৮ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১০:৫৭

ট্রাম্পের প্রতি কংগ্রেসম্যানদের আহ্বান

সামরিক নিষেধাজ্ঞা দিন

রাখাইনে চলছে ‘পুরোদস্তুর জাতিগত নিধন’ * রাখাইনে আরও দুই লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু * নমনীয় অবস্থান নিয়ে কংগ্রেসের শুনানিতে তোপের মুখে মার্কিন মন্ত্রী
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নেতারা মিয়ানমারের সামরিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নিধনযজ্ঞ চলছে তা ‘পুরোদস্তুর জাতিগত নিধন’।

রিপাবলিকান দলীয় কংগ্রেস সদস্য স্কট পেরি বলেছেন, ‘ আমরা এখানে স্যুট পরে বসে আছি, আর ওখানে মানুষ খুন হচ্ছে, তাদের নিজ দেশ থেকে উৎখাত করা হচ্ছে। কাউকে না কাউকে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের (কংগ্রেস) পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে শুনানিতে এসব বিষয় উঠে আসে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাট্রিক মার্ফি বলেছেন, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে না যায়। তিনি হুশিয়ার করে দিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নিধনযজ্ঞ অব্যাহত থাকলে আন্তর্জাতিক জঙ্গিরা মিয়ানমারে অনুপ্রবেশ করতে পারে এবং এর ফলে পুরো অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। তবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে কিনা সে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন মার্ফি।

রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের মুখে গত ২৫ আগস্ট থেকে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা বলছেন, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ মারছে। রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম।

এ অবস্থায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়ছে। সংকটের শুরুতে নির্লিপ্ত থাকলেও সম্প্রতি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখাতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সম্প্রতি তিনবার আলোচনায় মুখ্য ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কঠোর ভাষায় মিয়ানমারকে ভর্ৎসনা করেছেন। তবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ট্রাম্প প্রশাসন।

মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে ‘সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই’ হিসেবে বর্ণনা করলেও জাতিসংঘ একে চিহ্নিত করেছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে। কিন্তু কংগ্রেসের শুনানিতে জাতিগত নিধন শব্দটি ব্যবহার করেননি মার্ফি। এতে ক্ষেপে যান কংগ্রেসম্যানরা।

পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান পার্টির কংগ্রেস সদস্য এড রয়েস বলেন, ‘মার্ফি, জাতিগত নিধন বলতে আপনার আপত্তি কেন? কিন্তু জেনে রাখুন, এ কমিটি মনে করছে- এটা পুরোদস্তুর জাতিগত নিধন।’

রয়েস বলেন, সর্বশেষ বিবৃতিতেও সু চি ‘জাতিগত নির্মূল অভিযানের’ বিষয়টি অস্বীকার করেছেন, যা ‘সঠিক নয়’। তিনি বলেন, ‘যারা ওই সহিংসতার জন্য দায়ী, তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। সু চি এবং তার দেশের সেনাবাহিনীকে এ চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।

রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর গত মাসের মাঝামাঝি মিয়ানমার সফর করেন মার্ফি। তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ পদাধিকারী কোনো মার্কিন কর্মকর্তা যিনি সংকট শুরুর পর দেশটি সফরে যান।

শুনানিতে মার্ফি বলেন, রাখাইনে সেনারা অসামঞ্জস্যপূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করছে। সেখানকার পরিস্থিতিকে তিনি ‘মানবিক ট্র্যাজেডি’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া ছাড়াও রাখাইনে অভ্যন্তরীণভাবে আরও দুই লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়েছে। এক মাস আগে সেনা অভিযান বন্ধ করা হয়েছে বলে মিয়ানমার সরকার দাবি করলেও দুর্বৃত্তরা এখনও রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে আগুন এবং মানবিক সাহায্য প্রদানে বাধা দিচ্ছে।

মার্ফি বলেন, মিয়ানমারে উদীয়মান গণতন্ত্র এখন টার্নিং পয়েন্টে। তবে মার্ফির বক্তব্যে কংগ্রেসম্যানরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটিতে ডেমোক্রেটদের জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি এলিয়ট অ্যাঙ্গেল বলেন, মিয়ানমারের সেনা ও ব্যবসায়ী নেতাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসনকে ভেবে দেখতে হবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। তবে দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এখনও বহাল রয়েছে।

মার্ফি জানান, মিয়ানমারে কার্যকর পরিবর্তন আনতে সব বিকল্পই বিবেচনা করে দেখছে ট্রাম্প প্রশাসন। মিয়ানমার সেনাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং সেনা কর্তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সাধারণত ভিসা দেয়া হয় না।

অ্যাঙ্গেল বলেন, স্যাটেলাইটের ছবিতে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে জানা যাচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী ‘ উদ্দেশ্যমূলক ও পদ্ধতিগত নীতি প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করছে। তাদের গ্রামগুলো আগুন দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে।’

তিনি বলেন, এমনকি পালিয়ে যাওয়ার সময় শত শত রোহিঙ্গাকে গুলি করে আহত করেছে মিয়ানমারের বাহিনী। মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পেছনে কারা আছে, তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে বলে জানান মার্ফি।

জাতিসংঘের তদন্তকারীদের রাখাইনে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার আগ পর্যন্ত মিয়ানমার সরকারকে মার্কিন সাহায্য বন্ধ রাখলে ফল পাওয়া যাবে কিনা, তা ভেবে দেখার আহ্বান জানান পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির এশিয়া বিষয়ক উপকমিটির প্রধান কংগ্রেস সদস্য টেড ইয়োহো। এপি ও রয়টার্স।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/10/07/161226