১০ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১:৪৫

সুশাসন

প্রধান বিচারপতির ছুটি

ইকতেদার আহমেদ

বাংলাদেশের বিচার বিভাগ উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালত সমন্বয়ে গঠিত। সাংবিধানিকভাবে উচ্চ আদালতকে সুপ্রিম কোর্ট বলা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নামে দু’টি পৃথক বিভাগ রয়েছে। অধস্তন আদালত জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ, যুগ্ম জেলা জজ, সিনিয়র সহকারী জজ ও বিভিন্ন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সমন্বয়ে গঠিত। জেলা জজ একটি জেলার অধস্তন আদালতের প্রধান বিচারিক কর্মকর্তা। একজন জেলা জজ যখন দেওয়ানি মামলা বিচার করেন, তখন তিনি জেলা জজ নামে অভিহিত হন। অপর দিকে ফৌজদারি মামলা বিচারকালীন তাকে দায়রা জজ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারকেরা আপিল বিভাগে আসন গ্রহণ করেন। অপর দিকে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী ও অস্থায়ী বিচারকেরা হাইকোর্ট বিভাগে আসন গ্রহণ করেন।
বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে বিধান অনুসৃত হয় তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশের একজন নাগরিকের অন্যূন ১০ বছর সুপ্রিম কোর্টে অ্যাডভোকেট হিসেবে কর্মের অভিজ্ঞতা থাকলে অথবা বিচার বিভাগীয় পদে ১০ বছর কর্মের অভিজ্ঞতা থাকলে তাকে দুই বছরের জন্য অস্থায়ী বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। অস্থায়ী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকের বিচারিক কর্ম সন্তোষজনক হলে দুই বছরান্তে তাকে হাইকোর্ট বিভাগে স্থায়ী বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। অস্থায়ী বিচারক হতে স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির সুপারিশ মুখ্য হলেও অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, এ বিষয়ে সরকারের অভিপ্রায়ই সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ৯৫-এর বিধানাবলিসাপেক্ষে সরাসরি স্থায়ী বিচারক পদে নিয়োগ বাতিল না হলেও এ যাবৎকাল পর্যন্ত অনুসৃত বিধান অনুযায়ী প্রথমত, দুই বছর মেয়াদের জন্য হাইকোর্ট বিভাগে অস্থায়ী বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া হয় এবং অতঃপর সরকারের সন্তুষ্টিসাপেক্ষে স্থায়ী বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এক বা একাধিক অস্থায়ী বিচারকের ক্ষেত্রে আরো এক মেয়াদ বাড়ানোর পর স্থায়ী করার নজির রয়েছে।
অসুস্থতা বা বিদেশভ্রমণের কারণে প্রধান বিচারপতির ছুটি নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অন্য বিচারকদের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণ তাকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালনের জন্য বলেন। এরূপ প্রধান বিচারপতিকে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি বলা হয়। প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত রাষ্ট্রপতিকে তার অপর সব কার্য প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ অনুযায়ী সমাধা করতে হয় বলে এ ছুটির আবেদনটি প্রধান বিচারপতির কার্যালয় থেকে প্রথমত আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় এবং এরপর সেখান থেকে সারসংক্ষেপ আকারে তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরের পর আবেদনটি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয় সারসংক্ষেপ প্রস্তুতের সময় সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৯৭-এর নির্দেশনার আলোকে প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারক দায়িত্বে থাকবেন এ বিষয়টি উল্লেখ করে। আজ পর্যন্ত যথাযথ কারণ ছাড়া কখনো এর অন্যথা হতে দেখা যায়নি। যথাযথ কারণ হলো, কোনো কারণে কর্মে প্রবীণতম বিচারকের অনুপস্থিতি। দায়িত্ব পালন বিষয়টি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে নথিটি আইন মন্ত্রণালয়ে পৌঁছানোর পর এ বিষয়ে উক্ত মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, যা গেজেট বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশিত হয়। প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতি বা ছুটি নেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারককে দায়িত্ব দেয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই প্রধান বিচারপতির ছুটির আবেদনে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এটি ছুটির অনুমোদন নয়, অনুপস্থিতিজনিত কারণে কে দায়িত্ব পালন করবেন সেটির অনুমোদন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক এবং হাইকোর্ট বিভাগের যেকোনো স্থায়ী বা অস্থায়ী বিচারকের নৈমিত্তিক ছুটি নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে তারা যে ক’দিন ছুটিতে থাকবেন, ওই দিনের সংখ্যা ছুটির দরখাস্তে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বরাবর আবেদন করে থাকেন। এখানে একজন বিচারক ছুটিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার আকাক্সক্ষাই মুখ্য। ছুটির আবেদনটি প্রধান বিচারপতি বরাবর পাঠানোর উদ্দেশ্য ছুটি বিষয়ে তাকে অবহিতকরণ এবং হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চের ক্ষেত্রে বেঞ্চের অপর বিচারক কী ধরনের দায়িত্ব পালন করবেন, সে বিষয়ে প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা দান। সচরাচর হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চের কোনো বিচারক ছুটি নিলে অপর বিচারককে ছুটিকালীন সময়ের জন্য একক বেঞ্চের দায়িত্ব দেয়া হয়। আপিল বিভাগের একজন বিচারক ছুটি নিলে তার অনুপস্থিতিতে ওই বিভাগের এক বা একাধিক বেঞ্চের বিচারকেরা বিচারকার্য পরিচালনা করে থাকেন।
