৯ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ২:০৯

সংসদ ভেঙে সহায়ক সরকার ও সেনা চায় অধিকাংশ দল

ইসির সাথে সংলাপ

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল রোববার পর্যন্ত নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৭টির সাথে সংলাপ সম্পন্ন হয়েছে। সংলাপে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসির কাছে নানা সুপারিশ উপস্থাপন করেছে দলগুলো। সংলাপে অংশ নিয়ে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন ও ভোটের আগে সংসদ ভেঙে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। এ পরমার্শে দু-একজন বিরোধিতা করলেও বেশির ভাগ ঐকমত্য পোষণ করেছেন। এর আগে সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যম কর্মীদের সাথেও সংলাপ করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। তারাও একই পরামর্শ দেন নির্বাচন কমিশনকে।

ইসি সূত্র জানায়, আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রোডম্যাপ ঘোষণা করে ইসি। রোডম্যাপ অনুযায়ী ৩১ জুলাই সুশীলসমাজের সাথে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু হয়। সংলাপে সবার আস্থা অর্জনে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশনের ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারের পরামর্শ দেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিতর্কিত ইভিএম থেকে সরে এসে সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের পরামর্শ দেন। ভোটে কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার ঠেকাতে ইসির ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করে একাদশ সংসদ নির্বাচন ভয়মুক্ত ও সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তারা।

নাগরিক সমাজের সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, নির্বাচনে ভয়মুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে সেনা মোতায়েন করতে হবে। নির্বাচনের আগে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিতে হবে। সহায়ক সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার। নিকট অতীতে দেখেছি ইসি নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগে অনীহা দেখিয়েছে, যেটি সুষ্ঠু নির্বাচন অর্জনে কাজে দেয়নি। ইসির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অভিযোগ আমলে নেয়া হয় না বা প্রতিকার নেই। এটিতে সক্ষমতা প্রমাণ হয় না। এ জন্য সক্ষমতা দেখানো জরুরি। অভিযোগ আমলে নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে অনেক অনিয়ম রোধ হতো।
এরপর ১৬ ও ১৭ আগস্ট গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে সংলাপ করে ইসি। প্রথম দিনের সংলাপে ইসির ক্ষমতা প্রয়োগের পরামর্শ দেন সাংবাদিকেরা। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনে সেনা মোতায়েনের পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী আচরণবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ, দলীয় প্রভাবমুক্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, ভোটে যেন কোনো প্রার্থী প্রভাব বিস্তার না পারেন সেজন্য কঠোর হাতে দমনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এ ছাড়াও নাগরিক সমাজের মতোই নির্বাচনের যথাযথ পরিবেশ তৈরি ও ইসিকে আস্থা অর্জনের পরামর্শ দেন প্রায় সব গণমাধ্যম প্রতিনিধি।

১৭ আগস্ট দ্বিতীয় দিনেও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক সংলাপ করতে নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দেন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা। নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন যাই হোক না কেন সব চাপের ঊর্ধ্বে থেকে ইসিকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান তারা। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি প্রয়োজনে সেনা মোতায়েনের আহ্বানও জানান তারা। ওই দিন সংলাপ শেষে সরকার যে নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক করে দেবে সেভাবে ভোট কার্যক্রম সম্পন্ন করবে ইসি সিইসির এমন বক্তব্যে বির্তকের ঝড় ওঠে। সিইসির এমন বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণের দায়িত্ব ইসির। যেভাবে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব সে ব্যবস্থাই করতে হবে ইসিকে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তার এ বক্তব্য কোনোভাবেই কাম্য নয়।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, এখন এগুলো কেরানির কথা। তাদের তো নির্বাচন করতে হবে। তাদের মূল কাজ হচ্ছে নির্বাচন করা। নির্বাচনটা গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক করতে যা যা করা দরকার সম্ভব সবই তাদের করা উচিত। এখানে আইনে কোনো জায়গায় তাদের বাধা দেয় না। যখন দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণ্ডগোল হচ্ছে তখন তারা ভূমিকা রাখতে পারে। এটি কোনো বিষয় না। কাজের বাইরে আইনের বাইরে আমরা কিছু করব না এগুলো ভিন্ন কথাবার্তা। একটা সুষ্ঠু-সুন্দর নির্বাচনের জন্য কমিশন যে উদ্যোগই নেয় সেটিই আইন। আইনের বাইরে কিছু না। উচ্চ আদালতের রায়ে তাদের কাজের এখতিয়ারের বিষয়গুলো বলে দেয়া হয়েছে। আসলে সদিচ্ছাটা হচ্ছে বড় কথা।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার পর্যন্ত মোট ২৭টি দলের সাথে সংলাপ করে ইসি। সংলাপে ২৩টি দল বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে না। তারা নির্বাচনের সময় সংসদ ভেঙে দিয়ে অস্থায়ী বা সহায়ক সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে বিভিন্ন ফর্মুলা এসেছে দলগুলোর পক্ষ থেকে। দলগুলো ইসিকে জানিয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। আর একটি সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় আরেকটি সংসদ নির্বাচন হলে সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা কঠিন। প্রধানমন্ত্রীকে ঐচ্ছিক ছুটিতে পাঠিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নির্বাহী প্রধান করে অপরাপর কমিশনার এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও সরকারি কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি)। এ সময় মন্ত্রিসভা ও সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়েছে দলটি। জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) প্রস্তাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিক অবসারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, সাবেক বিচারপতি এবং দেশের বিশিষ্টজনদের সমন্বয়ে সৎ গ্রহণযোগ্য নির্দলীয় ব্যক্তি দিয়ে সরকার গঠিত হতে পারে। গণ ফ্রন্টের পক্ষ থেকে করা সুপারিশে বলা হয়েছে, বর্তমান সরকারকে সংবিধান সংশোধন করে হলেও (তত্ত্বাবধায়ক নয়, অরাজনৈতিক সরকার নয়) একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। স্বাধীনতার পরে যেসব নিবন্ধিত দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল (বিতর্কিত নির্বাচন যেমন ৮৮, ৯৬ এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ব্যতীত) তাদের সমন্বয়ে একটি সরকার গঠন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সমঝোতার মাধ্যমে সে সরকারের প্রধান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। তবে নির্বাচনকালীন সরকারের কেউ জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। সংলাপে ২৫টি দল নির্বাচনকালীন সেনাবাহিনী মোতায়েনের সুপারিশ করেছে। এসব দলের মধ্যে বেশির ভাগই সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়ার দাবি জানিয়েছে। দেশের বেশি দল নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে ইসির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখার সুপারিশ করেছে। সংলাপে অংশ নেয়া বেশির ভাগ দল প্রবাসীদের ভোটার বানানো ও তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে। এ ছাড়া দলগুলোর করা সুপারিশের মধ্যে সীমানা পুনর্নির্ধারণ, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি, ‘না’ ভোট চালু, কয়েক ধাপে জাতীয় নির্বাচন, সংসদের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি, ইভিএম বাতিল, রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার, সরকারিভাবে প্রার্থীদের প্রচার, ধর্ম ও স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোর নিবন্ধন বাতিল উল্লেখযোগ্য।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপের অংশ হিসেবে মূল অংশীজন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করছে ইসি। ২৪ আগস্ট এ সংলাপ শুরু করে ইসি। ১৫ অক্টোবর বিএনপি এবং ১৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপ করবে।
২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই হিসেবে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবরের পর শুরু হবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় গণনা।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/258393