১১ অক্টোবর ২০১৭, বুধবার, ১১:০৫

চরম গ্যাস সংকটেও টনক নড়ছে না সরকারের

শিল্পাঞ্চল বাঁচাতে পেট্রোবাংলাকে তিতাসের জরুরি চিঠি * পরিস্থিতি সামাল দিতে আজ জরুরি বৈঠক ডেকেছে পেট্রোবাংলা * গ্যাসের ঘাটতি ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট ছাড়িয়েছে * গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআইজি থেকে কমে ১-এ ঠেকেছে, অথচ বিল দিতে হচ্ছে ১৫ পিএসআইয়ের
গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে গ্যাস সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন এ সংকট বাড়ছে। এতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিল্প ও কারখানাগুলোর উৎপাদন। গ্যাসের অভাবে গাজীপুরসহ আশপাশের এলাকার অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ছোট ছোট অনেক কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। সংকট এতটাই ভয়াবহ যে, মাঝারি আকারের একটি কারখানায় ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ লাগলেও বর্তমানে তা নেমে এসেছে ১ পিএসআইয়ে। অথচ বিল দিতে হচ্ছে ১৫ পিএসআইয়ের। ফলে লোকসান গুনতে গুনতে পথে বসার উপক্রম হয়েছে শিল্প মালিকদের। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্র-পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রচারিত হলেও সরকারের টনক নড়ছে না এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো সাড়াও মিলছে না।

গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের এ তীব্র গ্যাস সংকট সামাল দিতে পেট্রোবাংলাকে (বাংলাদেশ অয়েল গ্যাস অ্যান্ড মিনারেল কর্পোরেশন) জরুরি চিঠি দিয়েছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে তিতাসে ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে আগে ছিল ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। নতুন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেঞ্চুগঞ্জে ৬০ মিলিয়ন ঘনফুটের দুটি গ্যাসক্ষেত্র মেরামতের জন্য বন্ধ আছে। এ ছাড়া তিতাসের গ্রিড লাইন থেকে খুলনাসহ কয়েকটি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও নতুন করে গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে নতুন ১২০ মিলিয়ন ঘনফুটসহ মোট ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে গাজীপুরসহ আশপাশের শিল্পাঞ্চলের কলকারখানাগুলোতে গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, এ সংকট সামাল দিতে তারা জরুরি ভিত্তিতে পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়েছেন। পেট্রোবাংলা যদি দ্রুত অন্য সেক্টরের গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে আপাতত ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ব্যবস্থা করে দিতে পারে তাহলে গাজীপুরের এ সংকট থাকবে না। তিতাসের এমডি বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র দুটি চালু হতে আরও ৪-৫ দিন লাগতে পারে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

এ ব্যাপারে গাজীপুর তিতাস গ্যাসের ম্যানেজার (অপারেশন) আবু বকর সিদ্দিক যুগান্তরকে বলেন, গ্যাসফিল্ড থেকে ট্রান্সমিশন লাইনের মাধ্যমে ১৭শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেত তিতাস। এখন তা ১৫৮০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে। ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম পাওয়ার কারণে সব নেটওয়ার্কে লো প্রেসার হচ্ছে। তিনি বলেন, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে লিখিতভাবে পেট্রোবাংলাকে জানানো হয়েছে। কবে নাগাদ এ সমস্যার সমাধান হবে তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

শিল্প মালিক ও জ্বালানি সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ অবস্থায় পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ দ্রুত কোনো ব্যবস্থা না নিলে গাজীপুর ও আশপাশের এলাকার ছোট-বড় সহস্রাধিক শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শিল্প মালিকরা বলেছেন, সংকট এতটাই ভয়াবহ যে, যেখানে মাঝারি আকারের একটি কারখানা চালাতে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ লাগে, সেখানে তা ১ পিএসআইয়ে নেমে এসেছে। অথচ বিল দিতে হচ্ছে ১৫ পিএসআইয়ের। তারা বলেছেন, একদিকে গ্যাসের চাপ না থাকায় উৎপাদনে বিঘœ ঘটছে অন্যদিকে গ্যাসের বিলও বেশি আসছে। এতে শিল্প মালিকরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তারা এ সমস্যা সমাধানে কারখানায় অবিলম্বে ইবিসি মিটার স্থাপনের দাবি জানান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার একজন পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, বন্ধ কূপ দুটি মেরামত না হওয়া পর্যন্ত তাদের হাতে বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। কারণ মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৪৮ শতাংশ গ্যাস এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া সিএনজি আর সার কারখানা মিলে খরচ হচ্ছে আরও ১৫ শতাংশ। বাসাবাড়িতে সরকারি হিসাবে খরচ দেখানো হচ্ছে ১৫ শতাংশ। বাস্তবে এর পরিমাণ দ্বিগুণ। এই বাড়তি ১৫ শতাংশ অবৈধ গ্যাস সংযোগে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সার কারখানা ও কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করা ছাড়া কোনো বিকল্প তাদের হাতে নেই।

এদিকে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, আজ এ নিয়ে জরুরি বৈঠক করবে পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ। বৈঠকে তিতাস গ্যাসের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে আজ থেকে সার কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে পেট্রোবাংলা।

