৯ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ৯:৪১

পক্ষপাতহীন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীতেই আস্থা সকলের

দেশের ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ সদস্যরা শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হলে সেখানে নিয়োগ দেয়া হয় সেনাবাহিনীকে। ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা, সেতু তৈরি বা মেরামতের দায়িত্ব পড়ে সেনাবাহিনীর উপর। দেশের বড় কোন সংকটের সমাধানে নিয়ে আসা হয় সেনাবাহিনীকে। সর্বশেষ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণসহ সার্বিক কাজে হ-য-ব-র-ল দেখা দিলে সেখানে তদারকির দায়িত্ব পড়ে সেনাবাহিনীর উপর। দেশের এমন কাজগুলোতে যদি সেনা মোতায়েন করে সুফল পাওয়া যায় তাহলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ন্যায় এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে সেনা মোতায়েন নিয়ে সরকার বা নির্বাচন কমিশনের কেন এত গড়িমসি। এমন প্রশ্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের। তারা বলছেন, দেশের বর্তমান সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা। যা নিয়ে শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও আলোচনা হচ্ছে। সবাই চাচ্ছে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন। যেখানে সব রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নেবে এবং ভোটাররা নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এছাড়া দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলও নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়ে আসছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার বা নির্বাচন কমিশন যদি আগামী নির্বাচনে সেনা মোতায়েন না করে তাহলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ন্যায় দেশে সহিংসতার মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। এমনকি নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাবারও আশংকা থেকে যাবে।
সূত্র মতে ২০০৮ সালের একটি প্রহসনের নির্বাচনের পর থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে যত নির্বাচন হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। যেখানে অর্ধেকেরও বেশী আসনে নির্বাচনই হয়নি। অন্যগুলোতেও ৫ শতাংশের বেশী ভোটারের উপস্থিতি ছিলনা। এছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন ছিল সমালোচনায় ভরা। জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের (ইউপি) ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ নজির ছিল ১৯৮৮ সালে। ওই নির্বাচনে ১০০ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রাণ ঝরেছিল ৮০ জনের। এর আগে ও পরে আরও সাতবার ইউপি নির্বাচন হয়। কিন্তু ২০১৬ সালেল নির্বাচন অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করল। ছয় ধাপে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় প্রাণ হারালেন ১৩৩ জন। বিনা ভোটে নির্বাচিত হলেন ২২০ জন চেয়ারম্যান। গুলীবিদ্ধ, পঙ্গুত্ব বরণসহ নানাভাবে আহত হয়েছেন ১০ হাজারের বেশি। মানুষ উৎসবের ভোটে লাগল কলঙ্কের দাগ। তবে এর দায় নিচ্ছে না কেউ। উপজেলা, মেয়র এমনকি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও ছিল একই চিত্র।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই এমন ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেন্দ্র দখল, হামলা, ব্যালটপেপার ছিনতাইয়ের দৃশ্য দেখে গেছে। তারা বলছেন, পুলিশ এখন আগের জায়গায় নেই। তারা এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গদলে পরিণত হয়েছে। যদি পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতো তাহলে অন্তত এত মানুষের প্রাণহানি ঘটতো না। তারা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ক্ষমতার পরিবর্তন হয় না। এখানে যদি পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থ হয় তাহলে সংসদ নির্বাচনে তাদের উপর কোনভাবেই আস্থা রাখা সম্ভব হবেনা। পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় জনগণ তাদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তাই জাতীয় সংসদের ন্যায় ক্ষমতার পালাবদলের এমন নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের কোনো বিকল্প থাকবেনা। কারণ অতীতে যখনই এমন পরিস্থিতিতে সেনা বাহিনী কাজ করেছে বা তাদের উপস্থিতি ছিল সেখানেই নির্বিঘেœ জনগণ ভোট দিয়েছে। হানাহানি বা কেন্দ্র দখলের ন্যায় কোনো ঘটনা ঘটেনি।
এদিকে নির্বাচন কমিশনও যেন সরকারের তল্পিবাহকে পরিণত হয়েছে। সেনা মোতায়েন নিয়ে যখনই রাজনৈতিক দলগুলো দাবি তোলে তখন তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। অনেকটা সরকারের সুরেই তারা কথা বলে। একইভাবে তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময়ও বলেছিল। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ তার সময়ে বলেছিলেন, সামগ্রিকভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। প্রাণহানি, কেন্দ্র দখল, ব্যালটপেপার লুটপাট এগুলো নিয়ে তার কোনো মতামত ছিল না। স্থানীয় সরকার বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দলীয় মনোভাবের কারণেই এমনটি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ছিল প্রকাশ্য প্রায়। তাইতো গত কয়েকবছরের স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সহিংস ও কলঙ্কিত নির্বাচন বলেও আখ্যায়িত করেছেন বিশ্লেষকরা।

