৯ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ১০:০৭

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ৭ শতাধিক কোটি টাকার অনিয়ম

সুদ স্থগিত না করে কৃত্রিম আয় বৃদ্ধি


বেসরকারি খাতের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে সাত শতাধিক কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ঋণ বিরূপ মানের শ্রেণীকরণযোগ্য হলেও তা করা হয়েনি। বরং ব্যাংক ও কোম্পানিগুলোর যোগসাজশে গ্রাহকদের সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যে এবং ব্যাংকের সম্পদের গুণগতমান ভালো দেখানোর জন্য এটা অশ্রেণীকৃত রাখা হয়েছে। আবার এসব ঋণের ওপর আরোপিত সুদ স্থগিত সুদ হিসেবে রাখার পরিবর্তে আয় খাতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এতে ব্যাংকের মুনাফা কৃত্রিমভাবে বেশি দেখানো হয়েছে। একই সাথে প্রভিশন কম দেখিয়ে প্রকৃত মূলধনের পরিমাণও আড়াল করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকটির বৃহৎ কয়েকটি শাখায় সরেজমিন পরিদর্শনে প্রাপ্ত ফল এবং ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায় এসব অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব ঋণ হিসেবের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আলোচ্য ঋণের বেশির ভাগের বিপরীতে নামমাত্র জামানত নেয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে জামানতবিহীন ঋণ দেয়া হয়েছে। ফলে এসব ঋণ আদায় না হলে ব্যাংক সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যা ব্যাংকটির সার্বিক আর্থিক অবস্থার ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটি শ্রেণীকরণ ও পুনঃতফসিল সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুুসরণ করেনি, যা ব্যাংকটির দুর্বল অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিচায়ক। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা আরো শোচনীয় হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক হতে বিরূপমানের শ্রেণীকরণযোগ্য ঋণকে শ্রেণীকরণ করে ও এর বিপরীতে অর্জিত আয়কে মুনাফায় অন্তর্ভুক্ত না করে স্থগিতের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সাথে এসব খেলাপিঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণেরও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে জারা কম্পোজিট টেক্সটাইলকে অনৈতিকভাবে ঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছে। ২০১০ সালের ৩০ মে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় থেকে জারা কম্পোজিট টেক্সটাইলকে ৫৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা অনুমোদন দিয়েছিল। এর মধ্যে মেয়াদি ঋণ ২৯ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং এলসি ১৮ কোটি টাকা, পিসি দেড় কোটি টাকা এবং সিসি (হাইপো) পাঁচ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেয়াদি ঋণ ২৯ কোটি টাকা ১০ লাখ টাকা এবং সিসি হাইপো তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা ন্যাশনাল ব্যাংক হতে অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু ঋণ আদায় অত্যন্ত অসন্তোষ হওয়ায় ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল বস্তুগত বিবেচনায় বিরূপ শ্রেণীকরণ করে। ঋণ অশ্রেণীকৃত অর্থাৎ খেলাপির বাইরে রাখতে এক বছরের জন্য গ্রেস পিরিয়ডসহ পুনঃতফসিল করে ব্যাংক। এদিকে পুনঃতফসিল করার পরও জারা কম্পোজিট টেক্সটাইল ঋণ পরিশোধে অনিয়মিত হয়ে পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ২০১৪ সালের ৬ আগস্টে অনাপত্তি গ্রহণ করে গ্রাহকের ঋণ হিসাবগুলোর একীভূত মোট স্থিতির ওপর ৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট গ্রহণ সাপেক্ষে ব্যাংক কর্তৃক ঋণ হিসাবটি ফের পুনঃতফসিল করা হয়। প্রথম দুই বছরের জন্য কিস্তি নির্ধারণ করা হয় দেড় কোটি টাকা এবং পরবর্তী তিন বছরের জন্য দুই কোটি ৭৬ লাখ টাকা। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত।

