১০ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১:৪৯

অর্ধেকই বেহাত চট্টগ্রামে

চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলীতে ঐতিহ্যবাহী ভেলুয়ার দীঘির পশ্চিমপাড়ের একটি ওয়াক্ফ এস্টেট। প্রয়াত এবাদুল্লাহ সওদাগরের বাড়িসংলঘ্ন তার নামের এই এস্টেটের জায়গা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে একটি বাণিজ্যিক আবাসন কোম্পানি ৯ তলা অ্যাপার্টমেন্ট ভবন তুলছে। এলাকাবাসীর প্রতিবাদ ও পরে আদালতের নিষেধাজ্ঞায় তিন তলা পর্যন্ত উঠে ভবনের নির্মাণকাজ থমকে আছে।

এ রকম ওয়াক্ফ এস্টেটের জায়গা-জমি বেপরোয়া দখল করে নিয়ে ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিকভাবে ভোগের অনেক ঘটনা ও তথ্যের হদিস পাওয়া যায়। চান্দগাঁওতে আমির হোসেন মিস্ত্রি ওয়াক্ফ এস্টেটের জায়গা দখল করে বহুতল ভবন তোলা হচ্ছে। এতে পুলিশ ও ভূমি অফিসের সহযোগিতার অভিযোগ আছে। ফিরিঙ্গিবাজারে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ইজারা দেওয়া জমিতে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির বিরাট মাছের আড়ত নির্মাণ করা নিয়ে আজিজউল্লাহ ওয়াক্ফ এস্টেটের সঙ্গে বিরোধ মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। এক দফা হেরেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। জেলার চন্দনাইশে ওয়াক্ফ এস্টেটের মসজিদের চাঁদাও ভাগবাটোয়ারা হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মুসলমানদের দানকরা সম্পদের আয় ধর্মীয় ও জনসেবামূলক খাতে ব্যবহারের কথা থাকলেও সমকালের অনুসন্ধানে বিভিন্ন সূত্রে এই অবিশ্বাস্য তথ্য পাওয়া গেছ যে, পুরো চট্টগ্রাম বিভাগের এগারোটি জেলায় ওয়াক্ফকৃত মোট ১২ হাজার ৮৬৬ একর ভূ-সম্পত্তির অর্ধেকেরও বেশি বেহাত হয়ে আছে। এর আয়তন ৬ হাজার ৬৮৩ একর।

বিভিন্ন ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতোয়ালিরা জানান, সম্পত্তি বেদখল করে প্রভাবশালী ও প্রতারকরা এবং যোগসাজশ থাকে স্থানীয় পুলিশ ও ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। জাল দলিলপত্র বানিয়ে দখল নেওয়া ও পরে বিক্রির অভিযোগ পাওয়া যায়।

বহুতল আবাসিক ভবন : ভেলুয়ার দীঘির পাড়ে এবাদুল্লাহ সওদাগর ওয়াক্ফ এস্টেটের জায়গায় 'গ্রীন লিফ লেকভিউ পার্ক' নামের বহুতল আবাসিক ভবনটি নির্মাণ করছে গ্রীন লিফ প্রপার্টিজ ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি। নির্মাণাধীন ভবনের সামনের পরিচিতি ফলকে লেখা বিবরণ অনুযায়ী প্রতিটি ফ্লোরে পাঁচটি করে মোট ৪৫টি ফ্ল্যাট হবে এ ভবনে। সেখানে চারটি ফোন নম্বর দেওয়া থাকলেও সে সবে ফোন করে কাউকে পাওয়া যায় না। পাশে নিরাপত্তারক্ষীর একটি ঘর থাকলেও সেখানে লোক নেই।

নিকটস্থ দোকানি আবদুর রহমান এলাকাবাসীর বাধা দানে ওয়াক্ফ সম্পত্তির ওপর তিন তলা ওঠার পর ভবনের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া ও আদালতের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার তথ্য জানান।

এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে প্রতিবাদের পর্যায়ে সংবাদ সম্মেলনও করা হয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দা আফরোজা ইয়াছিন জানান, ওয়াক্ফ এস্টেটের জায়গায় অবৈধভাবে বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণের বিষয়টি অবহিত করে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার ও জেলা প্রশাসককেও স্ট্মারকলিপি দেওয়া হয়। এরপর থেকে বন্ধ আছে নয়তলা এ ভবনের কাজ।

বন্দর বনাম ওয়াক্ফ এস্টেট : ফিরিঙ্গিবাজারে আজিজউল্লাহ ওয়াক্ফ এস্টেটের ৭৬০ শতক জায়গায় বন্দর কর্তৃপক্ষ মৎস্য আড়ত তৈরি করেছে বলে অভিযোগ আছে। গত ১৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলন ডেকে এস্টেটের কার্যকারক গাজী মোহাম্মদ আজিজউল্লাহ দাবি করেন, ফিশারি ঘাটে পুরনো মৎস্য আড়ত সরিয়ে যে স্থানে নতুন মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র করা হয়েছে, সেই ভূমি আজিজউল্লাহ ওয়াক্ফ এস্টেটের। ১৯৩২ সালের ৩৩৩৮ নম্বর দলিল মূলে বাকলিয়ার আজিজউল্লাহ সওদাগর ও সালেহ আহমদ 'নব নূর মসজিদের' নামে এসব সম্পত্তি ওয়াক্ফ করেছিলেন। পরে এটি নদীতে বিলীন হলেও ১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে এখানে চর জেগে ওঠে। এরপর এ ভূমি নিজেদের দাবি করে বন্দর কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডকে আড়তের জন্য ইজারা দেয়। এখানে শতাধিক কক্ষের আড়ত তোলা হয়েছে। প্রতিটি কক্ষ ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে বেচাকেনা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বন্দর সচিব ওমর ফারুক সমকালকে বলেন, 'কর্ণফুলী নদীর হাই ওয়াটার মার্ক অর্থাৎ ১৫০ ফুট পর্যন্ত বন্দর কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারাধীন। নদীতে চলাচল করা নৌযান ও ট্রলারের নিরাপদ নোঙরের জন্য মৎস্যবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে জায়গাটি লিজ দিয়েছি আমরা।' তিনি জানান, জায়গার মালিকানা, কর্ণফুলী নদীশাসন, নদী খনন, নদী সংরক্ষণ, নদীতীর রক্ষণাবেক্ষণ ও বন্দর অবকাঠামো নির্মাণ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতাভুক্ত।

ওয়াক্ফ এস্টেটের মালিকানা-সংক্রান্ত আদালতের রায় থাকার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, 'আমাদের আইন অনুযায়ী ভূমির প্রকৃত মালিক আমরা। আদালত যদি তারপরও ভিন্ন কোনো রায় দেন তবে আমরাও আইনের আশ্রয় নেব।'

অর্ধেকই বেদখল : চট্টগ্রাম বিভাগে অর্ধেকের বেশি ওয়াক্ফ ভূ-সম্পত্তি বেহাত হওয়ার যে তথ্য পাওয়া গেছে তার অন্তর্ভুক্ত আছে নগরের হাজী চাঁদ মিয়া সওদাগর ওয়াক্ফ এস্টেটের ১৬৪ একর, কক্সবাজারের মাওলানা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ওয়াক্ফ এস্টেটের ১২০, বাহালী জিম্মাছগির শাহ ওয়াক্ফ এস্টেটের ১ হাজার ১০১, হযরত পীর কল্লা শাহ ওয়াক্ফ এস্টেটের ১৫৮, নোয়াখালীর জৈধর মিয়া ওয়াক্ফ এস্টেটের ১২, আজগর আলী ভুঁইয়া ওয়াক্ফ এস্টেটের ১১ দশমিক ৮৮, লক্ষ্ণীপুরের আলহাজ শেখ কমরউদ্দিন ওয়াক্ফ এস্টেটের ৫ হাজার ১০২ ও রওনীবানু ওয়াক্ফ এস্টেটের ৮ একর জমি।

