সীমান্ত পেরিয়ে আসা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সাবরাং হারিয়াখালী সাইক্লোন শেল্টারে জমায়েত করা হয়
১১ অক্টোবর ২০১৭, বুধবার, ১১:৩৫

স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে রোহিঙ্গাদের

কলেরা ভ্যাকসিন কর্মসূচি চালু

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের নির্যাতন, গণহত্যা ও জ্বালাও পোড়াও থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল এখনো থেমে নেই। প্রতিদিন কমবেশি রোহিঙ্গা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছেন। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সিংহভাগই হচ্ছে শিশু ও নারী। বাংলাদেশের স্যাঁতসেঁতে এবং ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করতে গিয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। বিশেষ করে ডায়রিয়া নিউমোনিয়াসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। রোহিঙ্গাদের এই স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে সরকার গতকাল থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং আশপাশের বাংলাদেশী বাসিন্দাদের জন্য কলেরা ভ্যাকসিন কর্মসূচি শুরু করেছে। উখিয়া ও টেকনাফের ১৬২টি কেন্দ্রে টিকা খাওয়ানো কার্যক্রম শুরু করেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালিক। উক্ত ভ্যাকসিন কর্মসূচি উদ্বোধনের সময় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেন, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয়ের জন্য আসা রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় তাদের কলেরাজনিত ডায়রিয়া রোগের টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই লক্ষ্যে প্রথম দফায় সাড়ে ছয় লাখ ও দ্বিতীয় দফায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে টিকা খাওয়ানো শুরু হয়েছে। এর আগে হাম, যক্ষা, পোলিওসহ অন্যান্য রোগের টিকা ও চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১৯ জন ‘এইডস’ রোগী শনাক্তের কথা উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কলেরা একটি মহামারী ও সংক্রামক রোগ। এই রোগ দেখা দিলে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাই আগে থেকেই এই রোগের টিকা কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার।
তিনি বলেন, বিপুল রোহিঙ্গার জন্য এখনো পর্যাপ্ত সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা সম্ভব হয়নি। এই অবস্থায় কলেরা রোগ সৃষ্টি হতে পারে।

এ দিকে উখিয়া থাইংখালী মিয়ানমারের রাচিডং থেকে আসা এক রোহিঙ্গার তাঁবুতে গিয়ে দেখা যায় তার পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনজনই অসুস্থ। তারা সবাই জ্বর, সর্দি ও কাশিতে ভুগছে। অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্পে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ নিয়েছেন। তারপরও দুই দিন ধরে জ্বর কমছে না। নূর মোহাম্মদ বলেন, আমাদের একদিকে খাবার সঙ্কট, অন্য দিকে আছে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশের সঙ্কট। নোংরা পরিবেশে থেকে সব বাচ্চা এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সামনে আরো কী কী কষ্ট ভোগ করতে হবে জানি না। থাইংখালীর একই পাহাড়ে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নেয়া আরেক রোহিঙ্গা আবদুল মজিদের সাথে কথা হয় তার তাঁবুর বাইরে। বেলা তখন দেড়টা। আবদুল মজিদ বসেছিলেন তাঁবুর এক কোনায় কাপড়ের বস্তার সাথে হেলান দিয়ে। তার পাঁচ ছেলেমেয়ে তখন দুপুরের খাবার থালা নিয়ে বসা। চারদিকে তখন মাছির ভন ভন আওয়াজ। দুর্গন্ধও নাকে লাগছে বেশ। খাবারের পাতে দেখা গেল সাদা ভাত আর আলুর ভর্তা। তাদের সামনে রয়েছে এক বাটি সবজিও। বাইরে ডেকে নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি কী জানতে চাইলে আবদুল মজিদ বলেন, প্রধান সমস্যা থাকা আর খাওয়া। বৃষ্টি হলে রাতে সবাই একসাথে ঘুমাতে পারি না। তাঁবুর চারপাশ থেকে পানি চুপসে মেঝে ভিজে যায়। তখন ছোট শিশুদের ঘুমাতে দিয়ে আমরা বসে থাকি। আর ত্রাণের ওপরই আমাদের একমাত্র ভরসা। ত্রাণ সহযোগিতা না পেলে আমাদের একদিনও চলবে না।

এ দিকে রোহিঙ্গা প্রবেশ থেমে নেই। ২৫ আগস্ট থেকে আইওএমএর হিসেব মতে মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা সোয়া পাঁচ লাখে দাঁড়িয়েছে। বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রথমে উখিয়ার টেকনাফে নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও এখন দুই উপজেলার ১৫টি এলাকায় অবস্থিত অস্থায়ী ক্যাম্পে থাকছেন। অত্যন্ত ঘিঞ্জি এবং স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সোয়া পাঁচ লাখের শতকরা ৭০ ভাগই নারী ও শিশু। তাদের মধ্যে পানিবাহিত রোগের আশঙ্কা বেশি, ইতোমধ্যে ২৭ হাজার রোহিঙ্গা ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বিশাল এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে হিমশিম খাচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের মধ্যে পানিবাহিত এবং ম্যালেরিয়া জাতীয় রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও করছেন তারা। ব্যাপক মাত্রায় ডায়রিয়াজনিত রোগ যাতে ছড়াতে না পারে সে জন্য সরকার কলেরা ভ্যাকসিন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। গতকাল থেকে উখিয়া টেকনাফে ছয় লাখ ৫০ হাজার কলেরা ভ্যাকসিন খাওয়ানোর কর্মসূচি শুরু হয়েছে। আগামী ৩০ অক্টোবর দ্বিতীয় দফা কলেরা ভ্যাকসিন খাওয়ানো হবে।

একইসাথে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ডায়রিয়া নিউমোনিয়া ছাড়াও অন্যান্য রোগ যাতে মহামারী আকারে ছড়াতে না পারে সে পরিকল্পনাও নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সরকারি-বেসরকারিভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ৬০টির বেশি মেডিক্যালক্যাম্প সার্বক্ষণিক রোহিঙ্গাদের মধ্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে।

 

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/258986