প্রধান বিচারপতি ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বা হাইকোর্ট বিভাগের যেকোনো বিচারক নৈমিত্তিক ছুটি নিলে অপর কোনো বিচারককে তার দায়িত্বে থাকার আবশ্যকতা না থাকায় একজন বিচারক ছুটি নেয়া বিষয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে তার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে তাকে অবহিত করেন। এরূপ ছুটির ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির ছুটি মঞ্জুর বা নামঞ্জুরের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক।
জেলা জজ একটি জেলার মুখ্য বিচারক। জেলা জজ নৈমিত্তিক ছুটিতে গেলে অতিরিক্ত জেলা জজ জেলা জজের দায়িত্বে থাকেন। একজন জেলা জজ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের মতো নিজের ছুটিতে থাকার বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে লিখিত আবেদনের মাধ্যমে অবহিত করেন এবং উক্ত আবেদনপত্রে উল্লেখ করেন যে, তার অনুপস্থিত থাকার সময় অতিরিক্ত জেলা জজগণের মধ্যে কে দায়িত্বে থাকবেন। সচরাচর জ্যেষ্ঠ অতিরিক্ত জেলাজজকেই দায়িত্বে রাখা হয়। জেলাজজের অধস্তন কোনো বিচারক নৈমিত্তিক ছুটিতে যেতে চাইলে তিনি জেলাজজ বরাবর আবেদন করেন এবং এ ক্ষেত্রে তার ছুটিকালীন কোন্ বিচারক তার দায়িত্ব পালন করবেন, সে বিষয়ে জেলাজজ সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। মুখ্য মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট বা মুখ্য বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কোনো ম্যাজিস্ট্রেট নৈমিত্তিক ছুটিতে যেতে চাইলে ছুটির বিষয়টি উভয় আদালতের মুখ্য ম্যাজিস্ট্রেট অনুমোদন করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে জেলাজজের মতো একজন ম্যাজিস্ট্রেটের অনুপস্থিতির কারণে অপর কোনো ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে থাকবেন, সে বিষয়ে উভয় আদালতের মুখ্য ম্যাজিস্ট্রেট সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন।
সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রতি বছর যে সংখ্যক দিনের জন্য নৈমিত্তিক ছুটি পান প্রধান বিচারপতি ও অপরাপর বিচারকেরাও একইসংখ্যক দিনের জন্য নৈমিত্তিক ছুটি পান। বর্তমানে একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী একটি বছরে সর্বোচ্চ ২০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি ভোগ করতে পারেন। একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী একনাগাড়ে সর্বোচ্চ ১০ দিনের জন্য নৈমিত্তিক ছুটি ভোগ করতে পারেন। একটি বছরের নৈমিত্তিক ছুটির নির্ধারিতসংখ্যক দিন উল্লিখিত বছর ভোগ করে না থাকলে তা পরবর্তী বছর ভোগ করার অবকাশ থাকে না, যা অন্য কথায় বলতে হয় এ ছুটির দিনগুলো তামাদি হয়ে যায়।
সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা পূর্ণ গড় বেতন ও অর্ধ গড় বেতনে যে হারে অর্জিত ছুটি আহরণ করেন প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারকেরাও একই হারে পূর্ণ গড় বেতন ও অর্ধ গড় বেতনে অর্জিত ছুটি আহরণ করেন। অর্জিত ছুটি ভোগ না করে থাকলে তা একজন কর্মকর্তা, কর্মচারী বা বিচারকের ছুটির হিসেবে পুঞ্জীভূত হয় এবং এরূপ পুঞ্জীভূত অর্জিত ছুটির পরিমাণ এক বছর হলে একজন কর্মকর্তা, কর্মচারী বা বিচারক অবসরে যাওয়ার সময় সর্বশেষ আহরিত মূল বেতনের সমপরিমাণ ১২ মাসের বেতন পেয়ে থাকেন। অর্জিত ছুটি ভোগ পরবর্তীও প্রাপ্যতাসাপেক্ষে এটি মঞ্জুরের জন্য আবেদন করা যায়। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অথবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অর্জিত ছুটি মঞ্জুর করে থাকেন। প্রধান বিচারপতি ও উচ্চ আদালতের অপরাপর বিচারকদের ক্ষেত্রে The Supreme Court Judges (Leave, Pension and Privileges) Ordinance, 1982 অনুযায়ী অর্জিত ছুটি মঞ্জুরের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ হলো রাষ্ট্রপতি।
সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মতো উচ্চ ও অধস্তন আদালতের বিচারকেরা অসাধারণ ছুটি ও বিশেষ অক্ষমতা ছুটি ভোগ করতে পারেন। এরূপ অসাধারণ ছুটি চাকরিজীবনে একবার সর্বোচ্চ ছয় মাসের জন্য ভোগ করা যায় এবং অসাধারণ ছুটির ক্ষেত্রে ছুটিকালীন সময়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, কর্মচারী বা বিচারক কোনো বেতন পান না। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যেভাবে বিশেষ অক্ষমতা ছুটি পান উচ্চ আদালতের বিচারদের ক্ষেত্রেও একইভাবে বিশেষ অক্ষমতা ছুটি ভোগের অধিকার প্রযোজ্য। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ক্ষেত্রে উভয় ছুটি মঞ্জুরের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ হলো নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অথবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং উচ্চ আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/258615