ওয়াক্ফ সম্পত্তি নিয়ে নানা অভিযোগ ও স্বার্থসংশ্নিষ্টদের বিরোধ এক সাধারণ ঘটনা। চন্দনাইশের বরমা ইউনিয়নের পশ্চিম বাইনজুরীর আবিদুর রহমান চৌধুরী ওয়াক্ফ এস্টেট জামে মসজিদের জমাকৃত অর্থ ও সম্পত্তি স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল অবৈধ দখলের পাঁয়তারা করছে বলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে স্ট্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এ ব্যাপারে চন্দনাইশ থানায় গত ৩ মে অভিযোগও দাখিল করেন মসজিদের মোতোয়ালি নাসির উদ্দিন মাহমুদ চৌধুরী।

রিয়াজুদ্দিন বাজারের রিয়াজউদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী বিএল ওয়াক্ফ এস্টেটের কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি রাতের আঁধারে দখল করে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ দলীয় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ইন্ধনে নোয়াব আলী, আবুল কাসেম, নবী হোসেনসহ একটি গোষ্ঠী এ দখল কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে থানায়ও অভিযোগ করেছেন এস্টেটের মোতোয়ালি শেখ সামশুদ্দিন আহমেদ সিদ্দিকী।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : ওয়াক্ফ প্রশাসকের চট্টগ্রাম দপ্তরে পরিদর্শকের ঊর্ধ্বতন পদে কেউ নেই। ওয়াক্ফ সম্পদ নিয়ে সার্বিক প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দেলোয়ার হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, 'ওয়াক্ফ এস্টেটের সম্পত্তি তত্ত্বাবধানের জন্য আলাদা প্রশাসন রয়েছে। আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ এলে আমরা তা সেই প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করি।'

ওয়াক্ফ এস্টেটের পরিদর্শক ফরিদ আহমেদ বলেন, 'চট্টগ্রামের কাজ তদারকি করতে ঢাকায় দুজন সহকারী প্রশাসক নিযুক্ত আছেন। কোনো অভিযোগ পেলে প্রাথমিকভাবে তা তাদের অবহিত করা হয়। উনাদের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কোনো কোনো অভিযোগের তদন্ত করি। শুনানিতে অংশ নিই। প্রয়োজনে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করি। এ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত না হলে তা গড়ায় মামলাতে।'

পরিদর্শকরা জানান, প্রয়োজনের অর্ধেক জনবলও নেই এ দপ্তরে। মাত্র ৪ জন পরিদর্শক দিয়ে কাজ চলছে চট্টগ্রাম জেলার। বিভাগের কয়েকটি জেলায় নেই পরিদর্শকও।

ফরিদ আহমেদ বলেন, 'জনবল পর্যাপ্ত থাকলে অভিযান পরিচালনা করা সহজ হতো। তখন বেদখলকৃত জায়গা উদ্ধারেও গতি বাড়ত অনেক।' গত এক বছরে চট্টগ্রাম বিভাগে দখল কিংবা অভিযোগ নিষ্পত্তির কোনো পরিসংখ্যান অবশ্য দিতে পারেননি পরিদর্শকরা।

হাজি আমির হোসেন মিস্ত্রি ওয়াক্ফ এস্টেটের সম্পত্তি দখলে পুলিশের সহায়তা করার অভিযোগ প্রসঙ্গে চান্দগাঁও থানার ওসি আবুল বশরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, '২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আমি নই, এ থানার ওসি ছিলেন সৈয়দ আবদুর রউফ। তাই এ ব্যাপারে আমি এখন কোনো মন্তব্য করতে চাই না।'

 

http://www.samakal.com/whole-country/article/1710577/