১২ অক্টোবর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৫০

প্রস্তুতি ছাড়াই সাত কলেজের অধিভুক্তি নিয়ে বিপাকে ঢাবি

ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীরা

সেশনজট মুক্ত করে শিক্ষাকার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয় রাজধানীর সাত সরকারি কলেজকে। তবে অধিভুক্তির পর থেকেই কলেজগুলোকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এবং যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়া অধিভুক্তির কারণেই তা হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর ফলে ঠিক সময়ে পরীক্ষা নেয়া, ফল তৈরি এবং শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক প্রমোশন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় জনবল, প্রযুক্তি সুবিধা, সময়ের অভাব এবং তথ্য-উপাত্ত না পেয়ে সাত কলেজ নিয়ে এখন চরম বিপাকে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। সে জন্য যথাসময়ে ফল ঘোষণা করা যাচ্ছে না। ফল না পাওয়ায় ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে একরকম স্থবিরতা বিরাজ করায় ভোগান্তিতে রয়েছেন কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা। ফলে সেশনজট মুক্ত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আসা এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো তা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। পাশাপাশি ফল হাতে না পাওয়ায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক চাকরিতে আবেদন করতে না পারায় উদ্বেগে শিক্ষার্থীরা।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এ সাত কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাবির অধিভুক্ত করা হয়। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। অধিভুক্ত কলেজগুলো হলোÑ ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, এসব কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বর্তমানে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৩৬ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। এর আগে ঢাবির অধিভুক্ত কলেজ ছিল ১০৪টি। নতুন সাতটি যোগ হওয়ায় এ সংখ্যা এখন ১১১টি। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ১০৪টি কলেজ ও ইনস্টিটিউটের শিার্থী সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার ৬৯৮ জন, শিক সাত হাজার ৫৯১ জন। ফলে নিজস্ব ৩১ হাজার ৯৫৫ জন শিার্থীর বাইরে আরো দুই লাখ আট হাজার শিার্থীর দায়িত্ব নিতে হিমশিম খাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যাপ্ত জনবল ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে নিজস্ব শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পরীক্ষা নেয়া ও ফল তৈরিতে বিলম্বের কারণে বেশ কয়েকটি বিভাগে রয়েছে সেশনজট। এর মধ্যে অধিভুক্ত কলেজের এ বিশাল শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নিতে মোটেও প্রস্তুত ছিল না ঢাবি। নিজ শিক্ষার্থীদের বাইরে সাত কলেজের শিক্ষার্থীর যথাসময়ে পরীক্ষা নেয়া, ফল তৈরি করা, নতুন বর্ষে ভর্তি হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য নিজেদের আরো প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ব্যক্তিরা। অধিভুক্তির সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা এসব শিক্ষার্থীর তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করাও সাত কলেজ সঙ্কটের জন্য দায়ী বলে মনে করেন তারা।

এ দিকে অধিভুক্তির সময় এসব কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের লিখিত পরীা নেয়া হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু মৌখিক পরীা শেষ হওয়ার আগেই সেগুলোকে ঢাবির অধিভুক্ত হয়। পরীক্ষার মাঝপথে অধিভুক্তিকে সমালোচনার চোখে দেখেছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বন্দ্বের কারণে শিক্ষার্থীদের তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ায় ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছে ঢাবি প্রশাসন। মূলত এসব কারণেই সাত কলেজ নিয়ে বিপাকে ঢাবি। যদিও বর্তমানে প্রযুক্তিগত অব্যবস্থাকে বড় করে দেখছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর ফলে বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষার সময় নির্ধারণ, ফল প্রকাশে বিলম্ব করেন তারা। এরই পরিপেক্ষিতে গত ২০ জুলাই শাহবাগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে চোখ হারান তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর। পুলিশি হামলার শিকার হন অনেক শিক্ষার্থী। মামলা করা হয় অজ্ঞাত এক হাজার ২০০ শিক্ষার্থীর নামে। এ ছাড়া গত ৫ অক্টোবর শাহবাগে সংবাদ সম্মেলন করে পাঁচ দফা দাবি জানান সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। একই দাবিতে ৮ অক্টোবর রাজধানীর নীলক্ষেত মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা। সবশেষে গত ৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সাথে সাক্ষাৎ করেন কলেজের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা। এ সময় ভিসির দেয়া নভেম্বরের মধ্যেই ফল ঘোষণার আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত করেন তারা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেয়া ৩০ নভেম্বর সময়সীমার মধ্যে ফল ঘোষণা না হলে আবারো আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দেন তারা।
সাত কলেজ নিয়ে এত সমস্যার কারণ হিসেবে নিজেদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এর ফলেই কম সময়ে এত বিশাল কাজের আঞ্জাম দিতে গিয়ে বিপাকে ঢাবি। সেই সাথে ভোগান্তিতে রয়েছেন কলেজের শিক্ষার্থীরা।

