৯ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ৯:৩৯

ভারতের অর্থনীতি দুই অরুণের দুই মত

তৃতীয় নয়ন

মীযানুল করীম
ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ঢাকা সফর করে গেছেন। তার সফরকালে বাংলাদেশের সাথে ভারতের বিরাট অঙ্কের ঋণচুক্তি সই হয়েছে। তিনি ঢাকায় আলোচনা সভায় বক্তব্যও রেখেছেন। বিজেপি সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে অরুণ জেটলি কিছু দিন আগে পর্যন্ত প্রতিরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও দেখাশুনা করেছেন। বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উপস্থিতি এবং ভারতের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের সম্ভাবনা ও সমস্যার প্রেক্ষাপটে জেটলির এই সফর বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকার পত্রিকায় একটি বড় খবর ছিল, স্থানীয় এক আলোচনা অনুষ্ঠানে অরুণ জেটলির বক্তৃতা। বিষয় : ভারত সরকারের বৃহত্তর অর্থনৈতিক উদ্যোগ। এতে তিনি মোদি সরকারের ‘অর্থনৈতিক সাফল্য’ তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে নোট বাতিল, দুর্নীতি রোধ, রাজস্ব আয়বৃদ্ধি, দরিদ্রের কল্যাণ প্রভৃতি বিষয়ের উল্লেখ করে নয়া দিল্লি সরকারের ‘কৃতিত্ব’ উপস্থাপন করেছেন।

অপর দিকে, একই দিন কোনো কোনো পত্রিকায় পাশাপাশি ছাপা হয়েছে ভারতের বিজেপি সরকারেরই একজন সাবেক মন্ত্রী ও অর্থনীতিবিদ অরুণ শৌরির বক্তব্য। ভারতের বর্তমান মন্ত্রী অরুণ জেটলি গত বছর বড় অঙ্কের নোট বাতিলকে অর্থনীতির জন্য নানাভাবে সুফলদায়ক হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। আর একই দলের সাবেক মন্ত্রী অরুণ শৌরি বলেছেন, ‘এই নোট বাতিল করার সিদ্ধান্ত অর্থনীতির জন্য আত্মহত্যার শামিল।’
কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, অরুণ জেটলি অর্থনীতির যেসব বিষয়ে নিজেদের ‘সফলতা’ বর্ণনা করে বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলো সম্পর্কে অরুণ শৌরি সম্পূর্ণ বিপরীত অভিমত প্রকাশ করেছেন। এগুলো তার দৃষ্টিতে, বর্তমান ভারত সরকারের সাফল্য নয়, ব্যর্থতা।

অরুণ শৌরি মোদি সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এনডিটিভিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সে বক্তব্য হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা ছাপিয়েছে। শৌরি ২০০২ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। ভারতীয় বার্তা সংস্থা আইএএনএস জানায়, অরুণ শৌরি মোদি সরকারকে ব্যঙ্গবিদ্রƒপও করেছেন। তিনি রসিকতা করে বললেন, ‘নরেন্দ্র মোদির এই সরকার তো আড়াইজনের গভর্নমেন্ট। এটা চালাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি নেতা অমিত শাহ আর একজন উকিল যিনি তাদের ঘরের লোক।’
কৌতুক করে অরুণ শৌরি বলেছেন, ‘যত রেড সিগন্যাল জ্বলে উঠুক, বর্তমান সরকার তার গতিপথ বদলাবে বলে আশা করা যায় না। কারণ, সরকারটার স্বভাবই এমন। মোদি সরকার নির্বাচনী প্রপাগান্ডা ও গলাবাজিতে ওস্তাদ।’
শৌরির মতে, সরকারের নীতির তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকা চাই : ক. এই নীতিসম্পর্কে আগে থেকে আভাস দেয়া যায়। খ. নীতির মধ্যে স্থিতিশীলতা থাকতে হয়। গ. নীতির ব্যাপারে আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকা আবশ্যক। এখন ভারত সরকারের নেয়া পলিসিগুলোতে এসব বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায় না। সরকার থেকে কী প্রত্যাশা করা যায়, সে সম্পর্কে বিনিয়োগকারী ও শিল্প খাত নিশ্চিত হতে পারছে না। নোট বাতিল কিংবা গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্সের (জিএসটি) বেলায় দেখা গেল, আসমানী আওয়াজের মতো আকস্মিক ঘোষণায় সবাই চমকে ওঠার পর সরকার কিছু পলিসি মেরামত করল।
অরুণ শৌরি ক্ষমতাসীন মোদি সরকার সম্পর্কে বলেছেন, তাদের আসল যোগ্যতা হচ্ছে, ঘটনা সামাল দেয়া। এ ব্যাপারে তারা খুবই আত্মসন্তুষ্ট। তারা একজন আরেকজনকে ব্রিফিং দেয়ায় ব্যস্ত; অথচ অন্যদের কথা কানে তোলেন না। ৩০০ ফুট উঁচু ভাস্কর্য আর বুলেট ট্রেনই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

