১০ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ২:০৪

বাংলাদেশে আসার পথে রোহিঙ্গাদের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে মগসেনারা

বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা

কামাল হোসেন আজাদ, কক্সবাজার: মিয়ানমারের আরাকান থেকে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আসার পথে রোহিঙ্গাদের ওপর মগ সৈন্যদের সাথে উগ্রপন্থীদের হামলা চালিয়ে সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। আরাকান রাজ্যে চলমান নিপীড়ন থেকে বাঁচতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের আসার পথে কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার এ পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। মগ সেনাদের সাথে হামলার ঘটনা জড়িত সেদেশের উগ্রপন্থী দল নাডালা বাহিনী।

একাধিক সূত্রে জানা যায়, রোববার মংডু টাউনশীপের লম্বাবিল, ওয়াসিল্লাপাড়া, মন্নাপাড়া থেকে কিছু রোহিঙ্গা পরিবার নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে আশ্রয়ে সন্ধাণে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। পথিমধ্যে বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্ত এলাকায় রাখাইনদের উগ্রপন্থী সশস্ত্র দল নাডালা বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবারগুলোর সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। এসময় তাদের কাছে থাকা নগদ টাকা এবং স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। মগ সেনা সদস্যদের সহযোগিতায় প্রতিনিয়িত এধরণের ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে সীমান্ত এলাকায়।
উল্লেখ্য, গত ২৪ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া মগ সেনার অত্যাচার থেকে বাঁচতে এ পর্যন্ত পাঁচ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। অন্যদিকে সীমান্ত এলাকায় আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ স্থলে মাইন পুঁতে রেখেছে বর্মী সেনাবাহিনী। এতে মাইন বিস্ফোরণে বেশ’কজন নিহতের ঘটনাও ঘটেছে।
মিয়ানমারের জেনারেলদের উপর নিষেধাজ্ঞার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ
মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর বীভৎস নির্যাতনের জন্য দেশটির উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের উপর শাস্তি হিসেবে নিষেধাজ্ঞার কথা চিন্তা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ওয়াশিংটন, ইয়াঙ্গুন ও ইউরোপে কূটনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, সেখানকার সেনাবাহিনীর প্রধানসহ শীর্ষ জেনারেলদের উপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে কথাবার্তা চলছে। রবিবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের শীর্ষ জেনারেলদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে ভাবা হচ্ছে। সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলস এ জন্য আরো কিছু সময় নিতে পারে। রাখাইনে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য সহায়তা বাড়ানোরও আলোচনা চলছে। রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন প্রসঙ্গে অং সান সু চির ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সোরগোল চলছে। এ নিয়ে সু চি চরম সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সু চি কি করতে পারতেন বা তার কি করা উচিত তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার মাঝে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচারে সেখানকার সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা যেন কিছুটা চাপা পরে যাচ্ছিলো। সু চি নির্বাচনে জিতলেও মিয়ানমারে এখনো বেশ প্রভাব রাখে দেশটির সেনাবাহিনী। দেশটির সংবিধানও সেনাবাহিনীর লেখা। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে তারা ক্ষমতায় ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ১৬ অক্টোবর মিয়ানমার প্রসঙ্গে বৈঠকে বসবেন। যদিও তারা মনে করছেন না খুব শিগগির নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে। নেদারল্যান্ডসের উন্নয়ন করপোরেশন বিষয়ক মন্ত্রী উলা টরনায়েস রয়টার্সকে বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর আরো চাপ প্রয়োগ করতে’ কোপেনহেগেন বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে আনার চেষ্টা করছে। মিয়ানমার নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের আলোচনা সম্পর্কে অবগত দুই মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াংসহ কয়েকজন জেনারেল এবং রোহিঙ্গাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার অভিযোগে রাখাইন বৌদ্ধ মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিবেচনা চলছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে তাদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সম্পদ জব্দ, যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষিদ্ধ এবং তাদের সঙ্গে আমেরিকানদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধসহ আরো কিছু বিষয় আসতে পারে। মার্কিন ওই দুই কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি নিয়ে ইউরোপ, জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে আলোচনার কারণে ওয়াশিংটন এ বিষয়ে সাবধানতার সঙ্গে এগোচ্ছে। ইয়াঙ্গুনে নিয়োজিত ইউরোপীয় এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো এই সঙ্কট নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। তারা এ বিষয়ে একমত যে সমস্যার মূলে সেনাবাহিনী, বিশেষত কমান্ডার ইন চিফ, যাকে যেকোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপে ‘টার্গেট’ করা