১১ অক্টোবর ২০১৭, বুধবার, ১১:০৩

শিল্প খাতে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণ

পুনঃতফসিল করা ঋণ আদায় না হওয়ায় আবার খেলাপি হচ্ছে

বেশির ভাগ শিল্পোদ্যোক্তা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না বা করছেন না। তারা শুধু ঋণ নবায়ন করতে চাচ্ছেন এমনকি ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই। এতে ব্যাংকগুলো পড়েছে বিপাকে। এক দিকে, উদ্যোক্তারা ঋণ পরিশোধ না করলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে চলছে। আর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় খেলাপি ঋণের বিপরীতে বর্ধিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে ব্যাংকের মুনাফা থেকে। অন্য দিকে ব্যাংকের আয়ও কমে গেছে। ব্যাংকের একটি উল্লেখযোগ্য আয় আসে আমদানি রফতানির এলসি কমিশন থেকে। কিন্তু আমদানি কমে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে ব্যাংকের আয় কমে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, শিল্প খাতে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। সর্বশেষ এ পরিসংখ্যান মতে, গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) শিল্প ঋণে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা, এর আগের অর্থবছরের (২০১৫-১৬) একই সময়ে যা ছিল প্রায় ২৫ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জুলাই-জুন সময়ে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ হয় প্রায় ২ লাখ ৬৪ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ বিতরণ বেড়ে হয়েছে ৩ লাখ ৬৭২ কোটি টাকা।
ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করাটা ব্যবসায়ীদের ইচ্ছাকৃত কারণে না কোনো যৌক্তিক কারণ আছে-এ প্রশ্ন করা হয়েছিল রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) প্রেসিডেন্ট আব্দুস সালাম মুর্শেদীর কাছে। তিনি গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ব্যবসায়ীরা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ করছেন না এটা একেবারেই ঠিক না। প্রকৃত বিষয় হলো, ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। আর এর অন্যতম কারণ হলো, ব্যবসায়ীরা দেশে-বিদেশে ব্যবসায় তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছেন। তারা এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সক্ষমতা অর্জন করতে পারছেন না। নানা কারণে এটা হচ্ছে। অন্যতম কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। কিন্তু এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সরকারের পক্ষ থেকে যে পরিমাণ সহযোগিতা পাওয়ার প্রয়োজন তা তারা পাচ্ছেন না। এ ছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদ এখনো ১২ শতাংশ বা এর ওপরে রয়েছে। ব্যাংকগুলো বলছে তারা ঋণের সুদহার কমিয়েছে। তা কমানো হয়েছে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদহার এখনো ১২ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এর বাইরে নানা সার্ভিস চার্জতো রয়েছেই। অপর দিকে, ডলারের বিপরীতে টাকা যেটুকু অবমূল্যায়িত হয়েছে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি অবমূল্যায়িত হয়েছে প্রতিযোগী দেশগুলোর নিজস্ব মুদ্রার সাথে। সব মিলেই ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে গেছে। আর এরই প্রভাব পড়ছে শিল্প খাতের খেলাপি ঋণের ওপর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিল্প খাতে মোট খেলাপির মধ্যে মেয়াদি শিল্প ঋণ খাতে খেলাপি ১৫ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা এবং চলতি মূলধন ঋণ খাতে খেলাপি হয়েছে ৯ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা।
শিল্প ঋণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি খেলাপি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণ। মোট খেলাপির ৪০ দশমিক ৪৫ শতাংশ হলো সরকারি ৬টি ব্যাংকের। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৪৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ, বিশেষায়িত ব্যাংকের ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং বিদেশী ব্যাংকগুলো শিল্প খাতে খেলাপি ঋণ ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে শিল্প খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২৭ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। এপ্রিল-জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খাতটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, উদ্যোক্তারা নানা অজুহাতে ঋণ পরিশোধ করছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে অনেক উদ্যোক্তা নাম মাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নবায়ন করছেন। কিন্তু ওই ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় আবার তা ঋণখেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। আবার কেউ কেউ ঋণখেলাপি ঠেকাতে উচ্চ আদালতে রিট করছেন। ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে ব্যাংকের আয় কমে যাচ্ছে। আয়ের ধারা ঠিক রাখতে অনেকেই প্রকৃত খেলাপি ঋণ আড়াল করে মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর চেষ্টা করছে। এটা ব্যাংকিং খাতের জন্য কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ নয়।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/259004