এবার মোদি সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন পূর্ববর্তী বিজেপির সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা। তার বক্তব্যের জবাব দিতে ব্যর্থ হয়ে বিজেপি দল ও সরকারের নেতারা তাকে বলেছেন, ‘একজন হতাশ ব্যক্তি’। অরুণ শৌরি বিজেপির এমন মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটাই ওদের আচরণের মান।’
নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেই এমন প্রচারাভিযান শুরু করলেন এবং কিছু পদক্ষেপ নিলেন যে, মনে হলোÑ ভারতে এবার বিদেশী বিনিয়োগের বান ডাকবে এবং দেশটি অর্থনীতির মহাশক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। কিন্তু বাগাড়ম্বরের সাথে বাস্তবতার ব্যবধান কম নয়। অর্থনীতিবিদ অরুণ শৌরি এটাই তুলে ধরেছেন। বিজেপির সাবেক মন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা, কংগ্রেসের সাবেক মন্ত্রী পি. চিদাম্বরমসহ অর্থনীতির বিশিষ্টজনদের অনেকেই বাস্তব অবস্থার উল্লেখ করছেন পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে।
অরুণ শৌরি বলেছেন, এসব তথ্য-পরিসংখ্যানের উৎস হচ্ছে সরকারি রিপোর্ট; যেমনÑ ইকোনমিক সার্ভে, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বিভিন্ন সার্ভে, সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্ট ইত্যাদি।

শৌরি বলেন, যে ‘আড়াই ব্যক্তি’ এই সরকার পরিচালনা করছেন, তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা নেই। অযোগ্য লোকজন তাদের ঘিরে রেখেছেন। তারা রুদ্ধকক্ষে অবস্থান করছেন। ফলে বাইরের শব্দ তারা শুনতে পান না। রিজার্ভ ব্যাংক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বেহাল দশা তুলে ধরেছে। এই হতভাগ্যরা যতই শোরচিৎকার করুক, কেউ শোনেনি তাদের কথা।
সমালোচকদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন বিজেপি মহলের মনোভাব প্রসঙ্গে অরুণ শৌরি বলেন, যখনই কোনো তথ্য তাদের জন্য অসুবিধাজনক মনে হয়, তারা গালিগালাজ করে তা ধামাচাপা দেয়ার প্রয়াস পান। যশোবন্তকে তারা ‘হতাশ’ বলছেন। কারা হতাশ বলে তারা মনে করেন, এর একটা তালিকা আগাম প্রকাশ করা তাদের উচিত। শৌরি বলেছেন, ‘যারা এখন সরকার চালাচ্ছেন, তারা কোনো পরামর্শ চান না কিংবা বাস্তব অবস্থার কথাও শুনতে চান না।’

যে ‘আড়াই’জন বিজেপি সরকার চালাচ্ছেন বলে অরুণ শৌরির বিশ্বাস, তাদের একজন হলেন প্রবল প্রতাপশালী নেতা অমিত শাহ। তাকে ‘বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ’ বলে বিদ্রƒপ করে শৌরি বলেন, ‘ভারতের অর্থনীতি যে মন্থর হয়ে পড়েছে, এর টেকনিক্যাল কারণ আছে বলে অমিত উল্লেখ করেছেন। তবে কথা হলো, সরকারের দেয়া তথ্য-পরিসংখ্যান কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখা যায় না।’
ইসলাম ধর্মে ‘ইলহাম’ পরিভাষাটি প্রচলিত। এর অর্থ হলো উচ্চপর্যায়ের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের অন্তরে সৃষ্ট অলৌকিক উপলব্ধি। হিন্দুত্ববাদী মোদির সরকার যেন ‘ইলহাম’ দ্বারা পরিচালিতÑ অরুণ শৌরি ব্যঙ্গ করে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘মনে হলো একরাতে নরেন্দ্র মোদি যেন ইলহামের মাধ্যমে ঐশী নির্দেশ পেলেন, মুদ্রার নোট বাতিল করা উচিত। তিনি এই সাহসী পদক্ষেপ নিলেন। তবে মনে রাখবেন, আত্মহত্যাও এক ধরনের সাহসী পদক্ষেপ। ’

