৭ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ২:৩৭

সফর সংবর্ধনা এবং বিদেশে বাংলাদেশ

আশিকুল হামিদ : এই নিবন্ধ যেদিন প্রকাশিত হবে সেদিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসার কথা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য গত মাসের ২২ তারিখে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন। সেখানে অবস্থানকালে সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেয়া ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন তিনি। এসবের মধ্যে ছিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি অনুষ্ঠান- যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছেন, বাংলাদেশ কেমন আছে? জবাবে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়েও সময় আর সুযোগের অভাবে পারেননি। এই না পারার কথা শেখ হাসিনা নিজেই গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না পেলেও প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত ও বৈঠক করেছেন। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার গলব্লাডারে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। জানা গেছে, মূলত সে কারণেই প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাবর্তনের পূর্বঘোষিত তারিখে পরিবর্তন করতে হয়েছে। নাহলে তিনি ২ অক্টোবর ঢাকায় ফিরে আসতেন।

শুরুতে এত কথা বলার পেছনে বিশেষ কারণ রয়েছে। নানা রকমের গুজব একটি প্রধান কারণ। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর বরাতে সুবীর ভৌমিক নামের এক ভারতীয় সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে যে গুজব ছড়িয়েছিলেন তা নিয়ে আলোচনা যথেষ্টই হয়েছে। গুজবের দ্বিতীয় ফানুস ওড়ানো হয়েছিল নোবেলে শান্তি পুরষ্কার পাওয়ার ব্যাপারে। একথা পর্যন্ত শোনানো হয়েছিল যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি শান্তি পুরষ্কার পেয়ে যাই যাই অবস্থায় এসে গেছেন! তার নাম নাকি তিন থেকে পাঁচজনের শর্ট লিস্টেও রযেছে! গলব্লাডারে অস্ত্রোপচার নাকি একটি অজুহাত মাত্র ছিল, প্রধানমন্ত্রী নাকি নোবেল পুরষ্কার নিয়েই ফিরতে চেয়েছিলেন! কিন্তু সে আশার গুড়ে নাকি বালি পড়েছে। তাই বলে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিরাট গণসংবর্ধনার আয়োজন করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ঠিক কোন কারণে এই রাজকীয় সংবর্ধনা? শুনতে ব্যঙ্গাত্মক মনে হলেও প্রশ্নকারীরা বলেছেন, অন্য রষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের মতো জাতিসংঘের অধিবেশনে অংশ নেয়ার এবং ভাষণ দেয়ার বাইরে প্রধানমন্ত্রী এমন কিছুই করেননি বা এমন কোনো বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখেননি, যার জন্য তাকে এভাবে সংবর্ধনা দিতে হবে। বড় কথা, বিশেষ করে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারেও তিনি কোনো সাফল্যই অর্জন করতে পারেননি। একই কারণে তাকে সংবর্ধনা দেয়ার বিষয়টিও সাধারণ মানুষের সমর্থন পায়নি। মানুষের মুখে বরং বাঁকা হাসি দেখা গেছে।

