৯ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ১০:১১

বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বেগ

দেখা অদেখা

সালাহউদ্দিন বাবর
বক্তব্য-বিবৃতিতে গণতন্ত্রের কথা বললেও ক্ষেত্রবিশেষে এর বিপরীত আচরণ করা হলে, তা হবে গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এমন বৈপরীত্য আমাদের সমাজে বিরল নয়। বিশেষ করে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকের মধ্যে এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি পাওয়া যাবে। আবার নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও মতামত অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়াও অনেকের অভ্যাসে পরিণত করেছেন। এসব অগণতান্ত্রিক ভাবধারা পোষণ করেও নিজেদের গণতন্ত্রের মহাপ্রবক্তা হিসেবে জাহির করা থেকে তারা পিছিয়ে থাকেন না। অপরের মত তথা তাদের অভিপ্রায়ের বিপক্ষের যে ভিন্নমত থাকতে পারে, সে বিষয়কে তারা আমল দেন না। অর্থাৎ, নিজের মত নিয়ে সোচ্চার হলেও ভিন্নমতের প্রতি নেই কোনো শ্রদ্ধা। এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠের মত যদি তাদের বিপক্ষে যায়, সেটাও রুদ্ধ করতে তারা তৎপর হয়ে ওঠেন। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমেও এমন অবস্থা বিরাজ করছে। সংবাদ পরিবেশন ও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ প্রচুর রয়েছে। সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব মত যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর না-ও হয়, তাতেও তারা গ্রাহ্য করেন না। এমন ক্ষেত্রে তারা পাশ কাটিয়ে যান, অসত্যকে তারা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে চান। এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস ও জীবনাচরণের বিষয়ে শ্রদ্ধা দেখাতে কার্পণ্য করে উল্লিখিত বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকেরা এবং সংবাদমাধ্যম। এই ভাবধারা পোষণ করা অনৈতিক হলেও তার তোয়াক্কা করা হয় না। চোখবুজে এবং বাকরুদ্ধ হয়ে থাকেন। গণতন্ত্রের প্রাণসত্তা হলো নির্বাচন। দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শত ত্রুটি থাকলেও যদি সে ত্রুটি তাদের ভাবাদর্শের ব্যক্তিরা করে থাকেন, তাহলে তাকেও তারা ‘সহি’ বলে ছাড়পত্র দিয়ে থাকেন। আর এসব কারণেই দেশে ও বাইরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে এবং দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের কাছে জনগণের বেশি কিছু চাওয়ার নেই। তারা চান নির্বাচনে তাদের ভোট নিজের পছন্দের প্রার্থীকেই দিতে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবর্তমানে উগ্রপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এ ছাড়া দেশ থেকে হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে গণতন্ত্র না থাকায়Ñ এমনটিই মনে করেন এই বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব জার্নালিজমে আর্চার ব্লাড সেন্টার ফর ডেমোক্র্যাসি আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ডেমোক্র্যাসি’ শীর্ষক সেমিনারে এই বক্তব্য দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সেমিনারে মত প্রকাশ করা হয়, বাংলাদেশে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কারণে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গুম ও খুনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাবে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে বলে তাগিদ দেয়া হয়েছে। সেমিনারে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র নানা সমস্যায় জর্জরিত এবং দিন দিন অবস্থার অবনতি ঘটছে। বিশেষ করে সমালোচনামূলক সাংবাদিকতার অভাব, মিডিয়ার ওপর সরকারের সেন্সরশিপ, মতপ্রকাশের অভাব এই অবনতির কারণ। ক্ষমতাসীন সরকার বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কম আগ্রহী বলেও মন্তব্য করা হয়। বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের ভয়াবহ দিক তুলে ধরতে গিয়ে সেমিনারে মত প্রকাশ করা হয়, গত ১২ বছরে ৬১ বিলিয়ন ডলার এখান থেকে পাচার হয়েছে। এই পাচার রোধে সরকারি উদ্যোগ খুব কমই লক্ষ করা গেছে।

