৮ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১০:৫৫

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে হযবরল

সারা দেশে বর্তমানে সরকারি কলেজ হচ্ছে ৩৩৫টি, আর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৪৭টি। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ৯০ ভাগই সরকারি অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে। বর্তমান সরকার তার রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে সরকারি কলেজ ও মাধ্যমিক স্কুল সরকারীকরণের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ প্রক্রিয়া বর্তমানে দ্রুততর করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ২৮৫ কলেজ ও ৩৭১টি স্কুল সরকারীকরণের প্রক্রিয়া চলছে। সরকারীকরণ বা জাতীয়করণ প্রক্রিয়াটি শুরুতেই হ-য-ব-র-ল অবস্থায় পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, জাতীয়করণের কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং নীতিহীনভাবে উপজেলা পর্যায়ে স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ হচ্ছে। এ অভিযোগ সরকার সমর্থক শিক্ষক সংগঠনগুলোরই বেশি। স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের (স্বাশিপ) সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মো: শাহজাহান আলম সাজু বলেন, জাতীয়করণ উদ্যোগটি ভালো; কিন্তু এটি সুস্পষ্ট নীতিমালার আলোকে হলে ভালো হতো। আমরা পুরো শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণের দাবি জানিয়ে আসছি। এখন যেভাবে এই প্রক্রিয়া চলছে তাতে, অনেক যোগ্য প্রতিষ্ঠান বাদ পড়ছে। এ কারণে ক্ষোভ-বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।

সরকার সমর্থক আরেক শিক্ষক সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’ বলছে, গুটিকয়েক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য আরো প্রকট আকার ধারণ করবে।
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের একক বৃহৎ সংগঠন শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো: সেলিম ভূঁইয়া বলেন, শিক্ষকেরা যখন চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনের মাঠে, তখন সরকার বিচ্ছিন্নভাবে উপজেলাভিত্তিক একটি করে স্কুল ও কলেজকে জাতীয়করণ করছে। এটি জাতীয়করণের আন্দোলনকে বিভক্ত করার রাজনৈতিক কৌশল বৈ কিছু নয়। এতে করে শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন করে বিভাজন ও বৈষম্য সৃষ্টি হবে। এর ফলে শিক্ষার মানোন্নয়নেও বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
ফলে শুরুতেই প্রশ্নে মুখের পড়ল জাতীয়করণের মতো একটি ভালো উদ্যোগ। এ ছাড়া জাতীয়করণের যে তালিকা সরকারে নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, তাতেও ঘাপলা সৃষ্টি হয়েছে। যে তালিকা করে মন্ত্রণালয়কে জাতীয়করণের কার্যক্রম শুরু করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তাতে নীতিগত অনুমোদনের পরও গত ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে ১৭টি বাদ দিয়ে নতুন করে সেখানে অন্য ১৭টি কলেজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকারি কলেজ রয়েছেÑ এমন উপজেলার কলেজকে এ তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। সরকারি কলেজ নেই এমন উপজেলায় যোগ্য প্রতিষ্ঠানও বাদ পড়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও জাতীয়করণ করা হয়নিÑ এমন দাবি নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা করেছে আটটি কলেজ। এর মধ্যে ছয়টি প্রতিষ্ঠান বলেছে, সংশ্লিষ্ট উপজেলায় শর্তপূরণ না করা কলেজ জাতীয়করণ হয়েছে। শুধু তাই নয়, যোগ্য প্রতিষ্ঠান বাদ দেয়ার ইস্যুতে গত বছরের ২৭ নভেম্বর ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়ায় সংঘর্ষে দু’জন নিহত হয়েছেন।
এ তো গেল স্কুল-কলেজ নির্বাচনের ক্ষেত্রে। যেসব স্কুল-কলেজ এখন জাতীয়করণ প্রক্রিয়ার অধীন এদের শিক্ষকদের অবস্থান কী হবে? তা নিয়ে চলছে রীতিমতো যুদ্ধংদেহী ভাব। আগের সরকারি কলেজের ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকেরা বর্তমানে আত্তীকৃত কলেজ শিক্ষকদের কোনোমতেই ক্যাডারভুক্তিকে মেনে নিতে চাইছে না।