গ্রাহক সে সময়ের ব্যবসায়িক মুনাফা হতে প্রতি মাসে কিস্তি পরিশোধের ব্যর্থতা প্রকাশ করে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা চেয়ে ২০১৪ সালের ৮ ডিসেম্বর শাখায় আবেদন করে। এ আবেদনের ওপর ব্যাংক ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর প্রত্যক্ষ ঋণের ১১৬ কোটি ১৮ লাখ টাকার মধ্যে ৪৪ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ হিসাবে এক বছরের গ্রেসপিরিয়ডসহ এবং ৭২ কোটি ১৮ লাখ টাকা ১০ বছর মেয়াদি ঋণ পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এটি ব্যাংকের ভাষায় নাম দেয়া হয়েছে ঋণ পুনর্গঠন। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয় ৫০০ কোটি ও এক হাজার কোটি টাকার ওপরের ঋণখেলাপিদের।
এখানে ব্যাংক থেকে শুভঙ্করের ফাঁকি দেয়া হয়েছে। কারণ পুনর্বিন্যাসটি করা হয়েছে হিসাব বছর শেষ হওয়ার আগের দিনে এবং এর উদ্দেশ্য হলো আরোপিত সুদ আয় খাতে প্রদর্শনের জন্য এবং ডিসেম্বর ভিত্তিক বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন দলের কাছে অশ্রেণীকৃত ঋণ হিসাবে উপস্থাপনের নিমিত্তে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনাপত্তি প্রাপ্ত ঋণ হিসাবে পরবর্তীতে কোনো সুবিধা প্রদান করতে হলে পুনরায় অনাপত্তিপত্র নেয়ার বিষয়টি ব্যাংক ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছে এবং পুনঃতফসিলকৃত ঋণ দ্বিতীয়বার পুনঃতফসিলের পরিবর্তে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, যা বিআরপিডি ২০১২-এর ১৫ নম্বর সার্কুলারের নির্দেশনার লঙ্ঘন। কারণ গ্রাহক ঋণ পরিশোধে এমন নাজুক পরিস্থিতি এবং গ্রাহকের রিস্ক মার্জিনাল হওয়া সত্ত্বেও শাখা গ্রাহকের অনুকূলে আরো ঋণ সুবিধা প্রদান করে, যা সুষ্ঠু ব্যাংকিং নিয়মাচারের পরিপন্থী বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সিনহা গ্রুপের ঋণ অনিয়ম : বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা থেকে কোনো ধরনের সহায়ক জামানত না নিয়েই সিনহা গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় সাড়ে তিন শ’ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত ৩১ ডিসেম্বর স্থিতি অনুযায়ী গ্রুপের ফান্ডেড ঋণের স্থিতি ছিল ১৯৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা এবং নন-ফান্ডেড ঋণের স্থিতি ছিল ১১০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। গ্রুপের বিভিন্ন ঋণ হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গ্রাহকের নন-ফান্ডেড হতে বেশির ভাগ ঋণ হিসাবসমূহ সৃষ্টি হয়েছে। এবং এর ফলে শাখায় গ্রাহকের দায় ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং একই সাথে শাখার ঋণ ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ তিনটি গ্রুপের ঋণই বিরূপমানের শ্রেণীকরণযোগ্য হলেও তা করা হয়নি। উপরন্তু এসব ঋণের বিপরীতে অর্জিত আয় স্থগিত না করে আয় খাতে দেখানো হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন ব্যাংকটির কৃত্রিম আয় বেড়েছে, পাশাপাশি প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ না করে সম্পদের গুণগতমান আড়াল করা হয়েছে।