অধিভুক্তিকেই ভোগান্তির কারণ উল্লেখ করে ইডেন মহিলা কলেজের চতুর্থ বর্ষের ফলপ্রার্থী শিক্ষার্থী কানিজ আক্তার লিপি বলেন, মাঝপথে অধিভুক্তকরণের পরেও তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আন্তরিকতা ততটা দেখা যায়নি। এ সময় অধিভুক্ত না হলে আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকলে আমরা এতদিনে অনার্স শেষ করে ফেলতাম। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চার মাস আগে রেজাল্ট পেলেও আমরা এখনো পাইনি। ফলে আমাদের নিয়ে পরিবারের চিন্তার অন্ত নেই।
একই কলেজ-বর্ষের শিক্ষার্থী প্রিয়াংকা হাওলাদার বলেন, ফল না পাওয়ায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছি না আমরা। মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নিজেদের ঝামেলা না মিটিয়েই তার মধ্যে আমাদের ফেলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এটা ঠিক নয়। আমরা চাই আমাদের অ্যাকাডেমিক কাজে গতিশীলতা আসুক।

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রেজাউল কবির বলেন, পরীক্ষার ৯ মাস পরেও ফল প্রকাশ করা হয়নি। অন্য কলেজগুলোর শিার্থীরা চার মাস আগে রেজাল্ট পেয়ে মাস্টার্সে ভর্তি প্রক্রিয়ায় শুরু করলেও আমরা এখনো রেজাল্ট পাইনি। চাকরির বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়ও অংশ নিতে পারছি না।
প্রস্তুতি ছাড়াই অধিভুক্তির বিষটিকে ভুল আখ্যা দিয়ে ঢাবির ইতিহাস বিভাগের সংখাতিরিক্ত অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, এ কলেজগুলো অধিভুক্তকরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না। সেই সাথে দক্ষ জনবল, প্রক্রিয়াগত জটিলতা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঐকান্তিকতার অভাব ছিল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাবির তৎকালীন ভিসির মধ্যে সম্পর্ক ছিল শীতল। এ কারণেই সঙ্কট। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বর্তমান ভিসির সাথে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সম্পর্ক ভালো। আশা করি এর সমাধান হয়ে যাবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কী করে তাদের সক্ষমতা অর্জন করবে সেটা জানা নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা বিচার করে সরকারি সিদ্ধান্তে এ কলেজগুলোকে অধিভুক্ত করা হয়েছে। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বন্দ্বের কারণেই সঙ্কট প্রকট হয়েছে এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
সাত কলেজের অধিভুক্তি নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তরিকতা সম্পর্কে জানতে ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান বলেন, সংখ্যায় কম মনে হলেও সাত কলেজের শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর অধিভুক্ত অন্য ১০৪ কলেজের শিক্ষার্থীর থেকেও অনেক বেশি। এ সংখ্যার তুলনায় আমাদের লোকবল ও প্রযুক্তির অনেক ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে এ কলেজগুলোর ফল প্রদানের জন্য আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তা নিচ্ছি। পাশাপাশি আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমরা যে সময় নিয়েছি আশা করি সে সময়ের মধ্যে ফল প্রকাশ করতে পারব। পাশাপাশি আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/259281