গণতন্ত্রের সুষ্ঠু অনুশীলনের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়নি। ফলে বেশ কিছু উপসর্গ গণতন্ত্রের পথযাত্রা বিঘিœত করছে। এ দেশের গোড়া থেকেই গণতন্ত্র অনুশীলনের মানসিকতার অভাব লক্ষ্য করা গেছে। যাদের এই ঐতিহ্য রচনা করার দায়িত্ব ছিল, তারা সম্মুখপানে হাঁটতে পারেননি; কেবল পিছিয়ে গেছেন। সূচনা ইতিবাচক হলেও তা অব্যাহত থাকেনি, ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যায়নি। হালে তা গভীর উদ্বেগ প্রকাশের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। গণতন্ত্রের যে প্রাণ সুষ্ঠু ভোটব্যবস্থা, তারই প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে। নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ ও সরকার গঠিত হয়। গণতন্ত্রের এক অপরিহার্য দিক জবাবদিহিতা, এ দেশে সেটা আর নেই। নির্বাহী বিভাগ নিজের বিবেচনায় চলছে। আইন বিভাগের অস্তিত্ব প্রকাশের জন্য যে প্রত্যাশিত কর্মপ্রয়াস, সেটা এখন নেই বললেই চলে। সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যদি এমন হাল হয়, তবে দেশে ও বিদেশে আমাদের গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ ছাড়া আর কী হতে পারে, গণতান্ত্রিক শাসন ও সাংবিধানিক শাসন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এই শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকলে মানবাধিকার সুরক্ষা পায়, আইনের শাসন, সুশাসন ও মতপ্রকাশের অবাধ সুযোগ ঘটে। এটাই প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কর্মধারা। সেই প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত রয়েছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য এই বৈশিষ্ট্যগুলো অনুসন্ধান করলে প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করা যাবে। এমন অনুসন্ধান হলে দেখা যাবে, এ দেশের নাগরিকেরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানবাধিকার ভোগ করতে পারছে না। সম-অধিকার মানবাধিকারের পরিপূরক। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যাবে, দেশের মানুষ মত ও পথের ভিন্নতার কারণে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে সম-অধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে সংবিধান মত ও পথের ভিন্নতা ব্যতিরেকেই সবার প্রতি সম-আচরণের অধিকার নিশ্চিত করেছে। অথচ লক্ষ করা যাবে, যারা ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী বিশেষ করে যারা সরকারে থাকেন, তারা দেশের সংবিধানের এই পথনির্দেশনা অনুসরণ করতে অবজ্ঞা প্রদর্শন করেন। তাই আইনের শাসন এখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে। আইনের শাসন বজায় থাকলে সংবিধানের সমতার চেতনাকে উচ্চকিত করে। যেকোনো ঘটনা পরিণতি লাভ করে আইনের সিদ্ধান্ত অনুসারে। কিন্তু এই পথ রুদ্ধ হয়েছে, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ক্ষমতার বাহুবল। গণতন্ত্রের অপর অনুষঙ্গ হচ্ছে সুশাসন। রাষ্ট্রীয় আচার-আচরণ অনুশীলন হবে কল্যাণের লক্ষ্যে। মানুষের কল্যাণে প্রশাসন থাকবে তাদের পাশে। রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি হবে ন্যায়ভিত্তিক। কিন্তু সুশাসনের অভাবে দুরাচার সমাজকে এখন বদ্ধ করে আছে বিভিন্ন স্তরে। সুশাসনের পৃষ্ঠপোষক হওয়া যাদের উচিত ছিল, তারা সেই ভূমিকায় নেই। সুশাসনের মৌলিক উদ্দেশ্য জনকল্যাণ, কিন্তু তা এখন আত্মকল্যাণের নিমিত্তে হয়েছে। এসব ব্যত্যয় ও বিচ্যুতি গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে দিচ্ছে না। এই অন্তরায় বিরাজ করার কারণে রাষ্ট্র সফল হতে পারছে না।

