১২ অক্টোবর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৪৭

স্থবির নির্মাণ শিল্প বেকার হচ্ছে শ্রমিক

লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে নির্মাণে অত্যাবশ্যকীয় রডের বাজার। নতুন ভ্যাট আইন স্থগিত হলেও কমেনি এই নির্মাণ পণ্যের দাম। বরং তিন মাসের ব্যবধানে দেশের বাজারে এমএস রডের দাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এতে করে নির্মাণ খাতে স্থবিরতা কাটছে না। বেকার হতে পারে নির্মাণ শ্রমিক। জুনে প্রতি টন ৪৫-৪৭ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া রড এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৫৭ হাজার টাকায়। এ দাম বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলছেন কনস্ট্রাকশন ও আবাসন শিল্প মালিকরা।

জানা গেছে, রডের দাম নিয়ে তখন আন্দোলনও করে তারা। কয়েক দফায় তারা সাংবাদিক সম্মেলনও করে বাংলাদেশ রি-রোলিং মিল এসোসিয়েশন। তারা বলেছিল দাম বাড়লে নির্মাণ খাতে স্থবিরতা নেমে আসবে। কিন্তু ভ্যাট আইন কার্যকর ছাড়া কেন দাম বাড়লো তার কোন উত্তর দিতে পারেনি তারা।

অর্থমন্ত্রীর কাছে সম্প্রতি পাঠানো চিঠিতে আবাসন ও নির্মাণ শিল্প মালিকরা উল্লেখ করেছেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে রডের ওপর ভ্যাট আরোপকে কেন্দ্র করে রডের দাম প্রথমে ১৫ শতাংশ বাড়ায় কোম্পানিগুলো। পরবর্তীতে সরকার ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেও কোনো কোম্পানিই রডের দাম কমায়নি। বরং আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামাল ও দেশে গ্যাসের মূল্য সমন্বয়ের কথা বলে ধীরে ধীরে তা আরো বাড়িয়ে ১৮-২০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এসব বিবেচনায় নিলেও রডের দাম সর্বোচ্চ ১ শতাংশ বাড়া উচিত বলে দাবি আবাসন ও নির্মাণ শিল্প মালিকদের।

এ প্রসঙ্গে বিএসআরএমের নির্বাহী পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, শুধু কাঁচামালের দাম বাড়ায় দেশের বাজারে রডের মূল্য বেড়েছে। বর্তমানে কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাংকে এলসি খুললেও রপ্তানিকারক দেশগুলো পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না। এতে রডের বাজার আবারও চড়া হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বিভিন্ন রড উৎপাদনকারী ও পাইকারি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই মাস ধরে সব ধরনের রডের দাম বাড়তে শুরু করে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এমএস রডের দাম। গত সপ্তাহে মিল গেইটে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি টন ৬০ গ্রেড (৫০০ ওয়াট) এম এস রড বিক্রি হয়েছে ৫০ হাজার থেকে ৫৬ হাজার টাকায়।
এ বিষয়ে রতনপুর স্টিল এন্ড রি-রোলিং মিলসের (আএসআরএম) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মারজানুর রহমান বলেন, বিলেট উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হয় স্ক্রেপ। এই স্ক্রেপের দামও বেড়েছে। ১৫-২০ দিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে বিলেট ও স্ক্র্যাপ জাহাজের দাম বাড়ার কারণে দেশের রডের বাজারে দাম ওঠানামা করছে।
রডের মূল্যবৃদ্ধিকে স্বাভাবিক উল্লেখ করে তপন সেনগুপ্ত আরো বলেন, বছরের এই সময়টাতে কাঁচামালের দাম এমনিতেই চড়া থাকে। তাই রডের দাম বাড়া স্বাভাবিক। গত বছর রডের দাম ছিল ৫৭ হাজার টাকা। মাঝে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমার ফলে দেশের বাজারেও রডের দাম কমে ৪৬-৪৭ হাজার টাকায় নেমে এসেছিল। এখন আবার বাড়ছে। রডের দাম ওঠানামার পুরো প্রক্রিয়াটা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

রড ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিবছর শুষ্ক মওসুমে রডের দাম বাড়লেও এবার বর্ষার শুরু থেকেই রডের দাম বাড়ছে। রডের ব্যবহৃত কেমিক্যাল আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার কারণে রডের মূল্য বাড়ছে।
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মনির উদ্দিন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বিলেটের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্যাসের মূল্য ও কর-ভ্যাটের হার বৃদ্ধির কারণে রডের দাম বাড়তে পারে। গত কয়েক বছরে ইস্পাত শিল্পে কোনো ধরনের করহার বাড়ানো হয়নি। দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান নিজেরাই বিলেট উৎপাদন করায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম সামান্য বাড়লেও তার প্রভাব দেশের বাজারে না পড়ারই কথা।
রাজধানীর পাইকারি দোকানগুলোয় ৬০ গ্রেডের প্রতি টন রড বিক্রি হয়েছে ৫৬-৫৭ হাজার টাকায়। ৪০ গ্রেডের প্রতি টন রড বিক্রি হয়েছে ৫২-৫৩ হাজার টাকায়। আর সাধারণ রড বিক্রি হয়েছে প্রতি টন ৫০-৫১ হাজার টাকায়। জুন থেকে শুরু করে প্রতি টন রড গড়ে ১০ হাজার টাকা করে বেড়েছে বলে জানান নির্মাণ শিল্পসংশ্লিষ্টরা।
দেশে রড উৎ্পাদনকারী স্টিল রি-রোলিং মিল মালিকরা বলছেন, প্রথমে ভ্যাট আরোপকে কেন্দ্র করে রডের দাম বাড়ানো হলেও পরবর্তীতে এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি যোগ হয়েছে। ফলে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত বাতিল হলেও রডের দাম কমানো যায়নি। পাশাপাশি গ্যাসের মূল্য সমন্বয় ও কোম্পানিগুলোর নিজেদের উত্পাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে রডের দামে।

বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং এন্ড স্টিল মিলস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম মাসুদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তিন মাস আগে প্রতি টন বিলেটের দাম ছিল ৩০০ ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩৭০ ডলার। বিলেট ছাড়াও রড তৈরিতে ব্যবহারের জন্য আমদানিকৃত পুরনো জাহাজের দামও বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে পুরনো জাহাজের একেকটি প্লেটের দাম ছিল ৩০ হাজার ডলার। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩৪ হাজার ডলারে। অন্যদিকে ভ্যাট আরোপের আদেশ বাতিল হলেও ওই প্রথমে আমদানি ক্রয়াদেশ দেয়া সব কাঁচামালে ভ্যাট দিতে হয়েছে কোম্পানিগুলোকে, যা এখনো সমন্বয় হয়নি। ফলে রডের দাম কমানো যায়নি।
রতনপুর স্টিল মিলসের(আরএসএম) একজন কর্মকর্তা বলেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করতে গিয়ে রডের দাম বাড়িয়েছে সব প্রতিষ্ঠান। আমাদের প্রতি টন রডের দাম গড়ে ১৫-১৮ শতাংশ বেড়েছে। তবে কাঁচামাল ও কোম্পানির উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে এর দাম আরো বাড়ানো দরকার। বর্ষা মওসুম শেষ হলে দাম আরেক দফা বাড়তে পারে।
রডের দাম আরো বাড়লে আবাসন শিল্পের জন্য তা হুমকি হিসেবে দেখা দেবে বলে মনে করছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব। এ সংগঠনটির সহসভাপতি লোকমান হোসেন বলেন, ২০০৮-০৯ সালে একবার রডের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় আবাসন খাতকে ব্যাপক ভুগতে হয়। ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে ওই সময় আবাসন ব্যবসায় মন্দা নেমে আসে। একটি ভবন নির্মাণের জন্য দুই বছর আগে খরচের পরিকল্পনা করা হয়। সে হিসাবেই ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। দাম নির্ধারণের পর রডের দাম বেড়ে গেলে এ শিল্পের ব্যবসায়ীদের খরচ অনেক বেড়ে যায়।
ইমারন নির্মাণ ইউনিয়ন সূত্র জানায়, দেশে যে হারে রডের দাম বাড়ছে তাতে নির্মাণ খাতে স্থবিরতা নেমে আসবে। এতে করে অনেক শ্রমিক বেকার হতে পারে। অনেক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান তাদের নতুন কাজে হাত দিচ্ছে না। তারা বলছে,রডের দাম কমলে কাজ শুরু করবে। এতে করে অনেক শ্রমিক কাজ না পেয়ে বসে রয়েছে।
এমনিতেই এ খাতে মন্দাভাব অব্যাহত রয়েছে। যদি নির্মাণ শিল্পের উপকরণের দাম আরও বাড়তে থাকে তাহলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। এতে দেশে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়বে এবং অর্থনীতি আরও গতিহীন হয়ে পড়বে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সরকারকে আরও এগিয়ে আসতে হবে। রডের দাম সমন্বয় করতে হবে।

রডের দাম নির্ধারণে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সাথে রি-রোলিং মালিকদের বসা দরকার। যে ভ্যাট আইনের অজুহাতে দাম বাড়িয়েছেন রি-রোলিং মালিকরা সে আইন স্থগিত করা হলেও দাম আর কমেনি। এখন তারা নতুন করে আর্ন্তজাতিক বাজারের অজুহাত দাড় করছে। সরকার যখন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন নিয়ে মাঠে নামে তখন আমরা এ শিল্পের স্বার্থে কথা বলেছিলাম। এখন কোন কারন ছাড়াই দাম বেড়েছে। অথচ কেউ কথা বলছে না। তাহলে আমরা আন্দোলন করলাম কার স্বার্থে।
জানা গেছে,সারা দেশে প্রায় ৩০ লাখের উপর নির্মাণ শ্রমিক রয়েছে। এদের অধিকাংশই গরিব। তাদের জন্য সরকার কোন কিছুই করছে না। অথচ নির্মাণ শিল্পের দাম বাড়লে তারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের পক্ষে সংসার চালানো কষ্টকর হচ্ছে।
পুরান ঢাকার নির্মাণ শ্রমিক রতন মিয়া দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, আমি একটি হাউজিং কোম্পানিতে কাজ করি। দৈনিক ৪৫০ টাকা বেতনে কাজ করি। স্ত্রী আর এক সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকি। গত ৫ দিন ধরে কাজ নেই। তাই সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন,কোম্পানির নতুন প্রজেক্ট চালু হওয়ার কথা ছিল ১ অক্টোবর। কিন্তু রডের দাম বেশি হওয়ার কারনে কাজ শুরু করতে বিলম্ব করছে কোম্পানি। রতন মিয়ার মত অনেকেই কাজ না পেয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।
অনেক খাতে প্রনোদনা দিলেও এ খাতে কোন সুবিধা দিচ্ছে না সরকার। সরকার যদি এখাতে কিছুটা প্রণোদনা দিত তাহলে এ সব শ্রমিকরা কিছুটা সুবিধা পেত। কিন্তু রিহ্যাব নানাভাবে এখাতে প্রণোদনার দাবি জানালেও সরকার আমলে নেয়নি। এতে করে প্রতি নিয়ত পিছিয়ে পড়ছে দেশের নির্মাণ খাত।

http://www.dailysangram.com/post/303182