অপর দিকে, মোদি সরকারের বর্তমান অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির ঢাকা সফরের পেছনে একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ায় প্রেরণাদায়ক, ক্যাশলেস ইকোনমি বা নগদবিহীন অর্থনীতির প্রচারণা। বুধবার একটি অনুষ্ঠানে তিনি এর বিভিন্ন সুফল বর্ণনা করে এ ক্ষেত্রে মোদি সরকারের ‘অবদান’ উপস্থাপন করেন। ভারতের স্টেট ব্যাংক এবং বাংলাদেশে ঋণের অর্থ জোগানো এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার যৌথভাবে আয়োজিত এই আলোচনা সভায় বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উপস্থিত ছিলেন।

অরুণ জেটলি ক্যাশলেস বা নগদ লেনদেনবিহীন অত্যাধুনিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভারতের অগ্রগতি প্রসঙ্গে বলেন, মোদি সরকার ভারতের বাজারে নগদ অর্থ কমাতে কাজ করে যাচ্ছে। কারণ নগদ মানে দুর্নীতির সুযোগ আর গরিবের গায়ে আঘাত। নগদ লেনদেন কর ফাঁকির পথ করে দেয়, দুর্নীতি করতে উৎসাহ জোগায় এবং ‘ছায়া অর্থনীতি’র দিকে এগিয়ে নেয়। ভারতীয় অর্থনীতির বিরাট অংশই নগদনির্ভর হয়ে পড়েছিল এবং এর সাথে বিদ্যমান ছিল নগদের অভিশাপও। নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়ে প্রথম দিন থেকেই ধাপে ধাপে এগিয়েছে কম নগদ অর্থের বাজার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
জেটলি বলেন, ‘নগদভিত্তিক লেনদেন কমাতে ভারত সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো, বড় অঙ্কের অর্থের যে কাগুজে মুদ্রা বা নোট, তা বাতিল করে দেয়া। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন নগদে লেনদেন কম। অপর দিকে বেড়েছে ডিজিটাল লেনদেন, বেড়েছে আয়করও।’

উল্লেখ্য, গত বছর, নভেম্বর মাসে মোদি সরকার হঠাৎ ৫০০ ও এক হাজার রুপির নোট বাতিল করে দিলে, বিরাট দেশটির অসংখ্য মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েন। লেনদেন প্রায় বন্ধ হয়ে জনজীবনে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। জনগণের মধ্যে সরকারের এই পদক্ষেপের তীব্র ও ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের ব্যর্থতাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, উদ্দেশ্য যাই হোক, এত বড় একটা সিদ্ধান্তের কী প্রভাব প্রতিক্রিয়া হবে, তা অনুধাবন না করে পদক্ষেপটি গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন মহল জনদুর্ভোগ মোচনে প্রস্তুতিহীনতার জন্য দিল্লি প্রশাসনের সমালোচনা করেছে। মোদির আগের সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও অর্থনীতিবিদ ড. মনমোহন সিং নোট বাতিল করে দেয়ার আকস্মিক সিদ্ধান্তকে অদূরদর্শী বলে অভিহিত করেন।
অরুণ জেটলি তাদের অর্থনৈতিক সংস্কারের সাফল্যের বয়ান দিতে গিয়ে ঢাকায় গর্বের সাথে বলেছেন, এখন ভারতে নগদ অর্থের প্রবাহ যেমন সঙ্কুচিত হয়েছে, তেমনি সন্ত্রাসবাদীরাও বিষম চাপে পড়েছে। অথচ বিজেপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও অর্থনীতিক অরুণ শৌরি বলেছেন, নোট বাতিলের পক্ষে এই সরকারের কোন যুক্তিটা খাটে? কালো টাকা? সব কালো হয়ে আছে সাদা। সন্ত্রাসবাদ? এখনো সন্ত্রাসীরা ভারতে ঢুকছে। শেষ পর্যন্ত সরকারের বলার মতো আর যুক্তি থাকে না।’ ভারতের অর্থনীতি গত তিন বছরে, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিশ্বের সর্বাধিক দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি হয়েছেÑ অরুণ জেটলি এ কথা বললেন ঢাকায় এসে। এর বিপরীতে অরুণ শৌরি বলেন, ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) ৩ দশমিক ৭ শতাংশ কমে গেছেÑ এটা বাস্তব না অন্য কিছু? ভারতে শিল্প উৎপাদনের সূচক ২০১৫-১৬ সালে ছিল ৯ শতাংশ। গত এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে তা কমে ১ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা কি উদ্বেগের ব্যাপর নয়?’

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/258031