মঙ্গলবার গাজীপুর ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন দেখা গেছে, তীব্র গ্যাস সংকটে এলাকার অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। লোকসান গুনতে গুনতে প্রায় পথে বসার উপক্রম হয়েছে শিল্প মালিকদের। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বেসরকারি খাত বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পকে ধ্বংস করতে একটি দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট ষড়যন্ত্র করছে। সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা একটি চক্র দেশের গার্মেন্টস সেক্টর বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার জন্যই এ ষড়যন্ত্র করছে। ইতিমধ্যে তারা অনেকটা সফলও হয়েছে। শিল্প মালিকদের অভিযোগ, গত জুন মাস থেকে গাজীপুর, কোনাবাড়ি, সফিপুর এলাকার শিল্প-কারখানাগুলোতে গ্যাসের সংকট চলছে। কিন্তু এতে সরকারের কোনো মাথা ব্যথা নেই। প্রতিদিন সংকট তীব্র হচ্ছে। গ্যাসের অভাবে অসংখ্য ছোট ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানার অর্ডারগুলো বায়াররা অন্য দেশে নিয়ে গেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিল্প মালিক বলেন, পত্রিকায় নাম প্রকাশ হলে পরবর্তীতে তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রোষানলে পড়তে হয়। তারা নানাভাবে হয়রানি করে। ইচ্ছা করেই গ্যাস বন্ধ করে দেয়। মোটা অংকের টাকাও দাবি করে। তিনি বলেন, আমরা দেশে আছি না অন্য কোনো গ্রহে আছি, তা বুঝতে পারছি না। দেশে এমনিতেই বিনিয়োগ হচ্ছে না। নানান ধরনের ঝুঁকির কারণে বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছেন না নতুন বিনিয়োগকারীরা। তারপরও যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকে আছে সেগুলোও মেরে ফেলার অবস্থা হয়েছে। এ অবস্থার দ্রুত উন্নতি না হলে শীতের সময় কারখানা বন্ধ করে বসে থাকতে হবে। এতে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবেন এবং রফতানি আয় কমে যাবে।

গত দু’দিন গাজীপুরের বিভিন্ন কলকারখানা পরিদর্শন করে দেখা গেছে, কোনাবাড়ী শিল্প এলাকা, টঙ্গী, ভোগড়া, বোর্ডবাজার, সফিপুর এলাকায় শিল্প-কারখানাগুলোর শ্রমিকরা এখন গল্পগুজব করেই সময় কাটাচ্ছেন। গ্যাসের চাপ নেই, তাই মেশিনের চাকা ঘুরছে না।

গ্যাসনির্ভর ছোট-বড় কারখানাগুলো কার্যত একেকটি অনুৎপাদনশীল শ্বেতহস্তিতে পরিণত হয়েছে। উৎপাদন বন্ধ থাকায় লোকসান গুনতে হচ্ছে মালিকদের। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যারা কারখানা চালু করেছেন, তারা খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। উৎপাদনহীনতায় অর্ডার-সরবরাহ বিঘিœত হচ্ছে এবং বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এছাড়া উৎপাদন বন্ধ অথবা কমে যাওয়ায় শ্রমিকের মজুরিও কমে গেছে। যেসব কারখানায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়েছে সেগুলোয় উৎপাদন খরচ বেড়েছে, যার ফল হিসেবে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পণ্যের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। রফতানিমুখী পোশাক কারখানাগুলোকে বেশি মোকাবেলা করতে হচ্ছে এ সমস্যা।

এ বিষয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর মতিঝিলের চেম্বার ভবনে অনুষ্ঠিত মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভায় প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছিলেন, ২০১৮ সালে গ্যাসের সংকট থাকবে না। বছরের শুরুতে প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি হবে এবং বছরের মাঝামাঝি আরও ৫০ কোটি ঘনফুট আমদানি হবে। ফলে গ্যাসের সরবরাহ ৩৭ শতাংশ বাড়বে। এতে গ্যাসের সংকট থাকবে না। তবে গ্যাসের দাম বাড়বে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, যেখানে গ্যাস সরবরাহ বাড়ার কথা সেখানে দিন দিন কমে যাচ্ছে। গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিভিন্ন কারখানার উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উৎপাদনশীল শিল্প-কলকারখানা। সেই সঙ্গে বাসাবাড়িতে চুলায় আগুন জ্বলছে না। ফলে গাজীপুরে ঘরে-বাইরে সর্বত্র গ্যাসের হাহাকার চলছে।

তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারা বলেছেন, গ্যাস নিয়ে কথা বলতে তারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন প্রতিদিন।

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভোগড়া, ছয়দানা, বোর্ডবাজার, শরীফপুর, মোগড়খাল, কোনাবাড়ি, পারিজাত, বাইমাইল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গত ছয় মাস গ্যাস সংকটের যে চিত্র, তা এখনও রয়েছে। ভোগড়া এলাকার মোস্তফা মিয়া বলেন, গ্যাস সংকটে মাসের পর মাস এলাকাবাসী ভোগান্তিতে রয়েছেন।

গাজীপুরে অব্যাহত গ্যাস সংকটের ব্যাপারে সোমবার গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা আইনশৃংখলা কমিটির সভায় আলোচনা হয়। সভায় জেলায় সব ধরনে অবৈধ গ্যাস সংযোগ মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করতে অভিযান জোরদার করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ প্রদান করা হয়।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/10/11/162350