৯ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ৯:৪৫

বিশ্বব্যাংকের অর্থ ফেরতে জটিলতা

উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম প্রমাণিত * নতুন প্রকল্পে বিরূপ প্রভাব

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে বিশ্বব্যাংকের দাবি করা অর্থ ফেরত দেয়া নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পের কেনাকাটায় অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগে ‘মিসপ্রকিউরমেন্ট অথবা ইনইলিজিবল এক্সপেনডিচার’ ঘোষণা করে এ অর্থ ফেরত চায় সংস্থাটি। এ ধরনের কিছু অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হলেও অর্থ ফেরত দিতে সময়ক্ষেপণের অভিযোগ উঠছে মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর বিরুদ্ধে। ফলে এসব মন্ত্রণালয়ের অন্য প্রকল্পে এর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ধরনের জটিলতার কথা স্বীকারও করছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এ অবস্থায় দ্রুত প্রকল্পের অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্প চলাকালীনই অভিযোগ উত্থাপনের জন্য বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার কার্যবিবরণী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও বিশ্বব্যাংক ডেস্কের প্রধান মাহমুদা বেগম যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে নিয়ম অনুযায়ী তারা অর্থ ফেরত চায়। সেই টাকা দ্রুত ফিরিয়ে না দিলে ওই মন্ত্রণালয়ের অন্য প্রকল্পের অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। তাই যেসব প্রকল্পে এমন সমস্যার অভিযোগ রয়েছে সেগেুলোকে দ্রুত টাকা ফেরত দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের কাছেও অনুরোধ জানানো হয়েছে, যাতে প্রকল্প চলমান থাকার সময়ই অভিযোগ উত্থাপন এবং নিষ্পত্তি করা হয়। তা না হলে প্রকল্প শেষ হয়ে গেলে আগের লোকজনও থাকে না। আর নতুন যারা দায়িত্বে থাকেন তারা দায় নিতে চান না। ফলে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে টাকা ফেরত না দিলে যে কোনো প্রকল্পের আলোচনায় গিয়ে আমাদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। এটা কারও কাম্য নয়।

ইআরডি সূত্র জানায়, ন্যাশনাল এগ্রিকালচার টেকনোলজি প্রজেক্টটি (এনএটিপি) ২০০৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ মেয়াদে বাস্তবায়িত হয়। এটি বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত ছিল কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পে পণ্য সেবা এবং বিভিন্ন কাজে মিসপ্রকিউরমেন্টের (কেনাকাটায় অনিয়ম) অভিযোগ তোলে বিশ্বব্যাংক। এ ক্ষেত্রে প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার মার্কিন ডলার ফেরত চাওয়া হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, বিশ্বব্যাংকের আপত্তিকৃত অর্থের পরিমাণ সঠিক নয়। কৃষি মন্ত্রণালয় এ নিয়ে সভাও করে। এর জবাব ও ব্যাখ্যাসহ একটি পত্র ২০১৬ সালের আগস্টে ইআরডির মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়। এ ছাড়া একই বছরের ৪ অক্টোবর এবং চলতি বছরের ২৫ মে ইআরডি এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কাছে তাগিদপত্র পাঠায়। কিন্তু পত্রের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় বিশ্বব্যাংক কোনো জবাব দেয়নি। এ ছাড়া এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রিপার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স প্রকল্পটি ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪ সালের জুলাই মেয়াদে বাস্তবায়িত হয়েছে। এ প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ তুলে প্রায় ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৯২০ মার্কিন ডলার ফেরত চায় বিশ্বব্যাংক। এ ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর) সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকায় পদ্ধতিগত ভুল হয়েছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করেছেন। ফলে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে ইনইলিজিবল এক্সপেনডিচার (অমনোনয়নযোগ্য ব্যয়) ঘোষিত অর্থ ফেরত দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় কোনো জবাব দেয়নি। ফলে এ খাতে সম্ভাব্য দুটি বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন আপত্তির কারণে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই ইআরডির পক্ষ থেকে যথাযথ প্রমাণসহ বিশ্বব্যাংকের কাছে আপত্তির জবাব দেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে ইমপ্লয়মেন্ট জেনারেশন ফর দ্য পুওরেস্ট প্রজেক্টটি ২০১০ সালের মার্চ থেকে ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়িত হয়। এ প্রকল্পেও কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে কিছু অর্থ ফেরত চায় বিশ্বব্যাংক। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয় তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পায় এবং অভিযুক্তরা দোষ স্বীকার করে। ফলে কিছু অর্থ বিশ্বব্যাংকের কাছে ফেরত দেয়া হয়। অবশিষ্ট অর্থ ফেরতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও এখনও তা ফেরত দেয়া হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সেফটি নেট প্রোগ্রাম ফর দ্য পুওরেস্ট প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত অর্থায়ন বাধাগ্রস্ত হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তাই এ অর্থ দ্রুত ফেরত দেয়ার তাগিদ দিয়েছে ইআরডি। এ ছাড়া ডিসঅ্যাবেলিটি অ্যান্ড চিলড্রেন অ্যাট রিস্ক প্রকল্পটি ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সালের নভেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়িত হয়। এ প্রকল্পে কম্পিউটার ও আসবাবপত্র কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ করে প্রায় ১৮ হাজার ডলারের মতো ফেরত চায় বিশ্বব্যাংক। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করে সমাধানের জন্য ইআরডিকে অনুরোধ জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল ইআরডি সভা আহ্বান করে। কিন্তু সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোয় চিঠি দেয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ অবস্থায় ইনইলিজিবল সংক্রান্ত প্রকল্পের আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় চার ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এগুলো হল : চলতি অর্থবছরেই আগের অর্থবছরের ইনইলিজিবল এক্সপেনডিচার বা মিসপ্রকিউরমেন্ট চিহ্নিত করে নিষ্পত্তি করতে হবে; প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রকল্প সমাপ্তির প্রতিবেদন দাখিলের কমপক্ষে তিন মাস আগে তাদের নিজস্ব অডিট সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করবেন; বিশ্বব্যাংককেও প্রকল্প সমাপ্তির অন্তত তিন মাস আগে তাদের নিজস্ব অডিট সম্পন্ন করতে হবে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ সংক্রান্ত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকগুলোতে অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/10/08/161491