এইচআরসি শিপিংয়ের ঋণ খেলাপি না করা : বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়ান ব্যাংকের চেয়ারম্যান সায়িদ হোসেন চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এইচআরসি শিপিংয়ের কাছে ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখার পাওনা রয়েছে ১০০ কোটি ২১ লাখ টাকা। এর মধ্যে আরোপিত সুদ ৪১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটি আয় খাতে প্রদর্শন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ হিসাবসমূহ বকেয়া কিস্তির বিবেচনায় যথাযথ মানে শ্রেণীকরণ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে বলা হয়েছে। একই সাথে আরোপিত সুদ আয় খাতে প্রদর্শনের পরিবর্তে স্থগিত সুদ হিসেবে স্থানান্তর করতে বলা হয়েছে।
প্যারাডাইস ক্যাবল গ্রুপের ২০৮ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম : বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুসারে মাত্র ১৫ কোটি টাকার জামানতের বিপরীতে প্যারাডাইস ক্যাবল গ্রুপকে ২০৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে ঝুঁকিতে পড়েছে ব্যাংকটি। ব্যাংকটির গুলশান-১ শাখা থেকে এ ঋণ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক প্যারাডাইস ক্যাবল গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ২০৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ঋণের স্থিতি রয়েছে। এর মধে এসবিএস ক্যাবলের অনুকূলে ঋণ স্থিতি ১৭৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, প্যারাডাইস ক্যাবলের অনুকূলে ১৪ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং প্যারাডাইস মেটালবজিক্যাল কমপ্লেক্সের অনুকূলে ঋণ স্থিতি ১৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আলোচ্য প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বরাদ্দ করা ঋণসমূহ মূলত এলসি হতে সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তীতে গ্রাহক ঋণ পরিশোধে অনিয়মিত হয়ে পড়লে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ঋণহিসাবসমূহ বিধিবহির্ভূতভাবে পুনর্বিন্যাস ও পুনঃতফসিলের মাধ্যমে সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিটি ঋণ হিসাবই বকেয়া কিস্তির ভিত্তিতে মন্দমানের খেলাপি ঋণযোগ্য হলেও তা খেলাপি করা হয়নি। প্রতিষ্ঠান তিনটির নিরীক্ষা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পেয়েছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অর্জিত মুনাফা বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের আর্থিক দায় পরিশোধের পরিমাণ যথেষ্ট নয়। স্থায়ী সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে লক্ষণীয়। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলো তহবিল স্থানান্তরের মাধ্যমে স্থায়ী সম্পদ অর্জ করেছে।
গ্রাহকের ঋণ পরিশোধে অনগ্রহীতা বিবেচনায় বর্তমানে শাখা প্রতিষ্ঠানসমূহের অনুকূলে আর কোনো ফান্ডেড সুবিধা প্রদান করছে না। ঋণ আদায়ে শাখা বর্তমানে গ্রাহকের ওয়ার্ক অর্ডারে বিপরীতে শতভাগ মার্জিনের ভিত্তিতে এলসি সুবিধা প্রদান করছে। বিভিন্ন ঋণ হিসাবের পরিশোধের ধারা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রান্তিকে হিসাবসমূহ আরোপিত সুদের তুলনায় তা অতি সামান্য। ফলে সুদ মূলধনে রূপান্তরের মাধ্যমে গ্রাহকের ঋণ স্থিতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আলোচিত তিনটি প্রতিষ্ঠানের বকেয়া ঋণকে মন্দ মানের খেলাপি ঋণে রূপান্তর করে এর বিপরীতে অর্জিত আয় ব্যাংকের মুনাফা হিসেবে না দেখিয়ে স্থগিত করে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গ্রাহকের অনুকূলে বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ সুবিধা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর এক পত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা তলব করেছিল। গ্রাহকের মোট ঋণ স্থিতির বিপরীতে জামানত হিসাবে প্রদত্ত জমানতের মূল্য মাত্র ১৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা। সার্বিক বিবেচনায় প্যারাডাইস ক্যাবল গ্রুপের অনুকূলে প্রদত্ত ঋণ ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন-উর-রশিদ নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি মেনেই ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। কোনো স্থগিত সুদ আয় খাতে নেয়া হয়নি। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অডিট আপত্তি প্রতিবেদন আগের তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়। এর মধ্যে অনেক ঋণই নিয়মিত হয়ে যায়। প্যারাডাইস ক্যাবল গ্রুপের ঋণের বিষয়ে বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েই এ গ্রুপের ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। সুতরাং এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে তিনি দাবি করেন।



 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/258134