৭ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৮:০৯

কাঁচাবাজারে নাজেহাল ক্রেতা

রাজধানীর কাজীপাড়া বাজারে শাক বিক্রেতা মো. মনির হোসেনের দোকানে এক আঁটি লাউশাকের দাম চাওয়া হলো ৪০ টাকা। আঁটিতে লাউগাছের ডগা মাত্র তিনটি। পরিবার ছোট হলেও এক বেলা রান্নার জন্য দুই আঁটি শাক কিনতে হবে। খরচ হবে ৮০ টাকা, যা তিন মাস আগেও ছিল ৩০ টাকার মধ্যে।
মনির হোসেন ১৯৯১ সাল থেকে সবজি ও শাক বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘গত ২৬ বছরে আমি এত দাম দেখিনি। বাজারে শাক পাওয়াই যায় না। যতটুকু মেলে, তার দাম এত চড়া যে সবাই তা কিনতে পারে না। আমি হিসাব করে দেখেছি, এক কেজি লাউশাকের দাম এখন ১৩৫ টাকা পড়ছে।’
শাক বিক্রেতারা যখন এ কথা বলছেন, তখন সবজি বিক্রেতারা পিছিয়ে থাকবেন কেন। বাজারে বেশির ভাগ সবজি এখন অভিজাত মর্যাদা পেয়েছে। তাদের কেজিপ্রতি দর ৬০ টাকার ওপরে। ইলিশ ধরা বন্ধের সুযোগে ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছেন মাছের দামও। ভালো কোনো মাছ কিনতে গেলেই গুনতে হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭০০ থেকে হাজার টাকা।
সম্প্রতি বাজারে চালের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ৫০ কেজির এক বস্তা সরু চাল কিনতে একটি পরিবারের খরচ বেড়েছে প্রায় ৭০০ টাকা। চালের বিকল্প আটার দামও কেজিতে ৪ টাকা বেড়েছে। সবজির দাম এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। মাছের দাম বেড়েছে। গরুর মাংস এখন আর নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালে নেই। সব মিলিয়ে কাঁচাবাজার সীমিত আয়ের মানুষের কাছে এখন আতঙ্কের নাম। কম টাকা নিয়ে বাজারে গেলে অর্ধ ফাঁকা ব্যাগ নিয়ে ঘরে ফিরতে হচ্ছে। নইলে প্রতিদিন খেতে হচ্ছে আলু, যা এখন বাজারের সবচেয়ে সস্তা সবজি। কেজিপ্রতি দাম মাত্র ২৫ টাকা।
কাজীপাড়া বাজারে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে কেনাকাটা করতে যান স্থানীয় মাইকওয়ালা মসজিদ এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাঁচা টাকা না থাকলে এখন আর কাঁচাবাজারে যাওয়া ঠিক না। পুরোপুরি নাজেহাল হতে হয়। মাছ বলেন মাংস বলেন সবজি বলেন, কোনোটার দাম কম নয়।’ তিনি আরও বলেন, পরিবারের বাড়িভাড়া, বিভিন্ন বিল, সন্তানের শিক্ষার খরচ—এসব ব্যয় তো মাসের শুরুতেই মেটাতে হয়। হাতে থাকে বাজার খরচের টাকা। সবকিছুর দাম বাড়লে পরিমাণে কম না কিনে উপায় থাকে না।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে। তা প্রভাব ফেলে মূল্যস্ফীতিতে। বাড়তি খরচ জোগানোর জন্য সীমিত আয়ের মানুষকে সঞ্চয় কমিয়ে দিতে হয়।
যাঁদের সঞ্চয় নেই, তাঁদের পণ্য কেনার পরিমাণ কমাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে, বাড়িওয়ালারা বাড়িভাড়া বাড়িয়ে, রিকশা, অটোরিকশাচালকেরা পরিবহন ভাড়া বাড়িয়ে তাঁদের বাড়তি খরচ পোষানোর চেষ্টা করেন, যা আবার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দেয়।
* বেশির ভাগ সবজির কেজিপ্রতি দাম ৬০ টাকার ওপরে
* এক আঁটি লাউশাক ৪০ টাকা
* ইলিশ ধরা বন্ধের অজুহাতে বাড়ল মাছের দামও

