৯ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ১০:১৩

সাংবিধানিক পদধারীর দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বপঠিত শপথের পরিপন্থী

সাংবিধানিক পদধারী বলতে সাধারণ অর্থে সংবিধানে যেসব পদের উল্লেখ রয়েছে, সেসব পদকে বোঝায়; তবে বিশেষ অর্থে যেসব পদের নিয়োগ ও যোগ্যতা বিষয়ে সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে সেসব পদকে বোঝায়। সাংবিধানিক পদধারীদের মধ্যে যারা অন্তর্ভুক্ত তারা হলেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ সদস্য, প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপরাপর নির্বাচন কমিশনার, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্ম কমিশনের সভাপতি ও অপরাপর সদস্য। উপরোক্ত পদধারীরা ছাড়াও অ্যাটর্নি জেনারেল একজন সাংবিধানিক পদধারী; কিন্তু উপরোক্ত পদধারীদের মতো অ্যাটর্নি জেনারেল শপথের অধীন নন। অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং নিয়োগ লাভের পর তিনি রাষ্ট্রপতি বরাবর যোগদানপত্র দাখিল সাপেক্ষে পদে আসীন হন। অ্যাটর্নি জেনারেল ছাড়া অপরাপর সাংবিধানিক পদধারীরা শপথ পাঠ ব্যতিরেকে পদে আসীন হন না এবং শপথ পাঠ ব্যতিরেকে তাদের কারও পক্ষে পদ সংশ্লেষে কোনো ধরনের দায়িত্ব পালনের অবকাশ নেই।

অ্যাটর্নি জেনারেল ছাড়া সব সাংবিধানিক পদধারীকে শপথগ্রহণ করাকালীন অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি ব্যক্ত করতে হয় তারা বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করবেন। আমাদের সংবিধানে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে যেসব অযোগ্যতার বিষয় উল্লেখ রয়েছে তার অন্যতম হল- কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ অথবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পোষণ। এ অযোগ্যতার বিষয়টি সংবিধান প্রণয়কালীন অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রবর্তনকালীন এ অযোগ্যতাটির সঙ্গে শর্তারোপ করে বলা হয়- উপরোক্ত দফায় যা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে এবং পরে ওই ব্যক্তি- ক. দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ত্যাগ করলে অথবা খ. অন্য ক্ষেত্রে আবার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে এ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে তিনি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন বলে গণ্য হবেন না।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সব সদস্যকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হতে হয়। অপরাপর সাংবিধানিক পদধারীদের ক্ষেত্রে এরূপ যোগ্যতার উল্লেখ না থাকলেও আমাদের নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১-এ তে (The Citizenship Act, 1951) দ্বৈত নাগরিকত্ব বারিত করা হয়েছে যদিও বাংলাদেশ নাগরিকত্ব (অস্থায়ী বিধান) আদেশ, ১৯৭২ (The Bangladesh Citizenship (Temporary Provisions) Order, 1972)-এর বিধান অনুযায়ী ইউরোপ অথবা উত্তর আমেরিকা অথবা সরকার কর্তৃক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্ধারিত অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের নাগরিককে সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করতে পারেন।

নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১-এর ১৪ ধারায় দ্বৈত নাগরিকত্ব অথবা জাতীয়তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১-এর ১৪(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, এই ধারার বিধানাবলী সাপেক্ষে যদি কোনো ব্যক্তি এ আইনের বিধানাবলীর অধীন বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন এবং একই সময়ে অন্য কোনো দেশের নাগরিক বা অধিবাসী হয়ে থাকেন, তিনি যদি ঐ দেশের আইন অনুযায়ী তাহার নাগরিক অথবা অধিবাসী মর্যাদা পরিত্যাগ করে ঘোষণা প্রদান না করে থাকেন সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া হতে বিরত হবেন।

উপধারা নং (১)-এ বর্ণিত কোন কিছুই যাহার বয়স ২১ বছর অতিক্রম করেনি তাহার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

উপধারা নং (১)-এ বর্ণিত কোনো কিছুই যে কোনো ব্যক্তি যিনি যুক্তরাষ্ট্রের (Acceding State) অধিবাসী যতদূর পর্যন্ত তাহার ঐ রাষ্ট্রের অধিবাসী হওয়ার সাথে সম্পৃক্ত তাহার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১-এর ১৪নং ধারায় বর্ণিত দ্বৈত নাগরিকত্ব বারিত সংক্রান্ত বিধানটি বাংলাদেশ নাগরিকত্ব (অস্থায়ী বিধান) আদেশ, ১৯৭২ ২(বি) (২)-এর বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ওই আইনে ১৯৭৮ সামরিক শাসন বহাল থাকাবস্থায় অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধনী আনয়নপূর্বক ২(বি) ধারা সন্নিবেশিত করে দফা (২)-এ বলা হয়, ওই আইনের ২ ধারায় এবং বর্তমানে বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, ইউরোপ অথবা উত্তর আমেরিকা অথবা সরকার কর্তৃক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উল্লিখিত অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের নাগরিককে সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করতে পারেন।

