৯ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ২:১২

বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা জাতিসংঘ প্রতিবেদনে

দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তাগিদ

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত না পাঠানো হলে কক্সবাজারে বড় মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে কক্সবাজারের উখিয়া-কুতুপালং এলাকায় রোগব্যাধির মহামারী এবং দাঙ্গার আশঙ্কাও করছে জাতিসংঘ।

চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবেলার ব্যাপারেও একটি কর্মপরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংশ্নিষ্ট কূটনৈতিক সূত্র জাতিসংঘের প্রতিবেদন সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে। সূত্র জানায়, জাতিসংঘ এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশসহ একাধিক দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরকে পাঠিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে বিশ্বে সবচেয়ে প্রকট শরণার্থী সংকটের চাপ বাংলাদেশের ওপর। এ অবস্থায় সংকট সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সবাইকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জাতিসংঘের। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থা, বিশ্ব অভিবসান সংস্থা, মানবাধিকার কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রসের সহায়তায় এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

পরিস্থিতি দ্রুত নাজুক হচ্ছে :'রোহিঙ্গা রিফিউজি ইস্যু :হিউম্যানিটারিয়ান রেসপন্স' শিরোনামের জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে এখনও শরণার্থী আসা বন্ধ হচ্ছে না। এর কারণ রাখাইনে জাতিগত নিধনযজ্ঞের মতো কর্মকান্ড বন্ধ হয়নি। বরং তা অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে এখনও প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা দল বেঁধে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। যে পরিমাণে রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকায় আশ্রয় নিচ্ছে তার ফলে পুরো এলাকাই এখন বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এ মুহূর্তেই জরুরি ব্যবস্থা না নিলে এ এলাকায় বড় ধরনের প্রাণনাশের আশঙ্কাও রয়েছে। দু'ভাবে প্রাণনাশের ঘটনা ঘটতে পারে। প্রথমত, সীমিত জায়গার মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষের গাদাগাদি অবস্থানের ফলে যে কোনো মুহূর্তে সংক্রামক ব্যাধি

মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আবার রোহিঙ্গাদের অবস্থান দীর্ঘ হলে এলাকার জীবন-জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাবে স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের দাঙ্গাও বেধে যেতে পারে। এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে রাখাইনে গণনিষ্ঠুরতা বন্ধ করে সেখানে রোহিঙ্গাদের দ্রুত নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা।

২৫ আগস্টের পর থেকে যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে, তারা খুবই কম সহায়-সম্বল নিয়ে আসতে পেরেছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে আসা সঞ্চয়ের বেশিরভাগই বাংলাদেশে আসতে এবং এখানে বাঁশ ও পলিথিন কিনে আশ্রয় তৈরিতে ব্যবহার হয়েছে। তাদের এখন খাদ্যসহ জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গারা বিপুল সংখ্যায় একত্রে চলে আসার কারণে তাদের আশ্রয়স্থল এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় এখানে প্রাণঘাতী সংক্রামক ব্যাধি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। এ ছাড়া বড় সংখ্যায় মানুষ এসেছে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায়। তাদের প্রাথমিকভাবে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হলেও অপ্রতুল চিকিৎসাসেবার কারণে অনেক মানুষকেই শরীরে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত বহন করতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ২০০০ একর উম্নয়নশীল বনভূমিতে নতুন ক্যাম্প তৈরির ঘোষণার পর উখিয়া এলাকায় রোহিঙ্গা আসার সংখ্যা বেড়ে যায়। পুরনো ক্যাম্পের আশপাশে বিভিম্ন স্থানে নতুন করে আসা মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা হয়। দ্রুত বিপুলসংখ্যক মানুষ জড়ো হওয়ার কারণে এখন ক্যাম্পগুলোতে জরুরি মানবিক সেবা নিশ্চিত করা প্রায় দুরূহ হয়ে পড়ছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি যত বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই স্থানীয় জনগণের জীবন ও জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব বাড়ছে। বিশেষ করে এখানে স্থানীয় জনগণের অনেকেই খুবই দরিদ্র। জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে উঠলে তাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার আশঙ্কাও প্রবলভাবে রয়েছে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন নূ্যনতম জীবন ধারণের মতো গৃহ অবকাঠামো সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলে এ এলাকায় অবস্থান করা রোহিঙ্গারাও বিক্ষুব্ধ হতে পারে। ফলে উখিয়া-কুতুপালং এলাকায় অদূর ভবিষ্যতে দাঙ্গারও আশঙ্কা রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের জন্য এখন থেকেই বড় আকারের সহায়তা কার্যক্রম চালাতে হবে তাদের ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকাকে কেন্দ্র করে। তাদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা, আশ্রয়স্থল, স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, বিশুদ্ধ পানি, পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যবিধির ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে হবে এবং পর্যাপ্ত ত্রাণ ও খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক রাখার জন্যও বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে।

সংকট মোকাবেলা দুই পর্যায়ে : প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবেলায় দুটি পর্যায়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রথম পর্যায়ে দুটি ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। যত বেশি সম্ভব শরণার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য এবং জরুরি ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের স্বাস্থ্য রক্ষার সাধারণ নিয়মের বিষয়ে সচেতন করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম এমন নূ্যনতম সুবিধার গৃহ অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। প্রথম পর্যায়ের কর্মপরিকল্পনার ভেতরেই শরণার্থীরা যেন বাঁচার তাগিদে স্থানীয়দের জীবিকার জন্য হুমকি না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্বিতীয় পর্যায়ের শুরুটাও এখনই এগিয়ে নিতে হবে। সেটি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা। এতে বলা হয়, বড় আশঙ্কার কারণ এখন পর্যন্ত রাখাইন থেকে কক্সবাজারে দল বেঁধে রোহিঙ্গারা আসছে। কারণ সেখানে এখনও জাতিগত নিধনযজ্ঞ বন্ধ হয়নি। ফলে দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় আলোচনা এবং উদ্যেগের মধ্য দিয়ে শরণার্থীদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থাও যথাসম্ভব দ্রুত করতে হবে। এ জন্য সব পক্ষকে দ্রুত এগিয়ে আসতেও প্রতিবেদনে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়।

টিআইবির নিন্দা : রোহিঙ্গা ইস্যুতে গত মে মাসে দেওয়া বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন অনুযায়ী যথার্থ পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ওই প্রতিবেদন অনুসরণ করলে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতনের ঘটনা প্রতিরোধ করা যেত বলে মনে করছে সংগঠনটি। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'আমরা জাতিসংঘের কাছে তাদের এই নিষ্ফ্ক্রিয়তার ব্যাখ্যা চাই। বিশেষ করে তারা যা সবাইকে করতে বলে, তা নিজেরাই কেন করতে ব্যর্থ হলো তার জবাব দিতে হবে।'

তিনি বলেন, জাতিসংঘ মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান সহিংসতাকে 'জাতিগত নির্মূলের প্রামাণ্য উদাহরণ' বলে অভিহিত করেছে। এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছিল মে মাসের ওই প্রতিবেদনে। গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি প্রতিবেদন 'ধামাচাপা' দিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধের সুযোগ হারিয়েছে জাতিসংঘ।

http://www.samakal.com/bangladesh/article/1710508