৯ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ১০:১৩

জটিলতার ফাঁদে তিন দফার ভারতীয় এলওসি

 বহমান এই সময়ে

জি. মুনীর


সম্প্রতি ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তিন দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে নিজ দেশে ফিরে গেছেন। এ সময় তিনি ৪৫০ কোটি ডলারের একটি ঋণচুক্তি করে গেছেন। টাকার অঙ্কে এই ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। ভারতীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ও বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে গত ৪ সেপ্টেম্বর এই ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চলতি বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বাংলাদেশের জন্য ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়। সেই সূত্রে উল্লিখিত এই চুক্তিটি সম্প্রতি ঢাকায় স্বাক্ষরিত হলো। এই ঋণচুক্তির আওতায় বাংলাদেশের অগ্রাধিকার পাওয়া ১৭টি অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে এই অর্থ ব্যয় করা হবে।

ভারতের সাথে এর আগে আমাদের আরো দু’টি ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এসব চুক্তি লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) নামে পরিচিত। এ ধরনের ঋণকে আমরা স্থানীয়ভাবে সরবরাহ ঋণ বলেও জানি। লাইন অব ক্রেডিটের অর্থ হলো, এই ঋণের অর্থ খরচ করবে বাংলাদেশ বিশেষ কিছু শর্তের আওতায়। বিশেষ কিছু প্রকল্পেই শুধু এসব অর্থ ব্যয় করা যাবে। আর এসব প্রকল্পের বেশির ভাগই সম্পন্ন করতে হবে ঋণদাতা দেশটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। তবে মনে রাখতে হবে, এ ধরনের ঋণের উদ্দেশ্য হিসেবে ঋণদাতা দেশটি বলে থাকে : ‘আপনার দেশের উন্নয়ন, আমার পণ্যের রফতানি’। সে জন্য এ ধরনের ঋণের বেলায় শর্তাদি সম্পর্কে ঋণগ্রহীতা দেশটিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। না হলে ঋণদাতা দেশটি এর আওতায় তার দেশের পণ্য রফতানির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে শতভাগ সফল হলেও ঋণগ্রহীতা দেশটির জন্য কার্যত কোনো উপকার হয় না। তবে শুধু ওই দেশটির ওপর ঋণের বোঝাটাই চেপে বসে। কার্যত সে ঋণভারের চাপ গিয়ে পড়ে জনগণের ঘাড়ে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, চীন থেকে সরবরাহ ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কা আজ বড় বিপদে। চীন থেকে এ ধরনের সরবরাহ ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কা বড় বিমানবন্দর নির্মাণ করেছে সত্য। তবে ওখানে কোনো বিমান ওড়ে না। ঋণের বোঝা কিন্তু শ্রীলঙ্কার ঘাড়ে আছেই। তাই প্রতিটি দেশের উচিত এ ধরনের সরবরাহ ঋণের ব্যাপারে চুক্তি সই করার আগে ঋণের শর্তাদি সতর্কতার সাথে খতিয়ে দেখা। আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ভারতের সাথে সরবরাহ ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে সেই সচেতনতাবোধ দেখাতে পারেননি বলেই বোদ্ধাজনেরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন। কারণ এর আগে ভারতের সাথে আমাদের যে দু’টি এলওসি চুক্তি হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়নে এরই মধ্যে এসব ঋণের তিক্ত অভিজ্ঞতা এখন আমরা টের পাচ্ছি। এ ধরনের সরবরাহ ঋণের বেলায় থাকে অকথিত নানা শর্তের বেড়াজাল। ভারতের সাথে এই তিনটি চুক্তির শর্তাবলি মোটামুটি একই।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এর আগে ভারতের সাথে সম্পাদিত হয় এ ধরনের দু’টি চুক্তি। প্রথমটি ১০০ কোটি ডলারের, যা স্বাক্ষরিত হয় ২০১০ সালে। সেই ঋণচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নের আগেই অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ২০১৬ সালে স্বাক্ষরিত হয় এমনি ধরনের দ্বিতীয় একটি ঋণচুক্তি, যার অর্থমূল্য ২০০ কোটি ডলারের। অপ্রত্যাশিতভাবে এই দ্বিতীয় চুক্তিটি নরেন্দ্র মোদি নিয়ে এসেছিলেন অনেকটা চীনবিরোধী চেকমেট পলিসি হিসেবে। সে এক ভিন্ন হিসাব। তবে এখানে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির খেলাও ছিল। তখন মোদি কংগ্রেসকে দেখাতে চেয়েছিলেন, বিজেপি সরকার বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের চেয়েও ঘনিষ্ঠতর। সে যা-ই হোক, এই দু’টি চুক্তি হয়েছিল এক্সিম ব্যাংকের সাথে। এই দুই চুক্তির ৩০০ কোটি ডলার থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ৩৫ কোটি ডলার। শর্তের জটিল প্রক্রিয়ায় পড়ে বাকি টাকা বাংলাদেশ এখনো পায়নি। ওই দুই ঋণচুক্তি এবং সম্প্রতি সম্পাদিত ৪৫০ কোটি ডলারের তৃতীয় ঋণচুক্তির শর্তাবলি মোটামুটি একই। অতএব এই ঋণচুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন মহলে সংশয় থাকাটা স্বাভাবিক।

এবারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশে অবস্থানের সময় অরুণ জেটলি বলেছেন, কোনো দেশকে ভারতের দেয়া এটিই অর্থাৎ এই ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ ভারতের সর্বোচ্চ মাত্রার ঋণ। তার ভাষ্যমতে, এ ঋণের হার সামান্য, মাত্র ১ শতাংশ। ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২০ বছরে। কিন্তু অরুণ জেটলি ঠিক বলেননি। তিনি এই ঋণে লেপটে থাকা নানা শুভঙ্করের ফাঁকের কথা আমাদের জানাননি। আমাদের দেশের অর্থনীতিকদের আশঙ্কাÑ নানা শর্তের বেড়াজালে আটকা আছে ভারতের তৃতীয় ঋণের ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ। এই অর্থে বাস্তবায়িতব্য প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ঘটবে বিলম্ব। অরুণ জেটলি যে বললেন, এই ঋণের সুদ সামান্য, মাত্র ১ শতাংশÑ কার্যত তা-ও সত্য নয়। পরোক্ষভাবে এই ঋণের হার অনেক বেড়ে যাবে। তাদের মতে, কয়েক বছর আগে নেয়া দু’টি ঋণের তুলনায় এ ঋণের শর্ত আরো বেশি এবং পরিশোধের সময়সীমাও কম। পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে স্বস্তিকরও নয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের অভিমত হচ্ছে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে ভারতীয় এই ঋণের সুদহার খুবই কম। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। কারণ, এ ঋণের অর্থে যেসব পণ্য কেনা হবে, এর ৭৫ শতাংশ কিনতে হবে ভারত থেকে। আর এই সুযোগে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে এই দেশটি। ফলে সুদের হার বেড়ে যাবে। আর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দ্বিতীয় দফার ২০০ কোটি ডলার ঋণের যেখানে কোনো অর্থ এখন পর্যন্ত ছাড় হয়নি, সেখানে তৃতীয় দফার এই ঋণচুক্তি কোনো প্রয়োজন ছিল না। তিনি এ কথাও বলেছেন, এ ধরনের ঋণ নেয়ার পক্ষপাতী তিনি নন। কারণ, এ চুক্তি করে আমাদের তেমন কোনো লাভ হবে না। পাইপলাইনে আটকে পড়ে থাকা সহজ শর্তের প্রায় ৩২০০ কোটি ডলার আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। এসব সহজ শর্তের ঋণ ছাড় করা গেলে এবং যথাযথভাবে তা ব্যয় করতে পারলে এ ধরনের ঋণ নেয়ার দরকার পড়ে না। তা ছাড়া এটি ভারতের সাথে তৃতীয় ঋণচুক্তি। প্রথমটাই এখন পর্যন্ত পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। দ্বিতীয়টির অর্থও খুব সামান্যই ব্যবহার হয়েছে। কাজেই খামোখা একের পর এক চুক্তি করে দায়বদ্ধতা বাড়ানোর কোনো অর্থ হয় না।
আসলে অতীতের ভারতীয় দু’টি ঋণের আওতায় নেয়া প্রকল্প বাস্তবায়নের চিত্র খুবই হতাশাজনক। ওই ঋণে মংলা থেকে খুলনা পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রেললাইন নির্মাণের উদোগ নেয়া হয় ২০১১ সালে। কিন্তু এরই মধ্যে সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ভূমি উন্নয়নের কাজই শেষ করতে পারেনি রেল মন্ত্রণালয়। ফলে দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বাস্তবায়নের মেয়াদও। ভৈরব ও তিতাস রেলসেতু, আশুগঞ্জ বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এখনো শেষ হয়নি।
ভারতীয় ঋণের এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কেন এই বিলম্ব? ভারতের সাথে ২০১০ সালে ও ২০১৬ সালে দুই দফায় যে ৩০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছিল, এর আওতায় নেয়া প্রকল্পগুলো প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের চিত্র খুব কাছ থেকে দেখেছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব। বর্তমানে তিনি এক মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটার কারণ সম্পর্কে তার অভিমত হচ্ছে, উল্টো নিয়মের কারণে এমনটি ঘটছে। বিষয়টি সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা এমন : ‘অন্য কোনো দেশে যেকোনো প্রকল্প অনুমোদন নেয়ার আগে সমীক্ষা, নকশা, আর্থিক ব্যয়ের বিশ্লেষণ ও প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়। এরপর যারা ঋণ দেবে, তাদের সাথে চুক্তি হয়। আর আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো। এখানে যারা ঋণ দিচ্ছে, তাদের সাথে আগে চুক্তি হচ্ছে। এরপর প্রকল্পের সমীক্ষা, নকশা চূড়ান্ত, আর্থিক ব্যয়ের বিশ্লেষণ ও প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি আদৌ প্রয়োজন কি না, সেটিও জানা যায় না। যখন জানা যায়, তখন দেরি হয়ে যায়।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই সচিব একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, কোনো ধরনের সমীক্ষা না থাকায় কাজ করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদ বারবার সংশোধন করে বাড়ানো হয়েছে। একই সাথে ব্যয়ও বাড়ানো হয়েছে।

