৭ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৭:৫৪

ট্রানজিট সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোতেই বড় অংকের ঋণ দিচ্ছে ভারত!

ট্রানজিটের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করতেই বাংলাদেশকে বড় অংকের ঋণ দিচ্ছে ভারতীয় এক্সিক ব্যাংক। ভারতীয় এই ঋণের বিশেষ শর্তই হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার ঋণের এই অর্থ সরাসরি পাবে না, ভারতীয় পণ্য কিনেই এই অর্থ ব্যয় করতে হবে। অন্যদিকে ভারতীয় পণ্য বা সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কোন দরপত্রও আহ্বান বা দরদাম যাচাই করারও সুযোগ পাবে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশে পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অনেকটা একচ্ছত্র অগ্রাধিকার পাবে ভারত। গত বুধবার দুদেশের মধ্যে সম্পাদিত ঋণ চুক্তির টার্ম এন্ড কন্ডিশনে এমন সব শর্তই জুড়ে দেয়া হয়েছে।

ভারতের এই ঋণ চুক্তিতে ভারত নিজেও বড় অংকের আর্থিক সুবিধা বা লাভ করার সুযোগ পাচ্ছে। কেন না ভাতর এই ঋণের আওতায় বাংলাদেশে যেসব পণ্য ও সেবা বিক্রি করবে সেখানে দরদাম করার কোন সুযোগ পাবে না বাংলাদেশ। এতে উচ্চ মূল্য বা অধিক মুনাফা করার সুযোগ পাবে ভারত। অর্থাৎ শুধু ঋণ দেয়া নয় এখানে আর্থিক সুবিধা বা লাভের অনেক বড় সুযোগ তৈরি হবে ভারতে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে ভারত মূলত তাদের নিজেদের স্বার্থেই এই বড় অংকের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর আগে বাংলাদেশে চাল ও পেঁয়াজ রফতানি নিয়েও একাধিকবার তারা শুল্ক হার হ্রাস বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন করেছেন। ভারতে পেঁয়াজ এবং চালের উৎপাদন বাড়লে মূল্য ও শুল্ক কমিয়ে তারা বাংলাদেশে সেগুলো ডাম্পিং করে। আবার দাম বাড়লে শুল্ক বাড়িয়ে দিয়ে রফতানি বন্ধ করে দেয়।
উল্লেখ্য, ভারতের সঙ্গে ৪৫০ কোটি ডলারের বা ৩৬ হাজার কোটি টাকার নতুন একটি ঋণচুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) ধরনের এই ঋণের ধারায় গত সাত বছরের মধ্যে এটি এ ধরনের তৃতীয় চুক্তি। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে লাইন অব ক্রেডিটের অর্থ হলো, এই ঋণের অর্থ খরচ করবে বাংলাদেশ, তবে তা বিশেষ কিছু শর্তের আওতায়। আর এই শর্তসমূহের প্রধানতম শর্তই হচ্ছে ভারতীয় ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ সরকার এই ঋণ গ্রহণ করলেও অর্থ ব্যয়ের স্বাধীনতা থাকবে না বাংলাদেশের। কেন না ঋণ দাতাদের শর্ত ও বেঁধে দেয়া প্রকল্প ছাড়া এই অর্থ অন্যকোন খাতে ব্যয় করার এখতিয়ার থাকবে না বাংলাদেশের। অর্থাৎ কিছু বেঁধে দেয়া প্রকল্পেই কেবল এ অর্থ ব্যয় করা যাবে এবং সেই ব্যয়ের সিংহভাগই ঋণদাতা দেশের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করতে হবে।

সূত্র জানায়, নতুন এই ঋণচুক্তির আওতায় ভারতের বেঁধে দেয়া ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। সব মিলিয়ে দেড় শতাংশ সুদ এবং বেশ কিছু শর্তে এই ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। ভারতকে দেয়া ট্রানজিটের আওতায় যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত সুবিধা ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করার অভিলাস রয়েছে এই ঋণের শর্তে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানেিজটের যে সুবিধা ভারত আদায় করেছে এই ঋণের অর্থে অবকাঠামোগত উন্নয়নে সেই ট্রানজিটকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে এই ঋণের অর্থে ভারতের ব্যবহার উপযোগী বাংলাদেশের সড়ক, নৌপথ, বন্দর, বিদ্যুৎ লাইন উন্নয়ণকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, তৃতীয় ঋণচুক্তির তালিকায় থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ বিতরণ অবকাঠামো উন্নয়ন; পায়রা বন্দরের বহুমুখী টার্মিনাল নির্মাণ; বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার ও তীর সংরক্ষণ; কাটিহার-পার্বতীপুর-বরনগর দিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন তৈরি; মোল্লাহাটে ১০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে এক লাখ এলইডি বাল্ব সরবরাহ প্রকল্পগুলো এই ঋণের আওতায় উন্নয়ণ করা হবে।