দরকার। ইয়াঙ্গুনভিত্তিক কূটনীতিকেরা বলছেন, আলোচনার দ্বার খোলা রাখতে প্রথম পর্যায়ে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ প্রতীকী হতে পারে। তারা উদাহরণ টেনে বলেন, গত বছর ব্রাসেলস, বার্লিন ও ভিয়েনা সফর করা মিয়ানমার সেনাপ্রধানকে ইউরোপ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। গত এক মাসে রাখাইনের মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর পশ্চিমা নীতিনির্ধারকেরা এখন তাদের উপর কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চাপের মুখে রয়েছেন। মিয়ানমার বাহিনীর অবরোধের মুখে গত ২৪ আগস্ট মধ্যরাতের পর রোহিঙ্গা যোদ্ধারা অন্তত ২৫টি পুলিশ স্টেশনে হামলা ও একটি সেনাক্যাম্পে প্রবেশের চেষ্টা চালায়। এতে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। এরপর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। একের পর এক রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নির্বিচারে গুলী করে ও কুপিয়ে হত্যা এবং নারীদের গণধর্ষণের অভিযোগ উঠে। তাদের হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি বয়োবৃদ্ধ নারী এবং শিশুরাও। নিহত হয়েছেন প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা। প্রাণ বাঁচাতে স্রোতের বেগে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এর কার্যালয় জানায়, গত এক মাসে ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রয়টার্স, বিবিসি।
কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের কুতুপালং-এর শরণার্থী শিবিরে রাখার পরিকল্পনায় কলেরাসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেড়েছে। জাতিসংঘের আশঙ্কা, এই বিপুলসংখ্যক মানুষের একত্রিত বসবাসে কলেরার মতো রোগের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। গত মাসের শেষ সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোহিঙ্গা শিবিরে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। একই সময়ে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকির কথা জানায় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য কুতুপালংয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী ক্যাম্প তৈরির পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ সরকার। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া জানান, সব রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পে অস্থায়ীভাবে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে অন্যান্য সব ক্যাম্প বন্ধ করে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। তবে শনিবার ঢাকায় রবার্ট ওয়াটকিনস রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রসঙ্গে বলেন, ‘যখন বিপুল সংখ্যক মানুষ একটি সুনির্দিষ্ট সংকীর্ণ স্থানে থাকবে, আর সেই মানুষগুলো যদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে, তাহলে তাকে বিপদজনক বলতেই হবে।’ একটি মাত্র শিবিরে সবাইকে না রেখে বিভিন্ন স্থানে একাধিক শিবিরে শরণার্থীদের রাখা হলে তাদেরকে সামাল দেয়া, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি মোকাবেলা সহজ হবে বলে মনে করেন রবার্ট ওয়াটকিনস।
২৫ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্টে বিদ্রোহীদের হামলার পর ক্লিয়ারেন্স অপারেশন জোরদার করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ওই সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৫ লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পূর্বের চার লাখের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সবমিলে প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের আশ্রয়ে ১২০০ হেক্টর জায়গা ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সেখানে গড়ে তোলা হবে মেগাক্যাম্প। এজন্য আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থারও সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তবে রবার্ট মনে করেন, এত বিপুল সংখ্যক মানুষ বসবাসের ক্ষেত্রে রোগের ঝুঁকি খুবই বেশি। বার্তা সংস্থা এএফপিকে রবার্ট বলেন, ‘একস্থানে মাত্রাতিরিক্ত মানুষ বসবাসের ফলে নানা ধরনের সংক্রামক রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।’
২৮ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের সবগুলো ক্যাম্পে করা এক পরীক্ষার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, কলেরা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। আর এর সম্ভাবনা খুবই বেশি। পরীক্ষায় প্রাপ্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন তৈরি করা আবাসগুলো বসবাসের উপযুক্ত নয়। ইউনিসেফ থেকে জানানো হয়, খুব শিগগিরই ৯ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা তাদের।
ত্রাণ সংস্থাগুলোর জানায়, ডায়রিয়ার ব্যাপারে তাদের কাছে খুব বেশি তথ্য নেই। তবে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মতে, ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। নতুন করে ক্যাম্প তৈরিতে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও বাড়ছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর মুখপাত্র অ্যান্দ্রে মাহেসিস বলেন, ‘বাংলাদেশে খুব তাড়াতাড়ি কলেরা ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। হাজার হাজার মানুষ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করায় এই আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির রয়েছে উগান্ডা ও কেনিয়াতে। দুই ক্যাম্পেই প্রায় ৩ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের পরিকল্পনা সফল হলে আট লাখের মতো শরণার্থী থাকবে আশ্রয়কেন্দ্রে।

 

http://www.dailysangram.com/post/302915-