জানা যায়, ভারতের ঋণে নেয়া প্রকল্পগুলোর সমস্যা একক নয়, দুই পক্ষেই সমস্যা আছে। বাংলাদেশ অংশে একটি প্রকল্প নেয়ার শুরুতে সমীক্ষা করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও, ভারতীয় ঋণের প্রকল্পগুলোতে তা করা হচ্ছে না। নকশাও করা হয় না। এতে কাজ করতে গিয়ে বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে সমস্যায় পড়তে হয়। জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে স্থানীয় জনগণের বাধার মুখে পড়তে হয়। ভারতীয় অংশে সমস্যা হলো ঋণের শর্ত। শর্ত পূরণ করতে গিয়ে দুই দেশের সম্মতিতে এখন পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথের আটটি প্রকল্প বাতিল করতে হয়েছে। ঋণের শর্ত হলো ৭৫ শতাংশ পণ্য আনতে হবে ভারত থেকে। এই শর্ত পূরণ করতে গিয়ে জটিলতা বাধছে। প্রকল্প অনুমোদনে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক দেরি করে বলেও অভিযোগ আছে সরকারের কয়েকটি সংস্থার পক্ষ থেকে। তা ছাড়া ভারতের অর্থে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলোতে ঠিকাদার নিয়োগ হচ্ছে ভারত থেকে। ফলে পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করা কঠিন। তা ছাড়া পণ্যের দামও বেশি নেয়ার সুযোগ থাকে। তবে কেউ কেউ বলছেন, ভারত থেকে যেসব পণ্য আনা হবে, তার দাম দেশটি বাড়াতে পারবে না। কারণ, সেখানে বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে দরপত্রে প্রতিযোগিতা হবে। মান ও দাম যাচাই করে পণ্য কেনাকাটা করা হবে। কিন্তু ভারতীয় কোম্পানিগুলো যদি এ ব্যাপারে কোনো সিন্ডিকেট গড়ে তোলে, তখন কিন্তু ভিন্ন পরিস্থিতি দাঁড়াবে, সেটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই এ ক্ষেত্রে শর্তটি এমন হওয়া উচিত ছিল : আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যমূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করতে হবে। তবে চুক্তিটিতে তেমন কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।

এ দিকে অরুণ জেটলি বলেছেন, বাংলাদেশের সাথে তার দেশের সম্পর্ক এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চপর্যায়ে পৌঁছেছে এবং অনেক দেশের জন্য তা একটি মডেল। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত শুধু নিতে জানে, দিতে জানে না। এখানে আসলে কার্যকর একতরফা বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক দুর্বলতার সুযোগে ভারত এই একতরফা বন্ধুত্বে মোক্ষম হাতিয়ারটি হাতে পেয়েছে। ভারত যে এই একতরফা সুযোগটি ভোগ করছে, এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ কাছে পায়নি ভারতকে, যেমনটি পায়নি চীন ও রাশিয়াকে। কোনো রাখঢাক না করেই ভারত রোহিঙ্গা নিধনের কাজে সু চির মিয়ানমারকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এক দিকে যখন গত মাসে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধন চলছিল, তখন নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরে গিয়ে সু চিকে বলে আসেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারত মিয়ানমারের পাশে আছে। এ দিকে রোহিঙ্গা সঙ্কটে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের কিছু আশা করা ঠিক হবে না বলে জানিয়েছেন ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। গত ৫ অক্টোবর বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা ভারতের কোনো সমস্যা নয়। এটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমস্যা। তাই তিনি এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে চীনের সহায়তা নেয়ার পরামর্শ দেন। তিনি অনেকটা নেতিবাচক সুরে বলেন, দরকার হলে বাংলাদেশ তো চীনের কাছে যায়। চীন তো এখন বাংলাদেশের বন্ধু হয়েছে। কিছু রোহিঙ্গা চীন নিয়ে নিক না। বাংলাদেশের সমস্যা আমরা সমাধান করে দেবো, এটা তো হয় না। পিনাক রঞ্জনের কথায় ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বের মডেলের স্বরূপটিই আসলে ধরা পড়েছে।

