১০ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১:৫৩

বাড়ছে মানসিক রোগী

রোখসানাকে তিন-চার জন জোরপূর্বক ধরে বসিয়ে রেখেছেন হাসপাতালের টেবিলে। তার পাশ দিয়ে কেউ একজন গেলেই ঝাঁপটা মেরে ধরতে চান। ২২ বছরের এই তরুণী গত প্রায় ছয় মাস ধরে মানসিক রোগে ভুগছেন। তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে তার পরিবার। সেপ্টেম্বর মাসে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক রোগ বিভাগে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন স্বজনরা। থাকেন কামরাঙ্গীর চর এলাকায়। রোগীর ভাই জানান, হঠাৎ করে তার বোন নিজে নিজে আবল-তাবল বলতে থাকে। কাউকে দেখলেই ঝাঁপটা মেরে ধরতে চায়। এজন্য চিকিৎসকের কাছে নিয়ে এসেছেন তারা। আরেক রোগী বিল্লাল হোসেন। বয়স ৩২। এক মাস ধরে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। সবাইকে গালমন্দ করছেন। হাতের কাছে যাকেই পাচ্ছেন মারধর করছেন বা জিনিসপত্র ভাঙচুর করছেন। তার তিন-চার আত্মীয় তাকে জোরপূর্বক ধরে চিকিৎসার জন্য রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়ে আসেন। হাসপাতালটির বহির্বিভাগে কথা হয় তার স্ত্রী সঙ্গে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তার স্বামীর মাথায় সমস্যা। কাউকে চিনতে পারছে না। যাকে তাকে গালিগালাজ করে। এজন্য চিকিৎসকের কাছে নিয়ে এসেছি। রোখসানা বা বিল্লাহ নন, দেশে প্রতি বছরই মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে এই চিত্র পাওয়া যায়। দেশে পূর্ণবয়স্কদের অর্থাৎ আঠারো বছরে ওপরে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ আর শিশু-কিশোরদের ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ মানসিক রোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় দেশব্যাপী ২০০৩-০৫ সালে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। ২০০৬ সালে পূর্ণবয়স্কদের ওপর এবং ২০০৯ সালে শিশু-কিশোরদের ওপর চালানো দুটি গবেষণার ফলে এই চিত্র ওঠে আসে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৬ সালে প্রকাশিত হেলথ বুলেটিনের পরিসংখ্যানের মতে, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ২০১৫ সালে বহির্বিভাগ দিয়ে সেবা নিয়েছেন ৪২ হাজার ৭০৩ জন রোগী, ভর্তি হন ৩ হাজার ৮৫, জরুরি সেবা নিয়েছেন ২ হাজার ৫০১ জন রোগী। ২০১৪ সালে বহির্বিভাগ দিয়ে সেবা নিয়েছিল ৩৫ হাজার ১৪ জন, ভর্তি ছিল ৩ হাজার ১২০ জন আর জরুরি সেবা গ্রহণকারী সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩৪৫ জন। ২০১৩ সালে ২৪ হাজার ৯৭৬ জন বহির্বিভাগ দিয়ে সেবা গ্রহণ করেন। ভর্তি ছিলেন ২ হাজার ১৪০ জন আর জরুরি সেবা নিয়েছিল ২ হাজার ১০৩ জন রোগী। ২০১২ সালে ২৩ হাজার ৮৯৮ জন বহির্বিভাগ দিয়ে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেছিল। ভর্তি হয় এক হাজার ৯২৮ জন আর জরুরি সেবা গ্রহণকারী এক হাজার ৮২৩ জন। ২০১১ সালে বহির্বিভাগ দিয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ২৩ হাজার ৩৮৮ জন, ভর্তি হয় এক হাজার ৭৭২ জন আর জরুরি সেবা নেয় এক হাজার ৬১১ জন নারী, পুরুষ ও শিশু রোগী। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানসিক রোগীরা আমাদের আপনজন। তারা বিপজ্জনক নয়। এই রোগগুলোর বৈজ্ঞানিক ও ফলপ্রসূ চিকিৎসা রয়েছে। রোগীদের রয়েছে চিকিৎসা পাবার অধিকার। আমাদের সমাজে মানসিক রোগীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়। সমাজ মানসিক রোগীদের অনেক সময় সহজভাবে নিতে পারে না। মানুষ মানসিক রোগীদের বলে ‘পাগল’। মানসিক রোগীদের পাগল বলা সামাজিক অপরাধ। সমাজ মানসিক রোগীদের নিয়ে নানা ধরনের কৌতুক করে। কারো মানসিক রোগ হলে তার কথা কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেয় না। মুহূর্তে মানুষ হিসেবে তার দাম কমে যায়। সে বা তিনি উত্তরাধিকার থেকেও অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়ে যান। তাকে পরিবারের কোনো সুস্থ সদস্যের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। সেই আত্মীয়ই তার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ তত্ত্বাবধান করে। অনেক সময় ওই আত্মীয় রোগীকে অবহেলা করে। তার যত্ন ও চিকিৎসা বিঘ্নিত হয়। তারা বলেন, যখন পরিবারের কারো মানসিক রোগ হয় তখন গোটা পরিবারই ভয় পেয়ে যায়। তারা কিছুতেই স্বীকার করতে রাজি হয় না যে তাদেরই একজন মানসিক রোগী। যে পরিবারে মানসিক রোগ আছে তাদের বিয়ে হতে সমস্যা হয়। মানুষ ভাবে- ‘ওর ভাই একটা পাগল। ও-ও পাগল হয়ে যাবে। ওর ছেলেপুলেও পাগল হবে। তাই এখানে বিয়ে না করাই ভালো।’ বয়স হলে হয়তো মানসিক রোগীদের বিয়ে করার ইচ্ছা হয়। এদিকে জেনেশুনে কেউ মানসিক রোগীকে বিয়ে করবে না। সবাই ভয় পায়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাইকোথেরাপি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল এ প্রসঙ্গে বলেন, মানসিক রোগ মানেই লজ্জার কোনো কারণ নয়। মানসিক রোগ শারীরিক রোগের মতোই অসুস্থতা। সব মানসিক রোগেরই বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা সম্ভব। বর্তমানে অনেক উন্নত ও কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর সুষ্ঠু ব্যবহারে রোগও পুরোপুরি সেরে যাচ্ছে। রোগীরা কর্মক্ষম থাকতে পারছে। কোনো কোনো রোগীকে দীর্ঘদিন ওষুধ খেতে হয়, যেমনটি খেতে হয় অনেক শারীরিক রোগীরও, যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ইত্যাদি রোগে প্রায় সারা জীবনই ওষুধ গ্রহণ করে যেতে হয়। আবার অধিকাংশ মানসিক রোগীকেই দীর্ঘদিন ওষুধ খেতে হয় না। মানসিক চিকিৎসাসেবার মান এমনিভাবে নানা আঙ্গিক থেকে সফলতার দিকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মনোচিকিৎসার পদ্ধতিগুলোও অনেক উন্নততর হয়েছে। বর্তমান সরকারও অটিজমসহ অন্যান্য মানসিক সমস্যা এবং চিকিৎসার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, মানসিক রোগীরা প্রায়ই অপচিকিৎসার শিকার হয়। তথাকথিত কবিরাজ ও ফকিররা তাদের মেরে, পিটিয়ে, পানিতে ডুবিয়ে, নানাভাবে অত্যাচার করে। তাবিজ-কবচ ও পানি পড়ায় কাজ তো হয়ই না, শুধু বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা নিতে দেরি হয়ে যায়। ফলে রোগ ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং চিকিৎসা দেয়া জটিল হয়ে উঠে। অনেক সময় রোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। তাকে বাড়িতে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। তাকে জীব-জন্তুর মতো ছোট্ট কোনো ঘরে আটকে রেখে জন্তুর মতোই অবহেলায় খাবার খেতে দেয়া হয়। তাকে কেউ ডাকে না, সামাজিক অনুষ্ঠানে নেয় না, তার সঙ্গে গল্প করে না। তার ছোটরাও তাকে আর সম্মান করে না। গবেষণায় দেখা গেছে, ৬২ দশমিক ৩৭ শতাংশ রোগীর যত্নগ্রহণকারী রোগীদের চিকিৎসার জন্য কবিরাজ ও ঝাড়ফুঁককারীদের কাছে নিয়ে যায়। মানসিক রোগ বিষয়ে অনেক ধরনের ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। মানসিক রোগের সঠিক চিকিৎসা হলো ধর্মীয়, কবিরাজি, ইউনানী, হেকিমী ও হোমিও চিকিৎসা।
চিকিৎসকরা বলেন, একজন মানসিক রোগীকে সুস্থভাবে জীবনযাপন করাতে তার মর্যাদা সমুন্নত করতে হবে। কারণ সে-ও সমাজেরই অংশ। তাদের জবরদস্তি করা চলবে না। তাদের মানুষ হিসেবে পূর্ণ মর্যাদা দিতে হবে। তাদের উত্তরাধিকার বঞ্চিত করা যাবে না। মানসিক রোগের কারণে কাউকে চাকরি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেয়া যাবে না। তাদের পরিবার গঠন করার অধিকার আছে। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে।
দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সুবিধা: দেশে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল একটি। এতে রয়েছে ২০০ শয্যা। পাবনা মানসিক হাসপাতালে ৫০০ শয্যা, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তঃবিভাগ ৪০টি (৮১৩ শয্যা), শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তঃবিভাগ একটি (২০ শয্যা), সাইকিয়াট্রিক চাইল্ড গাইডেন্স ক্লিনিক ২টি, ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিক বিষয়ে শয্যা ১০টি, মাদকাসক্তি বিষয়ক চিকিৎসা কেন্দ্র সরকারি ৪টি ও বেসরকারি ১৬৪টি। মানসিক রোগীদের সেবা দেবার মতো দক্ষ জনবল খুবই সীমিত। দেশে মানসিক রোগের ডাক্তার রয়েছে দু’শর কিছু বেশি, যা প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার জন্য রয়েছে শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট রয়েছেন ৫০ জন। দেশে সাইকিয়াট্রিক নার্সিং বা সাইকিয়াট্রিক সোস্যাল ওয়ার্কের ওপর কোনো প্রশিক্ষণ কোর্স নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লিনিক্যাল সোস্যাল ওয়ার্ক নামে একটি কোর্স চালু হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। এই পরিস্থিতিতে আজ অন্যান্যা দেশের মতো দেশে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হচ্ছে। দিবস উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এবারের এ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য’।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=86755&cat=3/