৯ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ৯:৩৮

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তো ১ মাসের ছুটিতে গেলেন: কিন্তু তারপর?

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটির পর সরকারের তরফ থেকে এ পর্যন্ত দুইজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এ ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছেন। এর একজন হলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং অপরজন হলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। অন্যদিকে বিরোধী দল থেকেও অনেকেই বক্তব্য দিচ্ছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং প্রাক্তন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ। আইনজীবী নেতাদের মধ্যে রয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট বারের প্রাক্তন সভাপতি এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের বর্তমানসহ সভাপতি এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং সুপ্রিম কোর্ট বারের বর্তমান সভাপতি এ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। প্রধান বিচারপতির ১ মাসের ছুটিকে সরকার পক্ষ যেভাবে ব্যাখ্যা করছেন, বিরোধী পক্ষের ব্যাখ্যা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ইতোমধ্যেই তার ছুটিকে কেন্দ্র করে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বিরোধী দলের তরফ থেকে প্রকাশ করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার প্রেস ক্লাবের একটি আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং প্রাক্তন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এমন কয়েকটি তথ্য প্রকাশ করেছেন যেগুলো শুনলে চমকে উঠতে হয়। শুক্রবারের পত্রপত্রিকায় এসব খবর প্রকাশিত হয়েছে। যেসব খবরাখবর প্রকাশিত হচ্ছে সেসবের কতগুলো সত্য এবং কতগুলো গুজব সেটি আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে এসব বিষয় চিরদিন চাপা থাকে না। দেরিতে হলেও আসল সত্যটি বেরিয়ে আসে।

সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ১ মাসের ছুটি নিয়ে ফেসবুকে যে প্রবল ঝড় উঠেছে তেমন প্রবল ঝড় আমি বিগত ৮/১০ বছরে কখনো দেখিনি। তার পরেও ফেসবুকে প্রকাশিত বিভিন্ন ঘটনা বা তথ্যাবলী এখন পর্যন্ত সংবাদ বা কলামে তেমন একটা ব্যবহার করা হয় না। আমিও তাই আজকের এই লেখায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে কোনো রেফারেন্স হিসেবে উদ্ধৃত করা থেকে বিরত থাকছি। রাজনীতির বাতাসে গুজবের মত অনেক কথা ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেকদিন পর দেখলাম এই একটি বিষয়, অর্থাৎ সুরেন্দ্র বাবুর এক মাসের ছুটি নিয়ে হাটে, মাঠে, ঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে, অফিসে আদালতে, চায়ের দোকানে অর্থাৎ সর্বত্র তুমুল আলোচনা হচ্ছে। এসব আলোচনার সারবস্তু আমাদের কানে আসছে। কিন্তু সে সব আলোচনায় আমরা কান দিচ্ছি না। পত্রপত্রিকায় এসব ব্যাপারে এ পর্যন্ত যা কিছু ছাপা হয়েছে তার দু’চারটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি। আমরা নিজ থেকে কিছুই বলছি না।
॥দুই॥
গত ৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার একটি আলোচনা সভায় প্রাক্তন আইনমন্ত্রী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এ ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন, যার অনেকগুলো খবরের কাগজে এসেছে। তিনি বলেছেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির ছুটির আবেদনকে ভুয়া ও জালিয়াতি দাবি করে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতির অসম্মতিতে তাকে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এখন তাকে বিদেশ পাঠানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকার নিজেই বিচার বিভাগের মৃত্যু ঘটিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, তার অসুস্থতার কথা বলে তার অসম্মতিতে তাকে ১ মাসের ছুটিতে পাঠানো হচ্ছে। অথচ তার মাত্র কয়েকদিন আগে সুস্থ মানুষ হিসেবে জাপান এবং কানাডা ঘুরে এসেছেন তিনি। তিনি যদি ক্যান্সারে আক্রান্ত হতেন তাহলে এসব দেশেই তিনি চিকিৎসার জন্য ভর্তি হতেন।
মওদুদ আহমেদ বলেন, প্রধান বিচারপতির ছুটির দরখাস্ত হিসেবে যে চিঠিটি সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী দেখিয়েছেন সেটি ভুয়া। তিনি বলেন, এই চিঠিতে ৫টি বানান ভুল। এত ভুলে ভরা কোনো চিঠিতে কোনো প্রধান বিচারপতি স্বাক্ষর করতে পারেন না। এছাড়া বাংলায় সচরাচর তিনি যে স্বাক্ষর দান করেন সেই স্বাক্ষরের সাথে আলোচ্য ছুটির চিঠিতে প্রদত্ত স্বাক্ষরের কোনো মিল নেই। তিনি অভিযোগ করেন যে, প্রধান বিচারপতির সাথে কাউকে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি তার আত্মীয় স্বজনদেরকেও তার সাথে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না। তার বাসার টেলিফোন লাইনটিও বিচ্ছিন্ন। তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
গত ৬ অক্টোবর শুক্রবার ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এজের’ প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যে, আগের দিন অর্থাৎ ৫ অক্টোবর দুপুর ১২টার দিকে ভিসার জন্য প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সস্ত্রীক ভিসা সেন্টারে গিয়েছিলেন। ঐ দিনই বিকাল বেলা তাকে ৫ বছরের জন্য অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার এবং অবস্থান করার ভিসা দেয়া হয়েছে। ঐ খবরে আরো বলা হয়েছে যে, আগামী ১০ অক্টোবর মঙ্গলবার তিনি অস্ট্রেলিয়া যাবেন। অস্ট্রেলিয়াতে তার ছোট মেয়ে স্থায়ীভাবে সপরিবারে থাকেন। তার বড় মেয়ে সপরিবারে স্থায়ীভাবে কানাডা থাকেন। এখন সিনহা বাবু কি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন স্বেচ্ছায়, নাকি বিরোধীদলের অভিযোগ মোতাবেক তিনি চাপে পড়ে যাচ্ছেন সেটি বেরিয়ে আসবে সময়ের আবর্তনে।