এ ধরনের প্রতিক্রিয়ায় অবশ্য ক্ষমতাসীনদের কিছুই যায়-আসে না। সে কারণেই জনগণের ভোগান্তি বাড়িয়ে হলেও দলটি তাদের নেত্রীকে সংবর্ধনা দেয়ার কর্মসূচি পরিবর্তন করেনি। অন্যদিকে সংবর্ধনা কেন্দ্রিক নিন্দা-সমালোচনায় প্রাধান্যে এসেছে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির হিসাব-নিকাশ। এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ একটি উদাহরণ হিসেবে মিয়ানমারের মন্ত্রী খিও টিন্ট সোয়ের ঢাকা সফরের কথা তুলে ধরা হয়েছে। গত ২ অক্টোবর একদিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সরকারের পক্ষ থেকে একজন মন্ত্রীর সফরকেই ‘বিরাট’ অর্জন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হলেও সে চেষ্টা হালে পানি পায়নি। কারণ, নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করার, তাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানোর, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করার, রোহিঙ্গাদের শত শত গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার এবং মাস দেড়েকেরও কম সময়ের মধ্যে পাঁচ থেকে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর মতো ভয়ংকর মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের জন্য কোনো রকম দুঃখ প্রকাশ করেননি অং সান সু চির পাঠানো মন্ত্রী খিও টিন্ট সোয়ে। অথচ কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও সৌজন্যের খাতিরে হলেও দুঃখ প্রকাশ করাটা মন্ত্রীর কর্তব্য ছিল। মিস্টার সোয়েকে দিয়ে মিয়ানমার বরং বুঝিয়ে দিয়েছে, দেশটি যা করেছে ও করে চলেছে সে সবের মধ্যে কোনো ভুল বা দোষ নেই। শুধু তা-ই নয়, জাতিগত নির্মূল অভিযানের অংশ হিসেবে গণহত্যা এবং ধর্ষণসহ দমন-নির্যাতন বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে বরং চলতেই থাকবে। এমন মন্তব্যের কারণ, সু চির এই মন্ত্রী কথায় তো বটেই, আকারে-ইঙ্গিতেও তেমন কোনো আশ্বাস দেননি, যার ভিত্তিতে শুভ কিছু আশা করা যাবে।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে ‘যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের সিদ্ধান্তটিকেও তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। কারণ, ওয়ার্কিং গ্রুপটি গঠন করবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এবং এ ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘খুব শিগগিরই’ মিয়ানমার সফরে যাবেন। অর্থাৎ আরো সময় পার হতে থাকবে এবং এই সময়ের মধ্যে প্রতিদিন আরো হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসতে থাকবে- যেমনটি আসছে আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে, যেমন এসেছে ওই মন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকায় বৈঠক চলাকালেও। রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা ও নির্যাতনের অভিযানও চলতে থাকবে। কারণ, দুই দু’জন মন্ত্রী- পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সু চির মন্ত্রী খিও টিন্ট সোয়ে যথেষ্ট দাপটের সঙ্গেই শুধু আলোচনা করেননি, নিজেদের ইচ্ছাও পুরোপুরি চাপিয়ে দিয়েছেন। তার চাপের মুখে নতিস্বীকার করে বাংলাদেশকে এই প্রস্তাবও মেনে নিতে হয়েছে যে, পরিকল্পিত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ছাড়া অন্য কোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিকে রাখা যাবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক পরবর্তী ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘের কথা এসেছে সুনির্দিষ্টভাবে। অর্থাৎ গ্রুপটিতে জাতিসংঘের কোনো সংস্থার কোনো প্রতিনিধিকে রাখা চলবে না। বিশ্বের দেশে দেশে রোহিঙ্গা সংকট যখন প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং নিরাপত্তা পরিষদসহ সম্পূর্ণ জাতিসংঘই যখন বিষয়টিতে সর্বাত্মকভাবে জড়িয়ে পড়েছে, তেমন এক জটিল সময়ে জাতিসংঘের প্রতিনিধিকে রাখার ব্যাপারে মিয়ানমারের আপত্তি এবং সে প্রস্তাবে বাংলাদেশের সম্মতির মধ্য দিয়ে নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ সরকারের অযোগ্যতা ও ব্যর্থতারই প্রকাশ ঘটেছে।

প্রসঙ্গক্রমে প্রাধান্যে এসেছে সরকারের পররাষ্ট্রনীতি। মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত ও বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সে দেশের সরকার ও সেনাবাহিনীর গণহত্যা প্রতিহত করাসহ সামগ্রিকভাবে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকার চরম কূটনৈতিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে বলে প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বের সকল দেশ যখন রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা ও নির্মূল অভিযানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে, এমনকি জাতিসংঘও যখন মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানিয়েছে, তেমন এক সম্ভাবনাময় সময়েও আওয়ামী লীগ সরকার কেবলই আশ্রয় ও তথাকথিত মানবিক সহায়তা দেয়ার মধ্যে সকল তৎপরতা সীমাবদ্ধ রেখেছে। কূটনৈতিকভাবে তৎপর হয়নি। একটি উদাহরণ হিসেবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের স্ত্রী এবং দেশটির ফার্স্ট লেডি এমিনো এরদোগানের কক্সবাজার সফরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তুরস্কের ফার্স্ট লেডির সঙ্গে সরকারের কোনো মন্ত্রী ওই এলাকায় যাননি। অথচ এটা ছিল আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও সৌজন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। মিসেস এরদোগানের প্রায় এক সপ্তাহ পর গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো কক্সবাজার সফরে যাওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। বিষয়টির সঙ্গে ভারতের অনুমতি পাওয়া-না পাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করে বলা হয়েছে, এতদিনে সম্ভবত মোদি সরকারের ‘অনুমতি’ পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী!
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা সরকারের পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকটে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে, এই সরকারের আসলে কোনো বন্ধু নেই। একমাত্র ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচিত ভারত সংকটের শুরু থেকেই মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর মাত্র কিছুদিন আগে দেশটি সফরকালে ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদি খোলামেলাভাবেই গণহত্যার প্রশ্নে মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছেন। আরেক কথিত বন্ধুরাষ্ট্র গণচীনও প্রকাশ্যেই মিয়ানমারকে সমর্থন জানিয়ে চলেছে। একই অবস্থান নিয়েছে রাশিয়াও। দেশ দুটির বাধা ও বিরাধিতার কারণে জাতিসংঘ পর্যন্ত পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশ দুটি নিরাপত্তা পরিষদের সম্ভাব্য প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দেয়ারও হুমকি দিয়ে রেখেছেÑ যার ফলে ২৮ সেপ্টেম্বরের বিশেষ বৈঠকে কোনো প্রস্তাবই পাস করা সম্ভব হয়নি। অথচ এই চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের দহরম-মহরমের কোনো শেষ নেই!

