১০ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১:৫০

পদে পদে অনিয়ম বিনিয়োগ বোর্ডের ভবন নির্মাণে

‘বিনিয়োগ বোর্ডের’ ভবন নির্মাণ নিয়ে ছয় বছর ধরে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। রাজধানীর মতিঝিলে ভাড়ায় চলা বিনিয়োগ বোর্ডের জন্য আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসের পাশে ১৪ তলা একটি ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০১১ সালে। ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবনটির নির্মাণকাজ ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেড (পিবিএল)। কিন্তু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ তথ্য বলছে, ছয় বছর পার হতে চললেও প্রকল্পের মাত্র অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে, তা কেউ বলতে পারছে না। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হলেও প্রকল্পের ব্যয় এরই মধ্যে ১২৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় আরো বাড়ানো হতে পারে বলেও আভাস মিলেছে।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের কাজে এমন স্থবিরতার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেল পদে পদে অনিয়ম আর অদক্ষতার তথ্য। নকশা পরিবর্তনের নামে, মাটি দেবে দুর্ঘটনার নামে এবং শ্রমিকদের বেতন-ভাতা না দেওয়ার কারণে প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল বেশ কয়েকবার। এখন পর্যন্ত যতটুকু কাজ হয়েছে তার গুণগত মান নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও কর্মকর্তাদের। তাঁদের অভিযোগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিবিএল মূল নকশার আলোকে ভবন নির্মাণের কাজ করছে না।
প্রতি তলায় কনফারেন্স রুম, স্টোর রুম করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এ ছাড়া যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের। এ ধরনের সুউচ্চ ভবন নির্মাণে যে ধরনের অভিজ্ঞতা লাগে, তা নেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের।
২০১১ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় যখন প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়, তখন সিদ্ধান্ত ছিল ভবন হবে ১৪ তলা, উচ্চতা হবে ১৮০ ফুট। অনুমোদনের এক বছর পর বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, নিরাপত্তাজনিত কারণে ভবনটি ১২ তলার বেশি করা যাবে না। উচ্চতা থাকতে হবে ১৫০ ফুটের মধ্যে। এরপর নতুন করে ১২ তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রকল্পটি ২০১১ সালে অনুমোদনের সময় নাম ছিল ‘১৪ তলাবিশিষ্ট বিনিয়োগ বোর্ডের জন্য ভবন নির্মাণ’ প্রকল্প। কিন্তু বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারীকরণ কমিশন একীভূত হয়ে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) নামে যাত্রা শুরু করে। এক বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের নাম সংশোধন করা হয়নি।
বিডার প্রথম নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম দায়িত্ব পাওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন ভবনটি পুরনো মডেলের—এমন অজুহাত তুলে। মালয়েশিয়া ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (মাইডা) ভবনের আদলে ভবনটি মার্বেল পাথরের অত্যাধুনিকভাবে নির্মাণ করতে একটি নতুন নকশা অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠান বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, নতুন নকশায় নয়; পুরনো নকশায় চলবে ভবনের কাজ। প্রকল্প প্রস্তাবে নির্দেশ ছিল, এই প্রকল্পে যিনি প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁকে প্রেষণে পূর্ণকালীন নিয়োগ দিতে হবে। পিডিকে হতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ। কিন্তু যাঁকে পিডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ নন বলে জানা গেছে। এ পর্যন্ত তিন দফা বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যেও প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিডার কর্মকর্তারা।
বিনিয়োগ বোর্ডের ভবনের কাজের গুণগত মান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এসডিজি বাস্তবায়ন বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদও। সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে তিনি ভবন নির্মাণকাজের মন্থর গতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঠিকাদারটা ভালো পড়েনি। এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তা ছাড়া নকশা পরিবর্তন হবে কি হবে না তা নিয়ে কিছুটা সময় গেছে। আর গ্রাউন্ডের কাজ করতে সমস্যা হয়েছিল। এসব কারণে প্রকল্পের কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। তবে আশা করছি এবার কাজে গতি আসবে। ’
বিডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে নব্বইয়ের দশকে গঠিত বিনিয়োগ বোর্ড এত দিন রাজধানীর দিলকুশায় ভাড়া অফিসে চলত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে বিনিয়োগ বোর্ডের অফিস নিজস্ব ভবনে থাকবে—এমন যুক্তি দেখিয়ে ২০১১ সালে আগারগাঁওয়ে ১৪ তলাবিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। নতুন ভবনটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে আকর্ষণীয় করে তোলা ছিল উদ্দেশ্য। ২০১৪ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বারবার ডেকে তাগিদ দেওয়া হলেও কাজে গতি আসছে না। গত আগস্টে নতুন ভবনের তিনটি ফ্লোরে বিলুপ্ত বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারীকরণ কমিশনের কর্মকর্তাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিডার কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের ভবন নির্মাণের অভিজ্ঞতা নেই। এমনকি শ্রমিকদের বেতনও দিতে পারে না প্রতিষ্ঠানটি। সে কারণে এত দেরি হচ্ছে। সরেজমিন ঘুরে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কর্মকর্তাদের রুমে যেসব এসি বসানো হয়েছে, সেগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ভবনে যে লিফট বসানো হয়েছে সেটি পুরনো মডেলের। বেসিন, কমোড, ইট, রড, বালু—সব নিম্নমানের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, নকশা অনুযায়ী প্রতিটি ফ্লোরে একটি করে কনফারেন্স রুম হওয়ার কথা ছিল। এ ছাড়া নব্বই সাল থেকে তৈরি করা সব ফাইল রাখার জন্য প্রতি ফ্লোরে স্টোর রুম তৈরি করার কথা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, নকশার আলোকে কিছুই হয়নি। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের পাশে একই সময়ে নির্বাচন কমিশন ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। তাদের ভবনের কাজ শেষ হয়ে গেছে। তাদের ভবন হয়েছিল ঢালাইয়ের। আর আমাদেরটা হচ্ছে ইটের। দেখতেও খারাপ লাগছে। ’
প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার আহমদ উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পের কাজ শুরু করতে কিছু সমস্যা হয়েছিল। একবার মাটি দেবে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তবে এখন আর কোনো সমস্যা নেই। প্রকল্পে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এসব অনুমাননির্ভর কথা। অভিযোগ সত্য নয়। কর্মকর্তাদের বসার জন্য প্রাথমিকভাবে আমরা তিনটি ফ্লোর ঠিক করে দিয়েছি। পুরো ভবন নির্মাণ করার সময় সব ঠিক করে দেওয়া হবে। ’ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো প্রসঙ্গে আহমদ উল্লাহ বলেন, ‘ভবনটি অত্যাধুনিকভাবে নির্মাণ হবে এবং নকশায় পরিবর্তন আনা হবে বলে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আমাদেরকে কাজ বন্ধ রাখতে বলেছিলেন। সে কারণে বেশ কিছু সময় প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। আর কর্মকর্তাদের প্রাথমিকভাবে বসার জন্য তিনটি ফ্লোরের ব্যবস্থা করেছি। এটা প্রাথমিক। পরে সব ঠিক করে দেব। ’
প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জানা গেছে, প্রকল্পটি যখন প্রথম অনুমোদন দেওয়া হয় তখন লিফট, বিভিন্ন সেবা সংযোগসহ ইলেকট্রিকের বিষয়গুলোর জন্য ব্যয় ধরা হয়নি। পরে নতুন করে সেসব খরচ ধরার কারণে ব্যয় বেড়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলছে, এটা তাদের দোষে নয়, কর্মকর্তাদের দোষে। এ ধরনের প্রকল্পে লিফট, সেবা সংযোগ এসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যোগ করা হয়নি। তা ছাড়া প্রকল্পটি নেওয়ার সময় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। আগে থেকে এসব প্রস্তুতি নেওয়া থাকলে এত সমস্যায় পড়তে হতো না।
প্রকল্প পরিচালক আবু সাঈদ মোহাম্মদ খুরশিদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, বিনিয়োগ বোর্ডের নাম এখনো পরিবর্তন হয়নি, এটা ঠিক। তবে নাম সংশোধন করা হবে শিগগিরই। তিনি বলেন, প্রকল্পে নতুন কিছু আইটেম যোগ হওয়ার কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। এই ব্যয় আরো বাড়তে পারে। ভবন নির্মাণের অনিয়ম সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। অফিসে এলে আপনাকে বিস্তারিত বলতে পারব। ’
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পের শুরুতে কিছুটা সমস্যা ছিল। সেগুলো কেটে গেছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/10/10/551936