যেহেতু দ্বৈত নাগরিকত্ব বহাল থাকাবস্থায় স্বদেশে অবস্থান না করলে ভোটাধিকার প্রয়োগ অআইনানুগ, সেহেতু বিশেষ উদ্দেশ্যে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সৃষ্ট দ্বৈত নাগরিকত্বধারী ব্যক্তিকে সংসদ সদস্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন সাংবিধানিক পদ এবং যে কোনো ধরনের সামরিক ও বেসামরিক পদে যোগ্য করা যুক্তিযুক্ত কিনা তা বিবেচনার দাবি রাখে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের কারণে বিষয়টি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।

উচ্চাদালত অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিমকোর্টের অপর সব বিচারকের শপথবাক্যের অন্যতম মূল অংশ বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ। এখন প্রশ্ন, শপথবাক্যে উপরোক্ত অংশ পাঠ-পরবর্তী সময়ে বিচারপতি বা বিচারক আসনে আসীন হয়ে অন্য কোনো দেশের প্রতি আনুগত্য পোষণকারী বিচারপতি বা বিচারক একইসঙ্গে কি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য অটুট রাখতে পারেন? একজন বিচারপতি বা বিচারককে অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ-পরবর্তী সে দেশের পাসপোর্ট নিতে হলে তাকে আবশ্যিকভাবে সে দেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করতে হয়। এরূপ ক্ষেত্রে স্বভাবতই যে জটিলতার উদ্ভব হয়, তা হল অন্য দেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণাকারী একজন বিচারপতি বা বিচারক কি বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে তার বিচারিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন? তাছাড়া এরূপ বিচারপতি বা বিচারকের সম্মুখে যদি তিনি যে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন সে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো মামলা বিচারের জন্য উপস্থাপন করা হয়, সেক্ষেত্রে কি তিনি নিরপেক্ষভাবে তার বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারবেন?

বাংলাদেশের উচ্চাদালত তথা সুপ্রিমকোর্টে বর্তমানে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক রাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা বিচারাধীন আছে। কিন্তু বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যে দেশে সংসদ সদস্য হতে হলে দ্বৈত নাগরিকত্ব যেমন বারিত, অনুরূপ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার প্রভৃতির ক্ষেত্রেও একইভাবে বারিত। কিন্তু রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ন্যায়বিচারের প্রতীক দেশের জনমানুষের শেষ ভরসাস্থল সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি বা বিচারক হওয়ার ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্ব কোনো বাধা নয়।

বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধান বিচারপতি বা সুপ্রিমকোর্টের বিচারক হওয়ার ক্ষেত্রে যেসব যোগ্যতার উল্লেখ রয়েছে তা হল, ব্যক্তিটিকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং এর অতিরিক্ত সুপ্রিমকোর্টে দশ বছর ওকালতির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে অথবা কোনো বিচার বিভাগীয় পদে দশ বছর কর্মের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। উপরোক্ত যোগ্যতার পাশাপাশি সংবিধানে সুপ্রিমকোর্টে বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য যোগ্যতার উল্লেখ থাকলেও সংবিধান প্রণয়ন-পরবর্তী ছেচল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এরূপ যোগ্যতা নির্ধারণ করে অদ্যাবধি কোনো আইন প্রণীত হয়নি। বিগত প্রায় দু’দশক ধরে প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিমকোর্টের অপরাপর বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবিশেষ গুরুত্ব পেয়ে আসছে তা হল, সংশ্লিষ্ট বিচারপতি বা বিচারকের রাজনৈতিক মতাদর্শ। আমাদের উচ্চাদালতে দ্বৈত নাগরিকত্বধারী বিচারপতি বা বিচারকের সংখ্যা নগণ্য হলেও এরূপ বিচারপতি বা বিচারকের ক্ষেত্রে দেখা যায় আদালতের অবকাশে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণকালীন সে দেশের নাগরিক হিসেবে যত ধরনের সুবিধা আছে তা ভোগ করে থাকেন। এভাবে এক দেশের সাংবিধানিক পদধারীর দ্বৈত নাগরিকত্বের আবরণে নিজ দেশ ও নাগরিকত্বধারী দেশের সুবিধা গ্রহণ কতটুকু নীতি-নৈতিকতা ও বিবেকবোধ দ্বারা সমর্থিত? আর উভয় দেশ থেকে এরূপ সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্যের বিষয়টি পরিমাপেরই বা মাপকাঠি কী?

বাংলাদেশের প্রতিটি সাংবিধানিক পদধারী শপথ গ্রহণকরাকালীন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণের ঘোষণা দেন। এরূপ ঘোষণার পর তার অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে তা নিজ দেশের জন্য কতটুকু অটুট থাকে আর নাগরিকত্ব গ্রহণকারী দেশের জন্য কতটুকু থাকে, তা বিবেচনায় নেয়া হলে হিসাব মেলানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ বাস্তবতায় আমরা কেন মানুষের শেষ ভরসাস্থল উচ্চাদালতের সাংবিধানিক পদে আসীন বিচারপতি বা বিচারকদের দ্বৈত নাগরিকত্বের দোলাচলে অযথা বিতর্কের মধ্যে নিজেদের নিপতিত করছি?

ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

iktederahmed@yahoo.com

https://www.jugantor.com/window/2017/10/09/161797