৭ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার

বিআইবিএমের সেমিনারে বক্তারা

মানবসৃষ্ট সমস্যা ব্যাংকিং খাতের অশনিসংকেত

ব্যাংকিং খাতে চলছে একক কর্তৃত্ব। চেয়ারম্যানের নির্দেশের বাইরে এমডি-ডিএমডি কেউ যেতে পারেন না। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের মেয়াদ টানা ৯ বছর এবং একই পরিবার থেকে ৪ জন পরিচালক করার সুযোগ সৃষ্টিকে আরও অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন খাত সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে খাতটিতে সুশাসনের ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট থাকবে না। এ খাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে যত না ক্ষতি, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে মানবসৃষ্ট দুর্যোগে। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ থামাতে না পারলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বন্ধ করে দেয়ার পরামর্শও দেন কেউ কেউ। সরকারি ব্যাংকগুলোকে একীভূত (মার্জার) করার পরামর্শও দিচ্ছেন কেউ। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও একটি বেসরকারি ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ নুরুল আমিন, বিডিবিএলের এমডি মনজুর আহমেদ, পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী, বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মহাব্যবস্থাপক আবদুল ওয়াদুদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন- বিআইবিএমের অধ্যাপক ও পরিচালক ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জি। ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাংকিং খাতে দুর্ঘটনাজনিত ঝুঁকি’ শীর্ষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের পরিচালক ও অধ্যাপক ড. শাহ মো. আহসান হাবিব এবং মূলধন সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (ব্যাসেল-১, ২ ও ৩) অনুসরণে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কি ধরনের প্রভাব শীর্ষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের অধ্যাপক মো. নেহাল আহমেদ।

প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, প্রতি বছর ১০ লাখ মানুষ মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে মানবসৃষ্ট দুর্যোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বাংলাদেশ।
অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম বলেছেন, বোর্ডের (ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ) চেয়ারম্যান যা চান তা করতে হয়। ৩ বছরের জন্য চুক্তিতে এমডি নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার হাতে কোনো ক্ষমতা থাকে না। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের মেয়াদ টানা ৯ বছর এবং একই পরিবার থেকে ৪ জন পরিচালক করার সুযোগ সৃষ্টিকে আরও অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, এমন প্রেক্ষাপটে সুশাসনের কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মূলধন ঘাটতি পূরণে অনেক টাকা দেয়া হয়েছে। আর টাকা না দিয়ে এসব ব্যাংককে একীভূত (মার্জার) করা যেতে পারে। কেননা অনিয়মের মাধ্যমে যে টাকা চলে গেছে তা আর ফেরত আসবে না।

মেঘনা ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ছোট দেশে ব্যাংকের সংখ্যা ৬০ হতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকতে হবে। মানবসৃষ্ট সমস্যা ব্যাংকিং খাতের জন্য অশনি সংকেত। বর্তমানে রোহিঙ্গা ইস্যুও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, মূলধন রক্ষায় ব্যাসেল-৩ কাজ করছে। তবে সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে কিছুই হবে না। সুশাসনের ঘাটতি, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, ঋণ ফেরত না দেয়ার সংস্কৃতির কারণে ব্যাংকিং খাতে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। সবার আগে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বোর্ডকে বোঝাতে হবে। একটি ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, পরিচালনা পর্ষদ ঠিক না হলে ব্যাংকের মূলধন রক্ষা করা যাবে না। এক্ষেত্রে বোর্ডের অনেক কিছু করার রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিডিবিএলের এমডি মনজুর আহমেদ বলেন, সরকারি অনেক ব্যাংকের জন্ম হয়েছে খেলাপি ঋণ নিয়ে। যা বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঘটেনি। তবে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারি ব্যতিক্রম। তিনি বলেন, ঋণের রিসিডিউল ক্ষতির সমাধান নয়; বরং ক্ষতি দ্বিগুণ করে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে ব্যাংকের বোর্ড ও সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। সব ক্ষেত্রে নৈতিকতা বজায় রাখতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ড. লিয়াকত হোসাইন মরল বলেন, সরকারি ব্যাংকে শুধুই প্রাকৃতিক সমস্যা নয়, সবচেয়ে বেশি রয়েছে কৃত্রিম বা মানবসৃষ্ট সমস্যা। তার মতে, প্রকৃত সমস্যা সমাধান করতে না পারলে সরকারি ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া উচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মহাব্যবস্থাপক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, সব কিছুর মূলে খেলাপি ঋণ। আর খেলাপি হচ্ছে যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ দেয়ার কারণে। খেলাপির কারণে বাড়ছে মূলধন ঘাটতি। তিনি বলেন, ব্যাংকের ভেতরে-বাইরে অনিয়ম রোধ করতে না পারলে খেলাপি থামানো সম্ভব হবে না। এর পেছনে যতটা না প্রাকৃতিক, তার চেয়ে বড় কারণ কৃত্রিম। এগুলো বন্ধ করতে হবে। ব্যাসেলের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ব্যাসেল-২ হল- যত ঝুঁকি তত পুঁজি আর ব্যাসেল-৩ হল- যত পুঁজি তত ঝুঁকি।
বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। এক্ষেত্রে বোর্ড ও ম্যানেজমেন্টের দুর্বলতাকেই দায়ী করেন তিনি।

‘অ্যাড্রেসিং ডিজাস্টার রিস্ক বাই ব্যাংকস : বাংলাদেশ পারসপেক্টিভ’ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় ধরনের দুর্যোগে ব্যাংকে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি তার তথ্য ব্যাংকের কাছে নেই। ব্যাংকগুলোর এ তথ্য সংরক্ষণে অনীহা রয়েছে। আমানত, বিনিয়োগে প্রভাব- এ সম্পর্কে ব্যাংকিং খাত কোনো তথ্য সংরক্ষণ করে না। যাবতীয় কৃষি ঋণ বিতরণকে বীমা আওতায় আনতে হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যাংকগুলোকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে হবে বলে ৪৭ শতাংশ ব্যাংকার মত দিয়েছেন। ১৭ শতাংশ ব্যাংকার জানিয়েছেন সচেতনতা প্রয়োজন। এদিকে ‘ইমপ্যাক্ট অব এডোপটিং ব্যাসেল অ্যাকর্ড ইন দ্যা ব্যাংকিং সেক্টর অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী পুঁজি সংরক্ষণ জরুরি।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/10/06/160980