদ অস্বাভাবিক বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে দেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক। বর্তমানে প্রকল্পের বিপরীতে সহজ শর্তের ঋণে সুদ বা সার্ভিস চার্জ দিতে হচ্ছে দশমিক ৭৫ শতাংশ। এক লাফে তা বাড়িয়ে ২ শতাংশ করার জন্য অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর। এ প্রস্তাব মানা হলে সুদের হার এক লাফে বাড়বে ১৬৬ শতাংশ। এতে প্রকল্প ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবে ঋণ পরিশোধের সময় এবং গ্রেস পিরিয়ড বা রেয়াতকাল কমানোর কথাও বলা হয়েছে। এতে সরকারের ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে।

বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ’র বার্ষিক সভায় যোগ দিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ওই সভায় এ বিষয়টি উত্থাপিত হতে পারে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট সূত্রের। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, অর্থমন্ত্রীকে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান। তবে এর জবাব এখনও দেননি অর্থমন্ত্রী। তার মতে, এ প্রস্তাব মানার সম্ভাবনা কম। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় উন্নতি এবং মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়ার দোহাই দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে এই সুদ। আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে বর্ধিত এ সুদ হার কার্যকর করতে চায় সংস্থাটি।

অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ মুহূর্তে সুদের হার ২ শতাংশ করাটা অনেক বেশি হয়ে যাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির রূপান্তরকালীন বিশ্বব্যাংকের কিছুটা নমনীয় ভূমিকা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ঋণের ব্যবহার কার্যকর ও উৎপাদনমুখী করতে হবে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ নিন্ম-মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ায় এটা করছে বিশ্বব্যাংক। অর্থনীতিতে এর কিছুটা চাপ পড়বে। তাছাড়া বর্তমানে রফতানি প্রবৃদ্ধি নিন্মমুখী, প্রবাসী আয়ের অবস্থা খারাপ, অন্যদিকে বিভিন্ন দেশ থেকে যেভাবে সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট (কঠিন শর্তের ঋণ) নেয়া হচ্ছে সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উচিত ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা পরীক্ষা করে সম্ভাব্য করণীয় ঠিক করা। তিনি বলেন, তবে ঋণ যাই নেয়া হোক না কেন, যে উদ্দেশ্যে নেয়া হচ্ছে সেটি যেন পূরণ করা হয়। কেন না, ঋণের টাকা পরিশোধের দায় পড়ে জনগণের ওপরই।

বিশ্বব্যাংক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, সেপ্টেম্বর মাসে অর্থমন্ত্রীকে পাঠানো এক চিঠিতে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ভালো। তাছাড়া মাথাপিছু আয়ও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। নিন্ম আয়ের দেশ থেকে নিন্ম-মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এ অবস্থায় আইডিএ থেকে বাংলাদেশ সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে। এ অবস্থায় এসডিআরের বর্তমান আইডিএ ঋণের সার্ভিস চার্জ শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সুদ ২ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়। মার্কিন ডলারে হিসাব করলে বর্তমানে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে সুদ দাঁড়াবে ২ দশমিক ৬২ শতাংশে। অন্যদিকে বর্তমানে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ৬ বছরের গ্রেস পিরিয়ড পায় বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে এক বছর কমিয়ে ৫ বছর করা হবে। এছাড়া ঋণ পরিশোধে ৩৮ বছর থেকে ৮ বছর কমিয়ে ৩০ বছর করা হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড.সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নিন্ম-মধ্য আয়ের দেশে যাওয়ার মূল্য এখন দিতে হবে। তবে ২ শতাংশ সুদের হার অনেক বেশি। কেননা বাংলাদেশ এখন একটি ট্রানজেকশন পিরিয়ড (রূপান্তরমূলক সময়) পার করছে। এসময় ঋণের ২ শতাংশ সুদের হার করা ঠিক হবে না। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের আরও নমনীয় বা সহযোগিতামূলক ভূমিকা থাকা উচিত।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে. মুজেরি বলেন, আমরা লো-ইনকাম থেকে লো-মিডিয়াম ইনকামের দেশে চলে গেছি। তাই সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার সুবিধা আর থাকবে না। তাছাড়া স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকেও বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ওপরে যতই উঠতে যাবেন ততই বাণিজ্যিক ঋণ নিতে হবে। উন্নয়ন যত বেশি হবে, ততই এ ধরনের বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে হবে। তবে যে ঋণ নেয়া হয়, তার ব্যবহার যেন উৎপাদনমুখী হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সূত্র জানায়, এর আগে সহজ শর্তের ঋণের বাইরে অতিরিক্ত হিসাবে স্কেল-আপ ফ্যাসিলিটিজের নামে চড়া সুদে ঋণ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক বলেছিলেন, স্বল্প সুদের ঋণের পাশপাশি প্রয়োজন হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে পারে বাংলাদেশ। এর সুদ হবে বিশ্বব্যাংকের বর্তমান হারের তুলনায় চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি। বর্ধিত সুবিধা বা স্কেল-আপ ফ্যাসিলিটি (এসইউএফ) থেকে উচ্চ সুদের এ ঋণ দিতে চায় সংস্থাটি। এ তহবিলে ৩৯০ কোটি ডলার রয়েছে। আগস্টে এ তহবিল থেকে চড়া সুদে প্রথম ঋণ চুক্তি করেছে সরকার। এ চুক্তির আওতায় ৫ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮০ টাকা হারে) প্রায় ৪৭২ কোটি টাকার ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ পাওয়ার সিস্টেম রিলাইবেলিটি অ্যান্ড ইফিসিয়েন্সি ইমপ্র“ভমেন্ট শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নে এ অর্থ ব্যয় করা হবে। এ ঋণের সুদের হার ধরা হয়েছে ২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এছাড়া অনুত্তোলিত ঋণের স্থিতির ওপর বার্ষিক শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে কমিটমেন্ট ফি এবং এককালীন ফ্রন্ট অ্যান্ড ফি হিসেবে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে দিতে হবে। ৯ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/10/12/162791