৭ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৮:০০

দ্রব্যমূল্যের যাঁতাকলে নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস

সঞ্চয়-পুঁজি ভেঙে খাচ্ছে সাধারণ মানুষ; আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছে হু হু করে

রাজধানীর মধুবাগ ঝিলপাড়ে মনিরের গ্যারেজ থেকে ভাড়া নিয়ে রিকশা চালান শহীদুল হক। থাকা-খাওয়া বাবদ দিনশেষে পরিশোধ করতে হয় ১৭০ টাকা। এক বেলা রিকশার ভাড়া বাবদ দিতে হয় আরো ৮০ টাকা। পরিবারের সদস্যরা গ্রামে থাকার পরও পকেট খরচসহ শহীদুলের দৈনিক খরচ হয় অন্তত ৩০০ টাকা। তার ভাষায়, রিকশা চালিয়ে কোনো কোনো দিন খরচের টাকাটাও তোলা যায় না।

শহরে রিকশাভাড়া অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পরও খরচ তুলতে না পারার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শহীদুল বলেন, যানজটের কারণে ২০ মিনিটের রাস্তা যেতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। বাড়তি সময়ের জন্য তো কেউ বাড়তি ভাড়া দেয় না। তিন-চারটা খ্যাপ মারতেই বেলা শেষ হয়ে যায়। আয় না বাড়লেও খরচ দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

খিলগাঁও এলাকায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মীর কাজ করেন রিজিয়া বেগম। থাকেন কয়েকজন মিলে মেস করে। স্বামী-সন্তান থাকে ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে। এক আঁটি লালশাকের দাম ৩০ টাকা জানিয়ে তিনি গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমরা তো মাছ-গোশত চাই না। ৬০ টাকার শাক কিনে তিনজন মানুষ এক বেলাও খেতে পারি না। আগে চাউল কিনতাম ৩৬ টাকায়। এখন কিনতে হয় ৫৫ টাকা দিয়ে। বাড়িওয়ালা কয়দিন পরপরই ভাড়া বাড়ায়। সারা মাস মানুষের বাসায় বাসায় ঘুরে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যা পাই, নিজের পেট চালাতেই খরচ হয়ে যায় সব টাকা।’

বিভিন্নপর্যায়ের খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের নি¤œবিত্ত পরিবারগুলো এখন বাজার আতঙ্কে ভুগছে। বিশেষ করে চাল এবং সবজির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অনেক দরিদ্র মানুষ এখন অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। অধিকাংশ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন তারা। চলমান বাজার পরিস্থিতিতে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন নুন আনতে পান্তা ফুরানো এ মানুষগুলো।

রাজধানীর খুচরা বাজারে মোটা চালের কেজি ৫২ থেকে ৫৫ টাকা। সরু চাল কিনতে হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। ৭০ টাকার কমে সবজিও মিলছে না। শাকের কেজিও ৭০ থেকে ৮০ টাকা। ৫৫ টাকায় স্থির হয়ে গেছে পেঁয়াজের দাম। ২৪০ টাকায় উঠেছে কাঁচামরিচের কেজি। নতুন করে ২০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ফার্মের মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে দেড় শ’ টাকা। চাষের পাঙ্গাস ছাড়া সব মাছের দামই আকাশছোঁয়া। চাল-সবজির লাগামছাড়া দাম, পেঁয়াজের ঝাঁজ আর মরিচের ঝালে বাজারজুড়ে বিরাজ করছে হাহাকার অবস্থা। এতে সবচেয়ে বেশি অসহায় অবস্থায় পড়েছেন নির্ধারিত ও স্বল্প আয়ের মানুষ।
বাজারের এই অগ্নিমূর্তি দেখে হতাশ বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা মইনুল গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের মতো মধ্যবিত্তের তো বাজারে ঢুকবার মতো অবস্থাই নেই। তিনি বলেন, চলমান অর্থনৈতিক মন্দায় আয়ের রাস্তাগুলো দিন দিন সরু হয়ে আসছে অথচ জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে। অসাধু ব্যবসায়ীদের ধরতে সরকার সামান্য নড়েচড়ে বসার পরিপ্রেক্ষিতে চালের দাম কিছুটা কমে আবার বেড়ে গেছে মন্তব্য করে মইনুল বলেন, সরকার চাইলে এক সপ্তাহের মধ্যেই বাজার স্বাভাবিক করে ফেলতে পারে। খোঁড়া অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়া অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যকর অভিযান শুরু করার দাবি জানান তিনি।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সোলায়মান শেখ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানান, মাছ-গোশত কেনা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন তারা। ডাল, ডিম, আলু ভর্তাই তার পরিবারের নিত্যখাবার। কেনাকাটার ক্ষেত্রে মহল্লার মুদি দোকানই ভরসা। ‘মাস কাবারি’ বাকি খান। বেতন পেয়ে সাধ্যমতো পরিশোধ করেন। ফলে প্রতি মাসেই বাড়তে থাকে বকেয়ার পরিমাণ। পাওনার অঙ্ক বেড়ে যাওয়ায় লজ্জায় জানতেও চান না কোন জিনিসের কত দাম। বলেন, এভাবে চলতে থাকলে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

মানিকগঞ্জ জেলার সর্ববৃহৎ হাট ঘিওর উপজেলার বরংঘাইল। পাইকারদের কাছে আকর্ষণীয় মূল্যে বিক্রির লক্ষ্যে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পণ্য নিয়ে এ বাজারে হাজির হন কৃষকেরা। রাজধানী ঢাকা থেকে বরংঘাইলের দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। বরংঘাইল বাজারে কৃষক কৃদ্দুছ মৃধা দু’দিন আগে যে কাঁচামরিচ ৩০ টাকা কেজি দরে কিক্রি করতে বাধ্য হলেন, সে মরিচই ঢাকায় তার এক আত্মীয় কিনে খাচ্ছেন ২৪০ টাকায়। অভিযোগ রয়েছে, বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের দুর্বলতা এবং মনিটরিং-এর অভাবে কুদ্দুছ মৃধার মতো কৃষক তার পুঁজি হারাচ্ছেন, আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।

কৃষকপর্যায়ে নামমাত্র দামে বিক্রি হওয়া সবজির দাম রাজধানীতে অত্যধিক হওয়ার জন্য পাইকারি ব্যবসায়ীরা দুষছেন খুচরা বিক্রেতাদের। আর খুচরা বিক্রেতাদের আঙুল সমাজের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার দিকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি, বিভিন্নপর্যায়ে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, বাসাভাড়াসহ সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়া, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিসহ রাজনৈতিক অস্থিরতা-অনিশ্চয়তার প্রভাবও বাজারে পড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। প্রতিটি খুচরা বাজারেই সবজির দাম পাইকারি বাজারের তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ। অত্যধিক মূল্য পার্থক্য দেখা যায় এক বাজারের সাথে অন্য বাজারেরও। বাজার ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের সুযোগেই স্থানে স্থানে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট সিন্ডিকেট।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/257536