কথা শুধু এটুকুই নয়। সরকার একদিকে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সমর্থন পাওয়ার কোনো চেষ্টা চালানোর প্রমাণ দিতে পারেনি, অন্যদিকে তুরস্কসহ যেসব দেশ বাংলাদেশের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে সেসব দেশের সঙ্গেও সরকার কূটনৈতিক রীতি-নীতি বিরোধী অসম্মানজনক আচরণ করে চলেছে। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি মিসেস এরদোগানের সাম্প্রতিক সফরের সময়। মূলত এ ধরনের নীতি, মনোভাব ও কার্যক্রমের কারণেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বে একেবারে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা দরকার, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি ‘বিরল’ বিবৃতি কিন্তু সরকারের জন্য চমৎকার সুযোগের সৃষ্টি করেছিল। চীন ও রাশিয়ার কারণে প্রথম থেকে সংশয় থাকলেও গত ১৩ সেপ্টেম্বর রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে দেয়া এক সর্বসম্মত বিবৃতিতে নিরাপত্তা পরিষদ অবিলম্বে রাখাইন রাজ্যে চলমান গণহত্যা ও সহিংসতা বন্ধ করার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছিল। ‘বিরল’ হিসেবে বর্ণিত এই বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর ‘মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ’ করছে। এই সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেছিলেন, অসামরিক লোকজনের ওপর সশস্ত্র হামলা ‘একেবারেই অগ্রহণযোগ্য’। রোহিঙ্গা মুসলিমরা ভয়াবহ মানবিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। গণহত্যা ও সহিংসতা বন্ধের পাশাপাশি তাদের সকলকে অবশ্যই নিজেদের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার এবং আইনসম্মত নাগরিক হিসেবে মর্যাদা ও অধিকারের সঙ্গে বসবাস করার সুযোগ দিতে হবে। উল্লেখ্য, নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিতেও একই বক্তব্য রাখা হয়েছিল।

প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় তথ্যটি জাতিসংঘের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা একটি ‘খোলা চিঠি’। গণহত্যা বন্ধ করে রোহিঙ্গা সংকটের আশু সমাধান করার আহবান জানিয়ে প্রকাশ করেছিলেন বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূসহ ১২ জন নোবেল বিজয়ী এবং ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক শুরুর প্রাক্কালে প্রকাশিত এই ‘খোলা চিঠি’তে বিশ্বের ২৭ বিশিষ্টজন বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবীয় ট্র্যাজেডি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে তার অবসানে জাতিসংঘের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যদের এই মুহূর্তের দৃঢ় সংকল্প ও সাহসী সিদ্ধান্তের ওপর মানব ইতিহাসের ভবিষ্যৎ গতিপথ অনেকটাই নির্ভর করছে বলেও নোবেল বিজয়ীসহ বিশিষ্টজনেরা মত প্রকাশ করেছিলেন।