অর্থনীতিবিদেরা এরই মধ্যে জানিয়েছেন, ভারত থেকে লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় আগে নেয়া দু’টি ঋণের ৩০ কোটি ডলারের সার্বিক কার্যক্রম সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা হলে আবার ভারত থেকে একই ধরনের ঋণ নেয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কিংবা বলা যায়, এর প্রয়োজন ছিল না। কারণ, সে ঋণ দু’টি ইতিবাচক ছিল না। দ্বিতীয় ঋণচুক্তি ২০০ কোটি ডলার এখনো ছাড় হয়নি। আর প্রথম চুক্তির ১০০ কোটি ডলারের মধ্যে সাত বছরে ছাড় হয়েছে ৩৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারের মতো।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইকোনমিক রিলেশন্স ডিভিশন বা ইআরডি) সূত্রের বরাত দিয়ে একটি পত্রিকা সম্প্রতি জানিয়েছে, সম্প্রতি স্বাক্ষরিত তৃতীয় ঋণের অর্থে বাস্তবায়ন করা হবে ১৭টি প্রকল্প। আর পর্যায়ক্রমে প্রকল্পভিত্তিক ঋণচুক্তি হবে। এরপর অর্থ ছাড় হবে। তৃতীয় ধাপের ঋণের শর্ত আগের মতোই। এর মাধ্যমে বাস্তবায়িতব্য সরবরাহ প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ পণ্য অবশ্যই ভারত থেকে আমদানি করতে হবে। পাশাপাশি প্রকল্পের পরামর্শকও নিয়োগ করতে হবে সে দেশ থেকেই। এ ছাড়া যৌথ অবকাঠামো প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ পণ্য কিনতে হবে ভারত থেকে। প্রকল্পের বাকি পণ্য ভারতের বাইরের যেকোনো দেশ থেকে আমদানি করা যাবে। নতুন ঋণের সুদের হার ১ শতংশ। দণ্ডসুদ ২ শতাংশ ও প্রতিশ্রুতি ফি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। এ ছাড়া বাস্তবায়িতব্য প্রকল্পে ভারতীয় ঠিকাদার নিয়োগের শর্ত রয়েছে। আর প্রকল্পগুলোর জন্য জমি অধিগ্রহণ, দরপত্র প্রণয়ন, প্রকল্পের নকশা তৈরি ও দরপত্র চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সাথে সমন্বয় করে নিতে হবে। এ ঋণের মেয়াদ ২০ বছর। তবে গ্রেস পিরিয়ড পাঁচ বছর।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের অভিমত হচ্ছে, বিদ্যুৎ খাতের অবকাঠামো ও মানব উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্পে এ ঋণের অর্থ ব্যয় করা হবে। কিন্তু শর্তের ব্যাপারে সরকার কতটুকু দরকষাকষি করতে পারছে, সেটি দেখার বিষয়। চীন, রাশিয়া ও ভারত থেকে নেয়া ঋণের শর্ত অনেক বেশি। এমনকি পরিশোধের সময়ও কম এবং স্বস্তিকর নয়। এ ক্ষেত্রে আগে বিভিন্ন দেশ বা সংস্থার কাছ থেকে নেয়া ঋণের শর্ত ছিল তুলনামূলক কম। ফলে আগের প্রকল্পের তুলনায় বাস্তবায়িতব্য প্রকল্পের ঋণভার অনেক বেশি হবে। ঋণ হবে ব্যয়বহুল।
প্রশ্ন হচ্ছেÑ এত সব জটিলতা থাকতেও কেন আমরা বারবার ভারতীয় এলওসির দিকে আকর্ষিত হচ্ছি? পাইপলাইনে আটকে থাকা সহজ শর্তের ৩২০০ কোটি ডলারের ঋণ ব্যবহারে কেন আমরা আগ্রহী হচ্ছি না? দেশবাসী চায় ভবিষ্যতে যেন বাংলাদেশ এই জটিল ঋণের ফাঁদে আর পা না দেয়।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/258353