সূত্র মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে কোনভাবেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই বিরোধী রাজনৈতিকদলসহ দেশের অধিকাংশ সংগঠনই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার এবং নির্বাচনের সময়ে সেনামোতায়েনের দাবি করে আসছে। এসব দাবিতে তারা আন্দোলনও করে যাচ্ছে। তবে সরকার তাদের অধীনেই আগামী নির্বাচন করতে চায় এবং সেনা মোতায়েনের বিষয়ে বারবার অনাগ্রহের কথা বলে যাচ্ছে। চলতি মাসেই দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাথে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোও নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, নির্বাচানকালীন সরকারসহ নানা দাবি জানিয়ে এসেছে। বিএনপির পক্ষ থেকেও এমন দাবি জানানো হবে। যদিও বিএনপি বলছে, এই নির্বাচন কমিশনে তাদের আস্থা নেই। এদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তারপরও একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে তারা ইসির আহবানে সাড়া দিয়ে সংলাপে অংশ নেবে।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র এক নেতা এ প্রতিবেদককে জানান, নির্বাচন কমিশনের সাথে অনুষ্ঠিতব্য সংলাপের বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে একটি খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। খসড়া প্রস্তাবনায় সবার মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ বা পুনর্বিন্যাস, প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসিয়ান ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনী এলাকায় টহলসহ ভোটকেন্দ্রে ও বিশেষ বিশেষ স্থানে মোতায়েনের ব্যবস্থা গ্রহণ করার উপর জোর দেয়া হয়েছে। এছাড়া সব রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য, কিন্তু বিভিন্ন মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় কারান্তরীণ রয়েছেন, তাদের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ নিশ্চিত করা, প্রত্যেক কেন্দ্রে ভোট গণনার সময় ওই কেন্দ্রের প্রত্যেক বুথে প্রার্থী কর্তৃক নিযুক্ত পোলিং এজেন্টকে অবশ্যই উপস্থিত রাখা, মাঝখানে কোনো বিরতি না দিয়ে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণনা শুরু করা, তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত নির্বাচনী আইন, আচরণবিধি ও অন্যান্য নির্বাচনী বিধিবিধান ভঙ্গের অভিযোগপত্র এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয়ে দাখিলকৃত অভিযোগপত্র গ্রহণ ও লিখিত প্রাপ্তি স্বীকার এবং তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর প্রতিবিধান করার উপর জোর দেয়া হবে।

সূত্র মতে, গত জুলাইমাসে সুধীসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রথম মতবিনিময় করেন নির্বাচন কমিশনাররা। (ইসি) আয়োজিত সেই সংলাপে সুধীসমাজের প্রতিনিধিদের বেশির ভাগই আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগের সুপারিশ করেছেন। সংলাপ শেষে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইসি তাদের কোনো বক্তব্য খ-ন করার চেষ্টা করেনি। শুধু শুনেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও প্রেস ব্রিফিংয়ে সুধীসমাজের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে এসব প্রস্তাব পেয়েছেন বলে জানান।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে হলে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়া নির্বাচনী ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো, নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধার, ইসিকে মানুষের আস্থা অর্জন ও স্বাধীন ভূমিকা মানুষের কাছে দৃশ্যমান করতে হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ভোটার, প্রার্থী, নির্বাচনী কর্মকর্তা, কর্মচারী সবার মধ্যে ভয়মুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে ভোটকেন্দ্র বন্ধে প্রিজাইডিং অফিসারদের দায়িত্ব দিতে হবে। সেনা মোতায়ন কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা নিয়ে আরও আলোচনা করতে হবে।

সংলাপে অংশ নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত অলিউর রহমান বলেন, সংলাপে আলোচনায় মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এখানে আর্মি নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। তবে অনেকে বলেছে, ভোটে তাদের আনার দরকার নাই।
সুশিল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে সংলাপ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, বেশিরভাগ বক্তা নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগের কথা বলেছেন। তাদের সুপারিশ সেনাবাহিনীকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-এ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় আনা হোক। আবার কয়েকজন বলেছেন, সেনাবাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করলে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর ক্ষমতা খর্ব হবে এবং তারা দায়িত্ব পালনে উৎসাহ হারাবে। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা পুরোপুরি প্রয়োগের কথাও বলেছেন অনেকে। পেশিশক্তি নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ এসেছে। না ভোটের বিধান পুনর্বহালেরও দাবি জানিয়েছেন অনেকে।

সূত্র মতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো দেড় বছর বাকি। ইতোমধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ইস্যুতে রাজনীতি জমে উঠেছে। এবারও এটি নিয়ে দুই মেরুতে অবস্থান নিয়েছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই দলের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ। কেউ ছাড় দিতে নারাজ। চলছে কথার লড়াই। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ। গত কয়েক বছর বিএনপি ‘সহায়ক সরকারের’ অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ জন্য প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন চায় দলটি। এই দাবির সাথে অনেক আগে থেকেই একমত ছিল বিদেশীরাও। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ প্রভাবশালী দেশগুলোও বাংলাদেশের হারানো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়ে আসছে। এজন্য তারা বাংলাদেশকে সহায়তা দিতেও প্রস্তুত। এবার এর সাথে যোগ হয়েছে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের সমর্থনও। তারা বলছেন, নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করতে সহায়ক সরকারের কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া সেনাবাহিনী মোতায়েন করে তাদের মেজিস্ট্রেসি ক্ষমতাও দেয়ার কথা বলেছেন তারা। বিপরীতে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বিষয়টি মীমাংসিত। সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে।

http://www.dailysangram.com/post/302688