৯ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ১০:১২

বিশ্বজনমত উপেক্ষিত হচ্ছে

ইকবাল কবীর মোহন


রোহিঙ্গা সমস্যা প্রকট হচ্ছে। দমন, পীড়ন, হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও জ্বালাও-পোড়াও এখনো থামেনি। প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় চলছে জাতিগত নিধন ও হত্যার মহোৎসব। একটি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নানা অমূলক অজুহাতে মিয়ানমার থেকে তাড়িয়ে দেয়ার মানসিকতার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে সোচ্চার আওয়াজ উত্থিত হয়েছে। প্রতিবাদ ও ঘৃণার ভাষা প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হলেও মিয়ানমারে থেমে নেই হত্যাযজ্ঞ। নাফ নদীর পানিতে প্রতিদিন গিয়ে মিশছে হাজারো রোহিঙ্গার তাজা রক্ত। নাফে ভেসে উঠছে অসংখ্য মানুষের ক্ষতবিক্ষত ও ছিন্নভিন্ন বীভৎস লাশ।
আমরা লক্ষ করেছি পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রথম থেকেই সোচ্চার অবস্থান নিয়ে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা ইস্যুতে বরাবরই মিয়ানমারকে শক্ত বার্তা দিতে কার্পণ্য করেননি। রাখাইন প্রদেশের মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর যে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে, তা নিয়ে দুনিয়ার প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই কোনো না কোনোভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারপরও কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করেনি মিয়ানমার সরকার।

মিয়ানমারে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সত্ত্বেও চীন ও রাশিয়া দেশটিকে সমর্থন করার বিষয়টি বিস্ময়কর। তবে এর পেছনে স্পষ্টতই কাজ করছে নিছক অর্থনৈতিক স্বার্থ ও মুসলিমবিদ্বেষ। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, পশ্চিমা বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই মুসলিমবিদ্বেষী। তারপরও মিয়ানমারের বীভৎস হত্যাযজ্ঞ সবার বিবেককে নাড়া দিয়েছে। তাই বেশির ভাগ দেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ ও প্রতিবাদ প্রদর্শন করতে দ্বিধা করেনি। এমনকি রাখাইন শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা নিয়েও তারা এগিয়ে এসেছে। ধর্মীয় বিদ্বেষের কাছে মানবিকতা এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও নমনীয় হয়েছে। তবে চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা সত্যিই ন্যক্কারজনক ও অগ্রহণযোগ্য।

উল্লেখ্য, মিয়ানমারের সাথে চীন ও রাশিয়ার রয়েছে কৌশলগত, বাণিজ্যিক ও সামরিক স্বার্থ। কয়েক দশক ধরে সামরিক শাসনের কারণে মিয়ানমার বহির্বিশ্ব থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন। এই অবস্থায় মিয়ানমার অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে চীনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে চীন মিয়ানমারের প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণ, অবকাঠামো নির্মাণ, গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনসহ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরিতে বিপুল বিনিয়োগ করে। অন্য দিকে রাশিয়াও পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে মিয়ানমারকে নানাভাবে সাহায্য করে এবং দেশটিতে বিনিয়োগ সৃষ্টির সুযোগ গ্রহণ করে। তবে চীন মিয়ানমারের সব উন্নয়নকাজের বড় অংশীদার। দেশটির বাঁধ, ব্রিজ, সড়ক ও বন্দর নির্মাণের বড় জোগানদাতা হলো চীন। মিয়ানমারের আরাকান উপকূল থেকে চীনের ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩৪০ কিলোমিটার গ্যাসলাইন নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে চীন। এই গ্যাস সরবরাহে মিয়ানমার বছরে কর বাবদ রাজস্ব পাচ্ছে ৫৪ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে চীনের একচ্ছত্র বিনিয়োগ সুবিধা রয়েছে মিয়ানমারের সাথে। তা ছাড়া ভারতের বিপক্ষে দেশটির সাথে সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক তো আছেই। ফলে বর্তমান রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নেয়া চীনের পক্ষে ছিল অপরিহার্য বিষয়। রাশিয়াও মিয়ানমারে তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধির আশা করছে। তাই চীন ও রাশিয়া নির্লজ্জভাবে বর্মি নৃশংসতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর ফলে মিয়ানমার ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। আন্তর্জাতিক সব চাপ ও প্রতিবাদ তোয়াক্কা না করে মিয়ানমার রাখাইনে তার সামরিক ও জাতিগত নির্মূল অভিযান অব্যাহত রেখেছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, চীন ও রাশিয়ার আশকারা অব্যাহত থাকলে মিয়ানমার আরো উৎসাহী হয়ে উঠবে এবং রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে দেশটি আরো শক্ত অবস্থান গ্রহণ করবে। ফলে বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

উল্লেখ্য, ভারতের পর রাশিয়া ও চীনের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও কৌশলগত ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশ দু’টির সাথে বাংলাদেশ সরকার খুব একটা মজবুত অবস্থানে আছে বলে মনে হয় না। যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশ দু’টির সাথে আরো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বৃদ্ধি হওয়া প্রয়োজন। চীন, রাশিয়া ও ভারতের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে দ্রুততম সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন দক্ষতাপূর্ণ ও ব্যাপকভিত্তিক কূটনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক, সিনিয়র ব্যাংকার

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/258355