অন্যদিকে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত দ্বৈতগেজ রেলপথ নির্মাণ; সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নতকরণ; বেনাপোল-যশোর-ভাটিয়াপাড়া-ভাঙ্গা সড়ককে চার লেনে উন্নীত করা; চট্টগ্রামে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ; ঈশ্বরদীতে কনটেইনার ডিপো নির্মাণ; মোংলা বন্দর উন্নয়ন; চট্টগ্রামে ড্রাই ডক নির্মাণ; মিরসরাইয়ের বারৈয়ারহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত চার লেনে সড়ক উন্নীত করা; মিরসরাই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন; কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর হয়ে সরাইল পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণ; মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রেলপথ নির্মাণ ভারতের ট্রানজিট বাস্তবায়নে বেশ অগ্রনী ভূমিকা রাখবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ভারতীয় ঋণের প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, ভারতের টাকায় তাদের দেশ থেকেই পণ্য ও সেবা জাতীয় জিনিস আনতে হবে। এখানেই আমাদের জন্য দর-কষাকষির সুযোগ আছে। আগে ঋণের টাকার ৮৫ শতাংশ ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যয়ের বিধান থাকলেও তৃতীয় এলওসিতে তা ৬৫ এবং ৭৫-এ আনা হয়েছে। এখানে আমাদের আরও দর-কষাকষি করতে হবে। প্রকিউরমেন্ট বা কেনাকাটায় প্রতিযোগিতা-সক্ষমভাবে আমাদের হিস্যা বাড়াতে হবে। যেহেতু এক দেশ থেকেই টেন্ডার আসবে, সেহেতু বেশি দামে যাতে নিতে না হয়, তা দেখতে হবে। এখানে যেহেতু আন্তর্জাতিক টেন্ডার হচ্ছে না, সেহেতু ৫০ লাখ টাকার বাসের দাম ষাট লাখ টাকা যাতে দিতে না হয়, তা দেখতে হবে। আর তা নিশ্চিত করতে হলে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে আসার দরকার হবে।

বাংলাদেশের আরো একটি উদ্বেগের বিষয় হলো, এলওসি’র আওতায় চুক্তির শর্ত হচ্ছে ভারতীয় ঠিকাদারেরাই প্রকল্পের কাজ পাবেন। ঋণের টাকার পূর্তকাজের প্রকল্প হলে ৬৫ শতাংশ মালামাল ও সেবা ভারত থেকে আনতে হবে। অন্য প্রকল্পে ৭৫ শতাংশ মালামাল ও সেবা ভারত থেকে আনতে হবে। তবে এটা খুব ভালো হতো যদি যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি সাশ্রয়ী হয়, সেখান থেকে মালামাল নেওয়া যেত এবং তা নির্ধারণে আমাদের আরও স্বাধীনতা থাকত। তবে দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্র আসলে এমনটা দেখা যায় না। কারণ, তারা ঋণ দিচ্ছে এই সবকিছু শর্ত মেনে নেওয়ার ভিত্তিতেই। যেহেতু এতে আমাদের ইচ্ছা আছে, তাই এই চুক্তি হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে আলোচনা করে যতটুকু আমাদের পক্ষে নেওয়া যাবে, সেটাই লাভ।
এছাড়া অন্য আর একটা দিকও বিব্রতকর। শর্ত, শর্ত পরিবর্তন, প্রকল্প গ্রহণ-বর্জন ইত্যাদি নানা কারণে ভারতীয় এলওসি’র অধীন ঋণচুক্তির বাস্তবায়নও খুব সরল ও দ্রুত নয়। প্রথম এলওসি’র কাজেরই অনেংকাশ বাকি আছে। দ্বিতীয় এলওসি’র কাজ বলা যায় শুরুই হয়নি। এরমধ্যেই আবার তৃতীয় এলওসি চুক্তি। মনে করা হচ্ছে, বাস্তবায়নের চেয়ে চুক্তি সম্পাদনই যেন মূখ্য।

http://www.dailysangram.com/post/302404