১০ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১:৪৫

বাংলাদেশের জন্য ভারতীয় ঋণ : কার স্বার্থে?

ভারতের সাথে বাংলাদেশের সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের একটি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দু’দেশের মধ্যে সম্পাদিত এটি হচ্ছে তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিট (LOC) বাংলাদেশী টাকায় এই ঋণের পরিমাণ হচ্ছে- প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। শর্তানুযায়ী ২০ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে এবং ভারত কর্তৃক অনুমোদিত ও ট্রানজিট সুবিধার অনুকূল নির্দিষ্ট করা ১৭টি প্রকল্পে এই ঋণের অর্থ ব্যয় করতে হবে। এছাড়াও প্রকল্পসমূহের অনুকূলে ঠিকাদার নিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রী ভারত থেকেই ক্রয় করতে হবে। ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি গত ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং এ সময়ে তিনি এই ঋণ প্রস্তাব সাথে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সফররত ভারতীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির উপস্থিতিতে গত চার অক্টোবর এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব কাজী সফিকুল আজম এবং ভারতের পক্ষে এতে স্বাক্ষর করেন ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেভিড রাসকিনস্থা। এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ, রেলপথ, সড়ক, জাহাজ চলাচল, বন্দর অবকাঠামো খাতসহ ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। বলাবাহুল্য প্রথম দু’টি লাইন অব ক্রেডিটের ন্যায় তৃতীয় এই লাইন অব ক্রেডিটের জন্যও বাংলাদেশকে বছরে এক শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে এবং ৫ বছরে রেয়াতি মেয়াদসহ ২০ বছরে সুদে-মূলে সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঋণের নিয়মিত সুদ ছাড়াও এর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অর্ধশতাংশ হারে প্রতিশ্রুতি ফি বা কমিটমেন্ট ফি পরিশোধ করতে হবে। সময়মত পরিশোধ করতে না পারলে জরিমানাও পরিশোধ করতে হবে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক দায়ের পরিমাণ হচ্ছে- ২৬.১৩১ বিলিয়ন ডলার যা মোট দেশজ উৎপাদনের ১৩ শতাংশ এবং রফতানি আয়ের ৭৭ শতাংশ। এই দায়ের মধ্যে রয়েছে- বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, ইফাদ ও অন্যান্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে দেয় ২০.৫০৭ মিলিয়ন ডলার, জাপান, চীন, কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, ভারত, কুয়েত ও অন্যান্য দেশকে দেয় ৩.৯৯৩ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক ঋণসহ স্বল্পমেয়াদী ৬৯১ মিলিয়ন এবং গ্যারান্টিকৃত রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ৯৪১ মিলিয়ন ডলারের ঋণ। এই ঋণের মধ্যে ভারতীয় ঋণের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী চুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত ঋণের অর্থ ব্যয়ের জন্য বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে ১৭টি প্রকল্প তৈরি ও চিহ্নিত করেছে। এই প্রকল্পগুলো হচ্ছে : রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অন্যস্থানে বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, বুড়িগঙ্গা রিভার রেস্টোরেশন, চট্টগ্রাম বন্দরে বে-কন্টেইনার টার্মিনাল ও পায়রাবন্দর টার্মিনাল তৈরি, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ডাবলগেজ রেলপথ নির্মাণ, সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নয়ন, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এবং চট্টগ্রামের মিরেরসরাই-এর বারৈয়ারহাট হয়ে খাগড়াছড়ির রামগড় পর্যন্ত এবং কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর হয়ে সরাইল পর্যন্ত চারলেন সড়ক নির্মাণ, মিরেরসরাইয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে এক লাখ এলইডি বাল্ব সরবরাহ, ঈশ্বরদীতে রেল ও সড়ক পথের জন্য আইসিডি নির্মাণ, মংলায় ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তরল বর্জ্য শোধনাগারের জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয় প্রভৃতি।