জানতে চাইলে ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই এ ঊর্ধ্বগতি কাম্য নয়।
রাজধানীর ফকিরাপুল বাজারের বিভিন্ন দোকানে ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে আনা সবজি বিক্রি হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার ওই বাজারের কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখা গেল, লম্বা বেগুনের কেজিপ্রতি দাম ১০০ টাকা। বরবটি, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, ধুন্দল, মুলা ও ঢ্যাঁড়স চাওয়া হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭০ থেকে ৮০ টাকা। ছোট একটি লাউ ৬০ টাকার নিচে কিছুতেই বিক্রি করতে রাজি নন বিক্রেতারা। একটি জালি কুমড়ার দাম চাওয়া হচ্ছে ৫০ টাকা।
বিক্রেতা রাকিবুল ইসলামের দোকানে ৬০ টাকা কেজির নিচে সবজি আছে তিনটি। কচুমুখী, কাঁচা পেঁপে আর কুমড়া। তিনি বলেন, সবজির দাম অনেক দিন ধরেই বেশি। সম্প্রতি তা আরও বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কাঁচা মরিচের দাম, কেজি এখন ২০০ টাকা।
সবজির দাম শুধু ঢাকায় নয়, বেড়েছে বগুড়ায়ও। বগুড়া থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় সবজি সরবরাহ করা হয়। প্রথম আলোর বগুড়া প্রতিনিধি আনোয়ার পারভেজ জানান, জেলার সবজির পাইকারি হাট মহাস্থান হাটে সবজির সরবরাহ একেবারেই কম। এ কারণে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। গতকাল ওই হাটে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ১৩০-১৩৫ টাকা, করলা ও বেগুন ৪২ টাকা, পটোল ও কাঁকরোল ৩৪ টাকা, মুলা ও শসা ৪০, মিষ্টিকুমড়া ৩৫ এবং চালকুমড়া প্রতিটি ২৮ টাকা দরে কেনাবেচা হয়েছে। হাতবদলের পর বগুড়ার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি করলা ৮০ টাকা, বেগুন ৭০ টাকা, পটোল, শসা ও মুলা ৬০ টাকা এবং কাঁচা মরিচ ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

মহাস্থান কাঁচা ও পাকা মাল আড়ত ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, অন্য বছর সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগাম শীতকালীন সবজির সরবরাহ শুরু হয়। কিন্তু এবার ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম ও টমেটোর মতো শীতকালীন সবজির দেখা এখনো মিলছে না।
মাছ বাজারে এত দিন স্বস্তি ছিল ইলিশের দামে। একটু সামর্থ্যবান ক্রেতারা আগের চেয়ে বেশ কম দামে বড় ইলিশ কিনে বাসায় ফিরতে পারতেন। আর নিম্ন আয়ের মানুষ ছোট ইলিশ কিনতেন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজির মধ্যে। ইলিশের ভিড়ে অন্য মাছের কদর ছিল না, তাই দাম কমে গিয়েছিল। কিন্তু ইলিশ ধরা বন্ধ হতেই অন্য মাছের ব্যবসায়ীরা জেগে উঠেছেন। মাছের দাম সর্বনিম্ন কেজিপ্রতি ২০ টাকা এবং ওপরে ১০০ টাকাও বেড়েছে।

নদীর মাছ, খাল-বিলের যেকোনো তাজা মাছের দামই এখন আকাশছোঁয়া। বেলে, বাছা, বাইন, ট্যাংরা, শোল, চিংড়ি, পোয়া ইত্যাদি মাছ ছুঁতে গেলে দিতে হবে হাজার টাকার নোট, বিক্রেতা দু-এক শ টাকা ফেরত দিতে পারেন, আবার নাও পারেন। নিম্ন আয়ের মানুষ কেনে চাষের কই, পাঙাশ ও তেলাপিয়া। এসব মাছের দামও কেজিতে ২০ টাকা বেড়েছে।
কাজীপাড়ার মাছ বিক্রেতা বিল্লাল হোসেন বলেন, নদীতে জেলেদের নামা নিষেধ। ফলে ইলিশ নেই, অন্য মাছও ধরা যায় না। তাই মাছের দাম বেশি। তিনি বলেন, ‘এখন তো দোকানের খরচও বেড়েছে। একটু বেশি লাভ না করলে হয় না। আমাদেরও তো ৬৫ টাকা কেজিতে চাল কিনতে হয়।’

খুচরা বাজারে ঈদুল আজহার পরে সরু মিনিকেট চালের দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকার মতো বেড়ে সম্প্রতি ২ টাকা কমেছে। মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬২ থেকে ৬৫ টাকা, মাঝারি চাল ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা ও মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক সপ্তাহে বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ২ টাকা কমেছে। তবে এক বছর আগের তুলনায় চালের দাম ২৫ থেকে ৩৪ শতাংশ বেশি।
তবে কিছু পণ্যের দাম এখন বেশ কম। এক ডজন ডিম ৮০ টাকায় মিলছে। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৩০ টাকায় নেমেছে। চিনি মিলছে কেজিপ্রতি ৫৫ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1338051