গত ৩/৪ দিন ধরে পত্রপত্রিকায় এবং টেলিভিশনে যেসব খবর আসছে সেসব খবর থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ছুটি নেয়ার পর এ পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে কয়েকজন ভিআইপি তার সাথে তার বাসভবনে গিয়ে দেখা করেছেন। কিন্তু বিরোধীদল তো দূরের কথা, বার সমিতির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ তার সাথে দুই দফা দেখা করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। দুই বারই নিরাপত্তা বাহিনী তাদেরকে দেখা করতে দেয়ায় বাধা দিয়েছে। ইতোমধ্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তার সাথে দেখা করেছেন। তবে প্রধান বিচারপতি বিদেশ যাচ্ছেন কিনা সে ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না বলে সাংবাদিকদের বলেছেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভি প্রধান বিচারপতির সাথে দেখা করেছেন। সাংবাদিকরা তার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু তিনি তাদেরকে এড়িয়ে যান। এর মধ্যে তিনি লক্ষী পূজার দিন সস্ত্রীক ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যান। সেখানে তার সাথে দেখা হয় হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের নেতা রানা দাশ গুপ্ত এবং সুব্রত চট্টোপধ্যায়ের। তারা উভয়ই বলেন যে, প্রধান বিচারপতিকে তারা সুস্থ দেখেছেন। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রারও প্রধান বিচারপতির সাথে দেখা করেছেন। তারাও বলেছেন যে তাদের কাছে প্রধান বিচারপতিকে সুস্থ মনে হয়েছে।
॥তিন॥
চিত্রের অপর পিঠ সম্পূর্ণ আলাদা। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবীদের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেটির নাম সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। এর যারা কর্মকর্তা তারা সকলেই সহস্রাধিক আইনজীবী কর্তৃক গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত। এই সমিতির বর্তমান নির্বাচিত সভাপতি হলেন এ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন এবং সাধারণ সম্পাদক হলেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। এর আগে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সহসভাপতি।