ভারত প্রদত্ত অতীতের লাইন অব ক্রেডিটসমূহের খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে যে, এদের কোনটিরই অবস্থা সন্তোষজনক নয়। এর মধ্যে প্রথম লাইন অব ক্রেডিটের অধীনে ঋণের পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৮০ কোটি ডলার ঋণ এবং বাকী ২০ কোটি অনুদান। এই অর্থ দিয়ে ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়েছে ১২টি প্রকল্প। গত ৭ বছরে ভারতের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এই প্রকল্পগুলোর অধীনে মাত্র ৩৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার ছাড় করেছে। আরো বাকী আছে ৬২.৪০ কোটি ডলার। বার বার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও ভারত অবশিষ্ট টাকা ছাড় করেনি এবং ইতোমধ্যে ছাড়কৃত অর্থের মধ্যে কি পরিমাণ ঋণ এবং কি পরিমাণ অনুদান রয়েছে তাও স্পষ্টকরণ করেনি। এই অস্পষ্টতার মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় এলওসি অর্থাৎ ২০০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তিতেও স্বাক্ষর করেছে। এই ঋণের অধীনে ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে এবং অনুমোদন করা হয়েছে ১২টি। এই ঋণের এক পয়সাও ছাড় হয়নি। এই প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে যত না বেশি জড়িত তার থেকে বেশি জড়িত ভারতের ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধার সাথে। তবে প্রকল্পগুলোর কোনটির কাজ এখনো পর্যন্ত শুরু হয়নি। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই ঋণ এবং প্রতিশ্রুতি উভয়ের উপরই সুদ কষা শুরু হয়ে গেছে। আবার চুক্তিপত্র স্পষ্ট না হওয়ায় রেয়াতি মেয়াদে এবং অর্থছাড় ও ব্যবহৃত না হওয়া পর্যন্ত সুদ ও দ-সুদ প্রযোজ্য হবে কিনা তা বলা মুস্কিল। প্রতিশ্রুতি ফি পরিশোধের কথা তো আলাদা।
এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন অত্যন্ত ভাল। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় তারা আমাদের পাশে ছিল, আগামীতেও তারা আমাদের পাশে থাকবে বলে আশা করি। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আজ ৪৫০ কোটি ডলারের একটি ঋণ চুক্তি হচ্ছে। এর আগেও দু’টি হয়েছে। কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় চুক্তির অধীনে বাস্তবায়নকৃত প্রকল্পের অগ্রগতি ভাল নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে যদি ভাল না হয়ে থাকে তাহলে নতুন চুক্তি কেন? আগের ঋণের মূল্যায়নের ভিত্তিতে কি নতুন চুক্তির নতুন ঋণগ্রহণ উচিত ছিল না? অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে লাইন অব ক্রেডিটের অধীনে গৃহিত সবকটি ভারতীয় ঋণই বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী। এর সবগুলোই Supplies Credit, চড়ামূল্যে ঋণ এবং ভারতীয় স্বার্থে প্রদত্ত ঋণ। আমরা চড়া মূল্যে ঋণ নিয়ে, দেশের মানুষকে ঋণের জালে আবদ্ধ করে তাদের ট্রানজিটের সুযোগ করে দিচ্ছি। ট্রানজিট দেয়ার আগে বলা হয়েছিল যে, এর মাধ্যমে আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা উপার্জন করতে পারবো কিন্তু পরে দেখা যাচ্ছে এ ব্যাপারে আমাদের আয়ের ঘরে শূন্য! একজন উপদেষ্টা তো বলেই ফেললেন যে ট্রানজিট বাবদ ফি নেয়া বিশ্বাসঘাতকতা হবে। এ কথা না হয় বাদই দিলাম। ঋণ নেয়ার পর এর মালিক বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কিভাবে তা ব্যবহার করবে সেটি তার নিজের ব্যাপার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই ঋণের টাকা ভারতীয় ঠিকাদাররা ব্যবহার করবেন। বাংলাদেশে কি ঠিকাদার নেই? আবার প্রকল্পের নির্মাণ সামগ্রী ও অন্যান্য উপকরণও চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে ক্রয় করতে হবে। এই শর্তটি ভারতীয় পণ্য ও সার্ভিস আমদানিতে বাংলাদেশকে বাধ্য করার শর্ত। বাংলাদেশ তার অর্থে যেখানে সুবিধাজনক ও সাশ্রয়মূল্যে ভাল মানের পণ্য পাবে সেখান থেকেই তা ক্রয় করবে; ভারতে যদি তা পাওয়া যায় তাহলে সেখান থেকে কিনবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়? কিন্তু তা না করে ভারত থেকে কেনার, (কোন্ দামের এবং মানের তা না বলে) শর্ত জুড়ে দেয়া কি উচিত? কিন্তু উচিত না হলেও তা হচ্ছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৈষম্য নিয়ে বহু বছর ধরে বিতর্ক চলে আসছে। এই সমস্যার সমাধান হয়নি। শুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত দ্রব্য বৈধভাবে ভারতে ঢুকতে পারে না। বন্ধুত্বের খাতিরে ভারতকে এই বাধা দূর করার জন্য বারবার অনুরোধ করা হয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি। এই অবস্থায় এ কথা কি বলা অসমীচীন হবে যে লাইন অব ক্রেডিটের অধীনে ভারতীয় ঋণ ভারতীয় স্বার্থে, বাংলাদেশের স্বার্থে নয়!

http://www.dailysangram.com/post/302889-