৭ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ২:৪১

রাখাইনে অনাহারে রোহিঙ্গারা

রাখাইনের উত্তরাঞ্চল ‘জেলখানার মতো’ * টাকা, খাদ্য ও গবাদিপশু লুট করছে সেনারা

সাহায্যের জন্য হাত পাতছেন মিয়ানমারের ভেতরে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া রোহিঙ্গারা। হাজার হাজার রোহিঙ্গা অভুক্ত অবস্থায় রয়েছেন। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে আটকে পড়া রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যে হাজার হাজার রোহিঙ্গা না খেয়ে আছে এবং তাদের জরুরি চিকিৎসাসেবা দরকার। রাখাইন রাজ্যের বুথিডং শহরের একটি সাহায্য সংস্থার পক্ষে কাজ করেন আবদুল্লাহ মোহায়মেন। তিনি জানান, কোয়ান ডাইন নামে তার নিজের গ্রামের ২ হাজার মানুষের খাদ্য ফুরিয়ে গেছে। আরও বহু মানুষ খাদ্য ঘাটতির মুখে পড়েছে। মোহায়মেন বলেন, ‘আমাদেরকে কোথাও যেতে দেয়া হয় না। এখানকার লোকজন বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে।’ উত্তর রাখাইনের আরও চারটি গ্রামের বহু রোহিঙ্গা পরিবারেরও খাদ্য ঘাটতির সংবাদ পাওয়া গেছে। গ্রামের বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, সেনারা ও বৌদ্ধ প্রতিবেশীরা তাদেরকে এখনও ভয় দেখাচ্ছে, তাদের ঘরবাড়ি লুট করছে, চাঁদা নিচ্ছে এবং জোর করে তাদের গবাদিপশু নিয়ে যাচ্ছে।

আলজাজিরা জানায়, এ প্রতিবেদনগুলো মুক্তভাবে যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ পুরো রাখাইন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এবং সেখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য এবং বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু হওয়া রোহিঙ্গাদের অবস্থা ভয়াবহ ও শোচনীয়।

ধারণা করা হচ্ছে, রাখাইনে এখনও ৫ লাখের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে। চলতি সপ্তাহে উত্তর রাখাইনের বুথিডং জেলার কিন তং গ্রামের এক রোহিঙ্গা নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফোনের মাধ্যমে ভিক্ষা চেয়ে বলেন, ‘দয়া করে, আমাদের সাহায্য করুন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা অসুস্থ, কিন্তু আমরা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছি না। আমরা কোনো কাজ করতে পারছি না। কিছু খেতেও পাচ্ছি না।’ সোমবার মিয়ানমারের সরকারের তত্ত্বাবধানে বিদেশি কূটনীতিকদের ২০ জনের একটি দল রাখাইনের উত্তরাঞ্চল পরিদর্শন করেন। তাদের বর্ণনায় সেখানকার মানবিক পরিস্থিতি ‘খুব করুণ’ বলে জানা যায়। পরিদর্শন শেষে এই কূটনীতিকেরা কোনো রকম বৈষম্য ছাড়াই রাখাইনের অধিবাসীদের জীবন রক্ষাকারী সেবা ও ত্রাণ পৌঁছাতে দেয়ার জন্য মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কূটনীতিক দলের সঙ্গে রাখাইনে উত্তরাঞ্চল পরিদর্শন করেন মিয়ানমারে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত পল সেগার। পরিদর্শন শেষে এক টুইটার বার্তায় তিনি বলেন, ‘এই মাত্র উত্তর রাখাইন থেকে ফিরে এলাম। দেখলাম গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখনও ধোঁয়া উঠছে। শূন্য হয়ে আছে ধানের মাঠগুলো। ওপর থেকে ওই এলাকাকে মরুভূমির মতো দেখাল। খুব মর্মান্তিক দৃশ্য!’

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, শিগগিরই রাখাইনে ত্রাণ-সহায়তা না পৌঁছলে বহু লোক মারা যেতে পারে। তবে এ ব্যাপারে মিয়ানমার সরকার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা যায়নি। এর আগে তারা সহিংসতাকবলিত এলাকায় ত্রাণ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন তং গ্রামের ওই নারী জানান, রোহিঙ্গাদের ওপর সেনারা এখনও নির্যাতন নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। গণহত্যা, গণযৌন নিপীড়ন ও তাদের গ্রামগুলো এখনও জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে এখনও প্রতিদিন বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সেনারা গ্রামের রোহিঙ্গাদের যৌন নির্যাতন ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে এবং চাঁদা হিসেবে টাকা-পয়সা, খাবার-দাবার ও গবাদিপশু নিয়ে যাচ্ছে। পরিবারের সদস্য ও ঘরবাড়ি নিরাপদ রাখার জন্য তার পরিবারকেও চাঁদা দিতে হয়েছে বলে জানান তিনি। তার স্বামী ৩০ বছর বয়সী কৃষক জানান, ‘মাগরিবের নামাজের পর কোনো রোহিঙ্গাকে রাস্তায় দেখা গেলে তাকে ২ লাখ বার্মিজ কিয়াত জরিমানা করা হচ্ছে। জরিমানার এই অর্থের জন্য বাড়িতে গরু পেলেও তা নিয়ে যাচ্ছে সেনারা।’ জার্মানিভিত্তিক এক রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী নে স্যান লুইন জানান, রাখাইনের উত্তরাঞ্চল এখন ‘জেলখানার মতো’ এবং চলতি সপ্তাহেও রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনী ভয়ভীতি ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগ তীব্র করলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে থাকে।

https://www.jugantor.com/ten-horizon/2017/10/07/161288/