সরকারি কলেজ শিক্ষকদের সংগঠন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি বলেছে, জাতীয়করণের মহৎ উদ্যোগকে বিতর্কিত করতে বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্তির পাঁয়তারা চলছে, যা কোনোভাবেই হতে দেয়া যাবে না। বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের চাকরি সরকারি হোক এবং সে অনুযায়ী সবধরনের সুযোগ-সুবিধা তারা পেতে পারেন। কিন্তু কোনোভাবেই তাদের ক্যাডারভুক্ত করা যাবে না।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি আই কে খন্দকার নেতারা বলেন, ‘বিসিএস ছাড়া ক্যাডার সার্ভিস নয়’, বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন, ‘জাতীয়করণের আওতাভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষকদের চাকরি বদলিযোগ্য হবে না’ মানতে হবে। তাদের চাকরি নিজ নিজ কলেজেই সুনির্দিষ্ট হবে।
শিক্ষা সমিতি সভাপতি আরো বলেন, ১৫ হাজার ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকদের মর্যাদার ওপর ৩১৫টি কলেজের প্রায় ২০ হাজার বেসরকারি শিক্ষকের চেপে বসার আশঙ্কায় দেশের সব সরকারি কলেজ ও শিক্ষা ক্যাডার সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দফতরে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে। অবিলম্বে এ সমস্যার সমাধান না হলে শিক্ষা ক্যাডারের ১৫ হাজার সদস্যকে সাথে নিয়ে কঠোর কর্মসূচি দেয়া ছাড়া বিকল্প পথ থাকবে না।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি অন্য নেতারা বলেন, ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে। ওই শিক্ষানীতিতে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরেও দীর্ঘ সাত বছরে জাতীয়করণের সাথে সংশ্লিষ্ট কলেজের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র চাকরি বিধিমালা তৈরি হয়নি। শিক্ষানীতি ২০১০ এ বলা হয়েছেÑ ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি।’ বিসিএস ক্যাডারের সদস্যদের সব সুবিধা অক্ষুণœ রেখে জাতীয়করণকৃত শিক্ষকদের নিয়োগ, পদায়ন,জ্যেষ্ঠতা, পদোন্নতি, পরিচালনাসহ চাকরির শর্ত নির্ধারণ করে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

অন্য দিকে জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকেরাও এরই মধ্যে কথা বলতে শুরু করেছেন। নতুন করে জাতীয়করণের জন্য নির্বাচিত ২৮৩ কলেজ শিক্ষকদের নবগঠিত সংগঠন তালিকাভুক্ত কলেজ শিক্ষক পরিষদ। জাতীয়করণের তালিকাভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্ত করে আত্তীকরণের দাবি করেছে ওই কলেজগুলোর শিক্ষক পরিষদ। তা করা না হলে আইনের আশ্রয় নেয়ার হুমকিও দিয়েছেন তারা। জাতীয়করণের তালিকাভুক্ত কলেজ শিক্ষক পরিষদ এ ছাড়াও ডিড অফ গিফট হওয়া কলেজগুলোর দ্রুত জিও ও গেজেট জারি, ইফেক্টিভ শতভাগ গণনা করে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ, জিও জারির তিন মাসের মধ্যে চাকরি নিয়মিতকরণ, বেসরকারি কলেজে নিয়োগ স্থায়ীকরণ হলে সরকারি হওয়ার পর তা বহাল রাখার দাবি করেছে।
পরিষদের আহ্বায়ক মো: ফারুক হোসেন বলেন, উপজেলাভিত্তিক কলেজগুলো জাতীয়করণের আওতায় আনার সরকারের উদ্যোগকে নস্যাৎ করার অপকৌশল চালাচ্ছে ঘাপটি মেরে থাকা সরকার বিরোধী চক্র। জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্ত না করা হলে শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হবে। আত্তীকৃত শিক্ষকদের মর্যাদা ও মানবাধিকার ক্ষুণœ হবে।
এখানেই শেষ নয়, জাতীয়করণ কার্যক্রমে প্রতারণার মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী বঞ্চিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ফাঁদ পেতেছে। বিষয়টি এতই জটিল আকার ধারণ করেছে যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হয়েছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর জারি করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সরকারীকরণ কাজে সংশ্লিষ্ট নয়Ñ এমন কিছু প্রতারক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে ফোন করে অর্থ দাবি করে বিকাশ নম্বরে (টাকা) পাঠাতে বলছে বলে জানা গেছে। এ ধরনের কোনো ফোন পেলে তা কাছের থানায় অবহিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানকে অনুরোধ জানানো হয়।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/257709