১০ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১:৪৮

নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হারাচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হারাচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট সদস্য, বোর্ড অব ট্রাস্টি সদস্য, শিক্ষক নিয়োগ কমিটি, অর্থ কমিটি এবং শিক্ষার্থী ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিনিধি ও অনুমোদন বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ সংশোধন করে এসব বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব রেখেছে জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় সাব-কমিটি।

বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বিদ্যমান আইন সংশোধনের পক্ষে মত দিলেও এ প্রস্তাবগুলোর কঠোর সমালোচনা করেছেন। সমকালকে তিনি বলেন, একতরফাভাবে চাপিয়ে দেওয়া এসব শর্ত বাস্তবায়ন করলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বকীয়তা নষ্ট হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো তাহলে সরকারি হয়ে যাবে।

তবে আইন সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত সংসদীয় সাব-কমিটির আহ্বায়ক মো. আবদুল কুদ্দুস বলেন, 'শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার চেষ্টায় এসব প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুরোধেই এ কমিটি
গঠন করা হয়েছিল। সাব-কমিটির সুপারিশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য প্রস্তাবগুলোই সন্নিবেশ করা হয়েছে।' কমিটি মোট পাঁচটি বৈঠকে এসব প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ডা. আফসারুল আমিন বলেন, গত রোববারের বৈঠকে সাব-কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে কমিটি আলোচনা করেছে। পরের বৈঠকে বেসরকারি বিশ্বদ্যিালয় সমিতিকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

দুই বছরেরও বেশি সময় আগে তিন মাসের সময় দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনে একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আবদুল কুদ্দুস এমপিকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি, ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, ইউজিসির একজন সদস্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব।

সাব-কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ২১ ও সর্বনিল্ফম্ন ৯ সদস্যের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষাবিদ থাকতে হবে। ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া সেখানে কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যাবে না। প্রয়োজনে এই বোর্ডে কমিশন সাময়িকভাবে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করতে পারবে। বিদ্যমান আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের নিজস্ব বা ভাড়া করা ভবনের স্থলে ৫০ হাজার বর্গফুট আয়তনের ভবনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নির্মীয়মান কোনো ভবন গ্রহণযোগ্য হবে না।

প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে রিজার্ভ ফান্ডের অঙ্ক বাড়ানো না হলেও এই অর্থ উত্তোলন বা স্থানান্তরে কমিশনের অনুমতি বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে এ প্রস্তাবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মেয়াদ দুই বছর ও যৌন হয়রানি ও যৌন নিপীড়ন রোধে কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। একজন অধ্যাপককে (যথাসম্ভব নারী) এই কমিটির প্রধান করতে বলা হয়েছে।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যলয় সিন্ডিকেট সদস্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সরকার মনোনীত একজন সদস্যের পরিবর্তে ইউজিসির দু'জন সদস্য রাখতে হবে। অর্থ কমিটিতে ভিসি মনোনীত একজন সদস্যের স্থলে কমিশন মনোনীত একজন সদস্য এবং শিক্ষক নিয়োগ কমিটিতে উপাচার্য ছাড়াও কমিশন মনোনীত একজন শিক্ষাবিদ রাখতে হবে। উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষা জীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় শ্রেণি অগ্রহণযোগ্য হবে। শিক্ষার্থী ফি নির্ধারণ ও বিভিন্ন খাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ের কমিশনের অনুমোদন হতে হবে বাধ্যতামূলক। শিক্ষার্থী ফি কাঠামো চূড়ান্ত করতে অবশ্যই ইউজিসির অনুমোদন নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য সরকারি প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা থাকতে হবে।

আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান পাঁচ বছরের কারাদন্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থ দন্ডের স্থানে ২০ লাখ টাকা অর্থ দন্ডের বিধান যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তি ও শিক্ষা সমাপনী তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের পাশাপাশি ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ব্যানবেইসের ওয়েবসাইটেও প্রকাশের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত সময়ে সনদ নিতে ব্যর্থ হলে ইউজিসির সুপারিশে সেটি বন্ধ ঘোষণা করা যাবে।

কমিটি সূত্র জানায়, এসব বিষয়ে কমিটি বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কমিটির সদস্য ড. হাছান মাহমুদ কয়েকটি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেছেন। তিনি যৌন নিপীড়ন রোধ কমিটির সভাপতি নারী সদস্য হওয়ার বিষয়ে আপত্তি তুলে বলেন, এটি সব সময় শুধু পুরুষের দিক থেকেই যে ঘটে, তা কিন্তু নয়। তিনি বিষয়টি আইনে অন্তর্ভুক্ত না করে বিধিমালায় রাখার প্রস্তাব করেন। তিনি কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলে সেখানকার শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কী হবে, আইনে তা উল্লেখ করতে বলেন। শিক্ষার্থী ফি কাঠামো নির্ধারণে কমিশনের অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টিও বাদ দেওয়ার দাবি করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাব-কমিটির আহ্বায়ক আবদুল কুদ্দস জানান, রোববারের বৈঠকে তিনি অংশ নেননি। তবে বৈঠকে যেসব বিষয়ে প্রস্তাব উঠেছে, সেগুলোর ব্যাপারে তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে। বন্ধ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সমমানের সেমিস্টারে পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি। যৌন নিপীড়ন কমিটি গঠনের প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, সম্প্রতি সরকারি ও বেসরকারি উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে অনেক আপত্তিকর ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে। এমনকি পরীক্ষার খাতায় নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তাই এ প্রস্তাব করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। আবদুল কুদ্দুস আরও বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে কমিটিকে অনুরোধ করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী এই সাব-কমিটি গঠন করা হয়। ২০১০ সালের শিক্ষা নীতির আলোকে মন্ত্রণালয় যাতে গ্রহণ করতে পারে, তেমন প্রস্তাবই করেছে এ কমিটি।

তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করলে এটা তো সরকারি হয়ে যাবে। আইনে কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন আমরাও অনুভব করছি। সাব-কমিটির উচিত ছিল স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ নেওয়া। একতরফা উদ্যোগ সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে। তিনি দাবি করেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সরকারিভাবে কোনো অর্থই নেওয়া হয় না। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংসদীয় কমিটি বৈঠকের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটিকে তিনি 'ইতিবাচক' আখ্যায়িত করেন।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান সমকালকে বলেন, সাব-কমিটির বৈঠকের প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শৃগ্ধখলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক রুগ্ণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যেভাবে পর্যবেক্ষক মনোনয়ন দেয়, সেভাবেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে মনোনীত সদস্য নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। ধারণাটি সেখান থেকেই নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

http://www.samakal.com/bangladesh/article/1710578/