৮ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১১:০১

মংডু শহরের আরো ৫ মুসলিম মহল্লায় মগসৈন্যদের অগ্নিসংযোগ

মংডু পৌরসভার ৫টি মুসলিম মহল্লায় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে অগ্নিসংযোগ করেছে বর্মী সৈন্যরা। এতে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে নূন্যতম ৩ শতাধিক ঘর-বাড়ি। তবে কোন প্রাণ নাশের ঘটনা ঘটেছে কিনা তা জানা যায়নি।
সূত্র জানিয়েছে, শহরের ৩নং ওয়ার্ডের সিনেমা হলের পূর্ব পাশের মুসলিম মহল্লায় সন্ধ্যার পরপর মগসেনারা অগ্নিসংযোগ করে। এরপর নয়াপাড়া, পূর্ব পাড়া, পশ্চিম পাড়া ও সুন্দরী পাড়ার ঘরবাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয় সেদেশের কথিত আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় সময় রাত সাড়ে নয়টার দিকে মাঙ্গালা পাড়ায় আগুন দেয় সেনা সদস্যরা। এসময় শতাধিক রাখাইন মুসলিম বিরোধী সেøাগান দিয়ে রোহিঙ্গাদের ধাওয়া করে। শহরের অভ্যন্তরে অগ্নিসংযোগ করলেও কোন ফায়ার সার্ভিস কর্মী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়নি।
সূত্র আরো জানিয়েছে, বর্মী বাহিনীর নৃশংসতা শুরু হওয়ার পর এসব মহল্লার অধিকাংশ রোহিঙ্গা মুসলিম আগেভাগে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে আশ্রয় নিতে রওয়ানা দিয়েছে। যারা সাহস করে থেকে গিয়েছিল, তারাও আর থাকতে পারছেন না।
জানা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মংডু অঞ্চলের ৯০ ভাগ গ্রাম রোহিঙ্গাশূণ্য হয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের ৭০ ভাগ বসতবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে রাখাইন ও মগসেনারা। রোহিঙ্গাদের ছেড়ে যাওয়া কিছু কিছু উন্নতমানের দ্বিতল কাঠের বাড়িঘর অক্ষত রাখা হয়েছে। সেসব দখলে নিচ্ছে স্থানীয় রাখাইনরা।
নাফের উপকূলে এখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়ের আশায় বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষমান। যারা মাথাপিছু হাজার টাকা নৌকাভাড়া দিতে সক্ষম, শুধু তারাই পাড়ি দিতে পারছে। অন্যরা খেয়ে না খেয়ে আল্লাহর উপর ভরসা রাখছে।
একটি আরাকানী কুকুর একটি ইতিহাস!

শাহনেওয়াজ জিল্লু, কক্সবাজার : নাম তার লাইল্যা। গায়ের রঙ লাল বলেই আদর করে সবাই এ নামে ডাকে। পরিবারের সবার সাথে গলায় গলায় ভাব। দুষ্কৃতকারীর কাছ থেকে ঘরের মানুষকে সুরক্ষা আর নৈশপ্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা তার প্রধান কাজ। এর বাইরে তার অতি প্রভুভক্তি দেখার মতো। বলছিলাম একটি চার বছর বয়সী আরাকানী কুকুরের কথা ! বুথিদং উপজেলার জাংহামাস্থ মো. সাদেকের গৃহপালিত পশু সেই লাইল্যা এখন বাংলাদেশে! কিন্তু কিভাবে?
বলছি। আজ থেকে দশ বারো দিন আগে বর্মী সৈন্যরা জাংহামা রোহিঙ্গা পল্লীতে হামলা চালিয়ে রোহিঙ্গাদের ধাওয়া করে। লুটপাট চালায় তাদের বাড়িঘরে। পরে অগ্নিসংযোগ করে সকল বসতি জ্বালিয়ে দেয়। এসময় জ্বলন্ত বাড়িঘরের সামনে প্রাণপনে ঘেউ ঘেউ করে বর্মী সৈন্যদের হুংকার ছাড়ে লাইল্যা। কিন্তু তার দিকেও রাইফেল তাক করে গুলী চালাতে থাকলে দৌঁড়ে পালায় সে। সাদেক ও তার পরিবার সেনাবাহিনীর বর্বরতা থেকে বাঁচতে পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। লাইল্যাও কাঁদতে কাঁদতে মনিবের সাথে থেকে যায়।
অবস্থা বেগতিক দেখে আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশ পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সাদেক। পাহাড়ি দূর্গম পথ বেয়ে বাংলাদেশের দিকে পা বাড়ায় সাদেকের পরিবার। কুকুরটিও গৃহস্তের পিছু নেয়। কখনও আগে কখনও পরে মনিবের পরিবারকে সুরক্ষা দিয়ে সামনে চলতে থাকে প্রহরীর ন্যায়। বিল-ঝিল, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত মাড়িয়ে সীমান্তের কাছে পৌঁছতে তাদের ৩০ মাইলের মতো পথ হাঁটতে হয়। নাফ নদীর কিনারায় তাবু ফেলে সাদেক। অপেক্ষা নদী পার হওয়ার। শুধু সাদেকের পরিবার নয়, আশ্রয় সন্ধানী হাজারও রোহিঙ্গার জমায়েত নাফের পাড়ে।

একে একে পাঁচদিন খেয়ে না খেয়ে কাটায় সাদেকের পরিবার। কুকুরটিও এদিক সেদিক ঘুরে আবারও মনিবের কাছে চলে আসে। সাদেকের পরিবার নৌকায় ওঠার আগে কুকুরটির গায়ে হাত বুলিয়ে শেষ বিদায় জানায়। যেখানে খুশি চলে যাওয়ার জন্য ইশারা ইঙ্গিত করে। নৌকার ইঞ্জিন স্টার্ট হয়। ছন্দ মিলানো ইঞ্জিনের শব্দগুলো ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করে নৌকা। ওপার থেকে কুকুরটি হুঁ হুঁ করে ডাক ছেড়ে কাঁদতে থাকে। নদী পারের এদিক সেদিক ছুটাছুটি করে আর একের পর এক ডাক ছাড়ে। সাদেকের পরিবারের সদস্যরা তা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু তারা অসহায়।
কিছুক্ষণপর নদীতেই ঝাপ দেয় লাইল্যা। শরীরের জোর দিয়ে জোয়ারের বিপরীতে সাঁতরাতে শুরু করে। মনিবকে বহনকারী নৌকা যে দিকে গেছে সেদিকে ছুটতে থাকে। দুর থেকে সাদেকদের নজরে আসে লাইল্যা সাঁতরিয়ে আসছে।
এবার সাদেক নৌকার মাঝিকে কুকুরটিকে তোলার জন্য কাঁকুতি মিনতি করে। প্রয়োজনে আরো একজনের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলে। মাঝি আশ্বস্থ হয়ে নৌকা ঘুরিয়ে কুকুরটিকে তোলে নেয়।
ঘন্টাখানেক পর টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে ভীড়ে সাদেকদের বহনকারী নৌকা। আশ্রয় সন্ধানী দল নৌকা থেকে কূলে ওঠে। সাথে কুকুরটিও। আর সেখানেই দেখা মিলে সাদেক ও তার কুকুর লাইল্যার। তারপর প্রভুভক্ত কুকুরটির আদ্যোপান্ত জানায় সাদেক। রোহিঙ্গা নীপিড়ন উপখ্যান ইতিহাসে স্থান পাওয়ার যোগ্য এ কুকুর লাইল্যা।

http://www.dailysangram.com/post/302456