সুপ্রিম কোর্ট বার এবং বার কাউন্সিলের শীর্ষ নেতারা প্রথম দফায় অর্থাৎ ৩ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির সাথে সাক্ষাতের জন্য তার বাসভবনে যান। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র বিচারপতি। বাস ভবনে গেলে বার সমিতির প্রতিনিধি দলকে নিরাপত্তা রক্ষীরা প্রথমে জানায় যে তিনি অসুস্থ। কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় দফায় খোঁজ নিতে বললে বলা হয় যে তিনি সুস্থ আছেন, তবে দেখা হবে না। গতকাল ৭ অক্টোবর শনিবার বার সমিতি নেতৃবৃন্দ পুনরায় তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট ভবন থেকে রওয়ানা হন। কিন্তু মৎস্য ভবন পর্যন্ত যাওয়ার পর সাদা পোশাকধারী পুলিশ তাদের গাড়ি থামায় এবং তার বাসভবন পর্যন্ত যেতে বাধা দেয়। নেতৃবৃন্দ তখন বাধ্য হয়ে ফিরে আসেন। অথচ অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম একাধিকবার বলেছেন যে, প্রধান বিচারপতির সাথে দেখা করতে কোনো বাধা নেই। তবে তিনি অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি কারো সাথে দেখা করবেন কিনা সেটা তার নিজের ব্যাপার। যাই হোক, গতকাল প্রধান বিচারপতির সাথে দেখা করতে সমর্থ না হওয়ায় নেতৃবৃন্দ ফিরে আসেন এবং সুপ্রিম কোর্টে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে সাক্ষাতে বাধা দেয়ার প্রতিবাদে এবং বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা রক্ষার দাবিতে আজ রোববার থেকে দেশের সব জেলা বারে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির শহীদ সফিউর রহমান মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেয়া হয়। সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সমিতির সভাপতি এডভোকেট জয়নুল আবেদিন।
লিখিত বক্তব্যে সমিতির সভাপতি বলেন, বিচার বিভাগের প্রধান কর্তাব্যক্তি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নিজেই স্বাধীন নন, পরাধীন। সরকার তাঁকে বল প্রয়োগ করে ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছে যা বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের প্রতারণা। বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা রক্ষায় আগামী রোববার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রতিদিন দেশের সব জেলা বারে আইনজীবীরা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা পালন করবেন। ১২ অক্টোবর বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও জানান আইনজীবী সমিতির সভাপতি।
॥চার॥
এই হলো প্রধান বিচারপতির ১ মাসের ছুটিকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ। আমরা আগেই বলেছি যে এখানে আমরা আমাদের নিজস্ব কোনো মন্তব্য দেবো না বা নিজেদের কোনো এক্সক্লুসিভ নিউজ দেবো না। প্রধান বিচারপতি ১ মাসের ছুটিতে যাওয়ায় সংবিধানের ৯৭ ধারা মোতাবেক বিচারপতি জনাব আবদুল ওয়াহাব মিঞাকে অস্থায়ী বিচারপতির দায়িত্বভার দেয়া হয়েছে। তিনিও নিয়ম মাফিক তার দায়িত্ব সম্পাদন করে যাচ্ছেন। তার পরেও সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শিক্ষিত সচেতন মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাবু এস কে সিনহা তো ১ মাসের ছুটিতে গেলেন। কিন্তু ১ মাস শেষ হলে অর্থাৎ ২ অথবা ৩ নভেম্বর কি হবে? বাবু সিনহা কি প্রধান বিচারপতি হিসেবে আবার ফিরে আসবেন? নাকি তার ছুটি বৃদ্ধি হবে? যদি ছুটি বৃদ্ধি পেতে থাকে তাহলে কতদিন সেটি চলবে? আগামী বছরের ৩১ জানুয়ারি তার চাকরির মেয়াদ শেষ হবে। ধারণা করা হচ্ছে যে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি প্রধান বিচারপতিই থাকবেন। তবে সক্রিয় থাকবেন নাকি নিস্ক্রিয় থাকবেন সেটি এই মুহূর্তে কেউ বলতে পারছেন না। যা ঘটবার তা ঘটে গেছে। তবে আগামীতে কি ঘটবে সেটি দেখার জন্য মানুষ ব্যাকুল আগ্রহে তাকিয়ে আছে।
Email: asifarsalan15@gmail.com

http://www.dailysangram.com/post/302629