গণতন্ত্রের যথাযথ অনুশীলন না থাকায় দেশে গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। পৃথিবীর সর্বত্রই মত ও পথের ভিন্নতা সত্ত্বেও রাজনীতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহনশীলতার অপূর্ব আচরণ লক্ষ করা যায়, যার এখানে বড় অভাব। বিভিন্ন মত ও পথের রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরকে সহযোগী মনে না করে শত্রুর পর্যায়ে বিবেচনা করে থাকে এবং তাদের মধ্যে সামাজিকতা, সৌজন্য ও শ্রদ্ধাবোধ খুঁজে পাওয়া যায় না। দলগুলোর অবস্থান কারো উত্তর মেরুতে হলে কারো আবার দক্ষিণ মেরুতে। আদর্শিক মতপার্থক্য দলগুলোর মধ্যে থাকা স্বাভাবিক ও সঙ্গত। কিন্তু মতপার্থক্য পরস্পরকে শত্রুজ্ঞানে গিয়ে পৌঁছবে এমন কাম্য নয়। রাজনীতিতে এমন অলঙ্ঘনীয় বিভাজনে দেশে সব ক্ষেত্রে বিভক্তি ও বিরোধিতার কারণে কোনো বিষয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠা খুবই কঠিন। অথচ জাতিকে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই ঐক্য না থাকায় আমরা সব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে বিভক্ত। কোনো যুক্তি বা বোধগত কারণে এই বিভক্তি ঘটলে প্রশ্ন ছিল না, কিন্তু দেখা যাবে গ্রাম্য একগুঁয়েমির মতো যেহেতু সে এক দিকে, আমাকে তার বিপরীতে থাকতে হবেÑ যেন অনিবার্য এটাই। যৌক্তিক সমালোচনা ও অপরের মতের ব্যাপারে সহিষ্ণুতা নেই। আর পরস্পরের সমালোচনার যে ভাষা আমাদের রাজনীতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে তা একান্তই অপরিশীলিত। কাউকে হেয়প্রতিপন্ন বা উপহাস করতে সাধারণত যে ভাষা ব্যবহৃত হয়, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সেটির চর্চাই করেন। জাতির বিপদ-আপদে নেতৃবৃন্দের একত্রে বসে সমাধান খোঁজার প্রচেষ্টা এখন আর কল্পনা করা যায় না। এমনকি পরস্পর জানালা দিয়ে দু’টি শব্দ বিনিময় করবেনÑ এ পরিবেশও নেই। রাজনীতিকদের ভিন্নমতের কারণে যদি তাদের মধ্যে ন্যূনতম যোগাযোগ ও সামাজিক সম্পর্কও বজায় না থাকে তবে তা জাতির ঘোর বিপদের কারণ।
গণতান্ত্রিক দুনিয়ার একটি শৈলী হচ্ছে নির্বাচনে যারা পরাজিত হন, তারা পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে বিজয়ীকে অভিনন্দন জানান। কিন্তু আমরা এই শৈলী রপ্ত করতে পারিনি আজ পর্যন্ত। অবশ্য এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে। যারা বিজয়ী হন তারা কিন্তু ‘পপুলার ভোটে’ বিজয়ী হন না। বিজয়কে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের বিজয়ী করেন। তারা সত্যিকার জনপ্রতিনিধিত্ব করেন না। তাই যারা এমন নির্বাচনে ‘পরাজিত’ হন বলে ঘোষণা করা হয়, তারা যেমন নিজেদের পরাজয় স্বীকার করতে পারেন না, তেমনি এই বিজয়কেও গ্রহণ করতে পারেন না। এমন নির্বাচনে সত্যিকার অর্থে পরাজিত হচ্ছে গণতন্ত্র, যা আমাদের দেশে হামেশাই হয়ে থাকে। অতীতে বহু নির্বাচনে এমন ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। গণতন্ত্রের এমন পরাজয় কতকাল ধরে চলবে তা বলা কঠিন। জনগণ কথিত বিজয়ীদের পছন্দ করুক বা না-ই করুক তাতে কিছু আসে যায় না, ব্যাপার হচ্ছে তাদের বিজয়ী হতেই হবে যেকোনোভাবেÑ ছলে বলে অপকৌশলে।

গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় না থাকায় বাংলাদেশে স্বাধীন মতপ্রকাশের অবাধ সুযোগ এখন নানা চাপ ও ভয়ভীতির দ্বারা সঙ্কুচিত হয়ে আছে। স্বাধীন সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপর ক্ষমতাসীনদের চাপ, প্রভাবশালী মহলের ভয়ভীতি প্রদর্শন, নানা কায়েমি স্বার্থবাদীগোষ্ঠীর অদৃশ্য হস্তক্ষেপÑ এসব কারণে সাংবাদিকেরা ঝুঁকিতে থাকেন। আর কর্মরত সাংবাদিকেরা যদি ঝুঁকি ও ভয়ভীতির মধ্যে কাজ করতে বাধ্য হন, তবে স্বাভাবিকভাবেই সংবাদপত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সংবাদমাধ্যমের ওপর সরকার চাপ সৃষ্টি করে বিজ্ঞাপন বণ্টনের মাধ্যমে। তারা নিজেদের পছন্দের পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন বণ্টন করে অন্যদের প্রতি বৈষম্য করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রকাশিত হলে তা যদি তাদের স্বার্থের পরিপন্থী হয়, তারা সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন। সাংবাদিকেরা সব সময়ই নানা ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে আসছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংগঠনগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের খবর প্রকাশ করায় স্থানীয় সাংবাদিকদের মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হয়। প্রশাসন এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করে না। সমাজে যে অসহিষ্ণু অবস্থা বিরাজ করছে, তা স্বাধীন সংবাদপত্র বিকাশের অন্তরায়। এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশার প্রতি রাষ্ট্রীয় কোনো সুরক্ষা নেই। অথচ সরকার সংবাদপত্রের মাধ্যমে নানাভাবে উপকৃত হয়। দেশের সার্বিক অবস্থার যে চিত্র, তা বস্তুত সংবাদপত্রই তুলে ধরে। এতে সরকার তার প্রশাসন পরিচালনায় নানা সহায়তা পেয়ে থাকে। তা ছাড়া সাংবাদিকদের আর্থিক সচ্ছলতা নেই। তাদের সম্মানজনক ও চলার মতো বেতনভাতা খুব কম সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান দিতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো সহায়তা নেই।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পাশাপাশি এর এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ স্বাধীন সংবাদপত্র এখন নানা সঙ্কটে রয়েছে। তা ছাড়া আমাদের সমাজে সংবাদমাধ্যমকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। অথচ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে সংবাদমাধ্যমগুলোকে এতই গুরুত্ব দেয়া হয় যে, সেখানে তারা একে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। আসলে সংবাদপত্র সতর্ক প্রহরীর মতো রাষ্ট্রের অনিয়ম, দুর্নীতি ও দুরাচারকে দ্বিধাহীনভাবে তুলে ধরে। রাষ্ট্রকে সঠিক পথনির্দেশনা দেয়াসহ একটি জবাবদিহিমূলক সংগঠন হিসেবে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পশ্চিমে দাঁড়াতে পেরেছে সংবাদপত্র। অথচ বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিরূপ পরিবেশ, সহিষ্ণুতার অভাব, ক্ষমতাসীনেরা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকার প্রবণতার কারণে সাংবাদিকেরা তথা সংবাদপত্র ও মাধ্যম পশ্চিমের মতো সাহসী হয়ে ওঠার মতো অবস্থায় নেই। অথচ যেকোনো প্রতিষ্ঠান তা রাষ্ট্রই হোক বা ভিন্ন কোনো সংগঠন, তাদের গঠনমূলক সমালোচনা, জবাবদিহি করা নিজেদের জন্যই কল্যাণকর। সেসব প্রতিষ্ঠান মিডিয়ার আলোচনার মাধ্যমে সংশোধিত ও ত্রুটিমুক্ত হতে পারে, যা সবার জন্যই কল্যাণকর।
দেশে নির্বাচনের সময় যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের বিরুদ্ধেই যত অভিযোগ, তারা পেশিশক্তির জোরে এবং রাষ্ট্রীয় মদদে বিজয়ী হন। এমন অগণতান্ত্রিক আচরণ বাংলাদেশে বহু পুরনো। এই অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই দাবি উঠেছিল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। এ দাবিতে সংসদের ভেতরে ও বাইরে দীর্ঘ আন্দোলন করা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। এরপর এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তা অপেক্ষাকৃত অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারাবাহিকতা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। পরবর্তীকালে আবার এই বিধান আদালতের রায়ে বাতিল হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই এই বিধান বিলুপ্ত হয়েছে। বিরোধী দল এর বিপক্ষে মত প্রকাশসহ পুনরায় নির্বাচনসহায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে সোচ্চার হয়ে আছে। তবে এ নিয়ে এখন অচলাবস্থা তৈরি হয়ে আছে।

বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে যেমন মন্দ অভিজ্ঞতা রয়েছে, তেমনি নির্বাচন পরিচালনকারী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারেও জনগণ হতাশ। বর্তমানে যারা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে এসেছেন, তারা এখনো নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ভাবমর্যাদা উচ্চকিত করার ব্যাপারে তেমন কিছু করার সুযোগ পাননি, যা দৃষ্টিগ্রাহ্য হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে সংবিধান। সেই ক্ষমতা বলে নির্বাচন কমিশন একটি সর্বজনগ্রাহ্য তথা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু বিগত কমিশন গণতন্ত্রের প্রাণতুল্য নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছিলেন। জনগণ নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে হতাশ ও ক্ষুব্ধ ছিল। বর্তমান নির্বাচন কমিশন আগামীতে কী করবেন তা নিয়ে এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইনকানুন বিদ্যমান আছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ এবং কমিশন কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগতভাবে এই ক্ষমতা প্রয়োগের সক্ষমতা বা সদিচ্ছাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/258356