বলা বাহুল্য, নিরাপত্তা পরিষদের ‘বিরল’ বিবৃতি এবং ১২ জন নোবেল বিজয়ীসহ ২৭ বিশিষ্টজনের ‘খোলা চিঠি’র কারণে সৃষ্ট চমৎকার সুযোগের সদ্ব্যবহার করার ব্যাপারেও লজ্জাকর ব্যর্থতা ও চরম অযোগ্যতা দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। অথচ সদিচ্ছা থাকলে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীনভাবে অবস্থান নেয়ার ও ভ’মিকা পালনের অধিকার থাকলে ওই বিবৃতি ও খোলা চিঠির ভিত্তিতেই সরকার রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারতো। অন্যদিকে সেটা সম্ভব হয়নি সরকারের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা এবং বিশেষ দুর্বলতার কারণে। বলা হচ্ছে এবং এ কথার সত্যতাও বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের নামে আয়োজিত এমন এক কর্মকান্ডের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতার দখল নিয়েছিল, যার কোনো পর্যায়েই জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। সেবার জনগণকে ভোটই দিতে দেয়া হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একদিকে ১৫৪ জন ‘নির্বাচিত’ এমপি হিসেবে ঘোষিত হয়েছিলেন, অন্যদিকে শুধু একটি সংসদ ও সরকারই গঠন করা হয়নি, ওই সংসদকে সামনে রেখে সরকার বিরোধী দলগুলোর ওপর ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন-নির্যাতনও চালিয়ে যাচ্ছে। স্মরণ করা দরকার, একমাত্র ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশই ৫ জানুয়ারির ওই কর্মকান্ডের প্রতি সমর্থন জানায়নি বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ সকল রাষ্ট্র সংসদ ও সরকার গঠনের কর্মকান্ডের বিরোধিতা করেছিল। এখনও পর্যন্ত দেশগুলোর সে অবস্থানে পরিবর্তন ঘটেনি।

এমন অবস্থার কারণে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারেও সরকার আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর পাশাপাশি অন্য একটি বিশেষ কারণকেও সামনে আনা হয়েছে। মিয়ানমারের যে জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা ও নির্মূলের ভয়ংকর অভিযান চালানো হচ্ছে তারা মুসলিম। দেশটির সরকার ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের সশস্ত্র ইসলামী জঙ্গি হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টিকেই তার সমর্থন দেয়ার কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। চীনের মতো কিছু রাষ্ট্রও এমন এক অসত্য প্রচারণা চালাচ্ছে যে, রোহিঙ্গা মুসলিমরা নাকি আইএস-এর সঙ্গে জড়িত এবং তারা নাকি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে বলেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে! বাংলাদেশ সরকারও নাকি তথাকথিত ইসলামী জঙ্গি বিরোধী একই নীতির কারণে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সুফলপ্রসূ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না!
বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্তরালে যা কিছুই ঘটে থাকুক বা ঘটতে থাকুক না কেন, ঘটনাপ্রবাহের বর্তমান পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ বাস্তবে বন্ধুহীন অবস্থায় পড়েছে। এ অবস্থার সুযোগ নিয়েই মিয়ানমার হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে ঠেলে পাঠাচ্ছে, দেশটির সামরিক হেলিকপ্টার যখন-তখন বাংলাদেশের আকাশ সীমা লংঘন করারও দুঃসাহস দেখাচ্ছে।

সর্বশেষ ঘটনায় মন্ত্রী খিও টিন্ট সোয়ের সফরকালেও সরকার নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমারের মন্ত্রী কিন্তু সকল রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দেননি। তিনি বরং বলে গেছেন, ‘যাচাই ও প্রমাণ সাপেক্ষে’ সেই সব রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়া হবে, যারা রাখাইন প্রদেশের ‘প্রকৃত’ নাগরিক। উল্লেখ্য, ১৯৮০-র দশকে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসকরা কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ রোহিঙ্গাদের অবার্মিজ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল। সেই থেকে পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বেড়েছে এবং হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে গত ২৫ আগস্টের পর। নির্যাতনের মুখে যারা পালিয়ে এসেছে তাদের কারো পক্ষেই পরিচয়পত্র ধরনের কোনো কিছু আনা সম্ভব হয়নি, যা দিয়ে প্রমাণ করা যাবে যে, তারা রাখাইন প্রদেশের ‘প্রকৃত’ নাগরিক। অর্থাৎ কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থেকে যাবে। তাদের আর কখনো ফেরৎ পাঠানো যাবে না।

এমন অবস্থায় ‘যাচাই ও প্রমাণ সাপেক্ষে’ রাখাইন প্রদেশের ‘প্রকৃত’ নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাসের মধ্যে সংকটের স্থায়ী সমাধানের কোনো ইঙ্গিত পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বিষয়টিকে বরং মিয়ানমারের নতুন প্রতারণাপূর্ণ কৌশল হিসেবেই দেখা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এসবই সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার কারণে সম্ভব হয়েছে ও হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার বাস্তবে বাংলাদেশকে বিদেশে ‘ডুবিয়ে’ ছেড়েছে!

http://www.dailysangram.com/post/302513