৭ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৭:৪৫

সালামের চোখের সামনেই আদরের সন্তানকে গুলী করে হত্যা করে বর্বর মগাসেনারা

 ২৯ সেপ্টেম্বর বিকেল বেলা। বালুখালী ক্যাম্পের অদূরে একটি চায়ের দোকানে প্রবেশ করলাম। কাজ করতে করতে সারাদিন কিছুই খাওয়ার সুযোগ হয়নি। সংবাদ সংগ্রহ আর ত্রাণকর্মীদের সহযোগিতা করতে গিয়ে কখন যে বিকেল হয়ে গেলো টেরও পাইনি। পেটের জ্বালা মেটাতে চায়ের দোকানে ঢুকে একটা টেবিলে বসলাম। অর্ডার করলাম পরোটা আর চায়ের। বিপরীত দিক থেকে সামনে বসা ছিল ছবির এই লোকটি। নজর গেলো তার দিকে। সে ওখানে বসে টাকা গুণছে। টাকা গুণার স্টাইল দেখে বুঝতে পারলাম সে এখানকার স্থানীয় কেউ না। চা পান করছি আর নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছি। টাকাগুলো থেকে বেশ কিছু টাকা সে আলাদা করে একটি পকেটে নিলো। আর বাকী টাকা লুঙ্গির গিটের সাথে সেট করে নিলো। এগুলো করতে করতে একপর্যায়ে অনেকটাই অভিমানী কন্ঠে সে হোটেল বয়কে বলে উঠলো, "নাস্তার বিল নিলে আর কত টাকা নিবে; সবকিছুই তো ছেড়ে চলে এসেছি"। তখনই মোটামুটি বুঝতে পারলাম সে নবাগত রোহিঙ্গা মুসলিম। ঘটনাক্রমে জানতে পারলাম সে উক্ত দোকানে একটু নাস্তা আর চা পানের আশায় প্রবেশ করেছে আমারও আধ ঘন্টা আগে। কিন্তু হোটেল বয়; রোহিঙ্গা লোকটি বিল দিতে অপারগতা দেখাতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে তাকে খাবার সরবরাহ থেকে বিরত ছিলো এবং অনেকটাই গড়িমসি করছিলো।

বিষয়টি লক্ষ্য করার পর হোটেল বয়কে হালকা ধমক দিয়ে বললাম, লোকটি কি চাচ্ছে এখনি দিয়ে দাও। এরপরের গল্প.... লোকটির চোখে ছল ছল করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আর আমিও এক এক করে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে যাচ্ছি তাকে। তিনি আব্দুস সালাম (৪০)। মংডুর বলিবাজার এলাকার বিশিষ্ট পান ব্যবসায়ী। গত ২৮ দিন (সেদিনের হিসেবে) হলো এদেশে প্রবেশ করেছে। এখন পর্যন্ত কোন ত্রাণ সে সংগ্রহ করেনি। কারোও কাছে হাতও পাতেনি। এসব ত্রাণ দান কোন কিছুরই সে পরোয়া করে না। স্ত্রী সন্তান মিলে ৭ জনের সংসার তার। তার কথা শুধু একটাই "আমি ত্রাণ দান ভিক্ষা কোন কিছুই চাইনা; আমি শুধু আমার দেশে ফিরে যেতে চাই"।
কৌতুহল বশত জানতে চাইলাম, বার্মা থেকে আসার সময় অনেক টাকা নিয়ে এসেছেন মনে হয়? জবাবে সালাম আমাকে জানালো সর্বশেষ খরচ দিয়ে বাংলাদেশে যখন সে পা রাখে তখন তার পকেটে বর্মী টাকার ৬০ টাকা অবশিষ্ট ছিলো। এরপরেই একটু বিরক্ত হয়ে জানতে চাইলাম; "তাহলে আপনি পরিবার চালাচ্ছেন কিভাবে"?
এরপরের গল্প আরোও করুণ...
প্রথম ২দিন টানা উপোস থাকি। পরিবারের অন্যান্যরা ওইদিক থেকে আসার সময় অল্প স্বল্প খাবার যা এনেছিলো তা খেয়ে দিন পার করেছে। মানুষের কাছে হাত পাততে ভাল লাগেনা তাই কোন কিছু করে উপার্জনের চেষ্টা করতে থাকি। সে হিসেবে একটা ব্যবসা খোঁজার চেষ্টা করি। ৩য় দিনের মাথায় এমন একজনকে পেয়ে যাই। তিনি আমাকে সহজ শর্তে কিছু পান এনে দেন। সেখানে ৫০০ টাকার মত হবে। সেদিন থেকে প্রতিদিন তার কাছ থেকে পান নিই। আর বিক্রি করি বাজারে।
লাভ কত হয়? মূলধনের টাকা ফেরত দিলে শ'দুইশ টাকা থাকে।
ভাজ করছিলেন টাকাগুলো কি ব্যবসার? হ্যা।
কত টাকা লাভ হলো? ২০০ টাকা।

এইটা দিয়ে সংসার চলবে? আলহামদুলিল্লাহ চলে যাবে।
ত্রাণ সংগ্রহ করলেতো এতক্ষণে কমপক্ষে হাজার দুএক টাকা পেতেন?
আত্ম নির্ভরশীল এই মহান রোহিঙ্গা মুসলিম ভাইয়ের জবাব শুনে তখন এত লোকের সামনে চর্ম চক্ষুর পানি আটকে রেখেছিলাম। তবে মনের চোখ সেই থেকে আজ অবধি কাঁদছে তার জন্যে।
জবাবটি ছিলো এমন, ‘ভাই ত্রাণ আর দান খেতে এখানে আসি নাই। আমার চোখের সামনে আমার বড় ছেলে নূর ফয়সালকে (১৬) গুলী করে হত্যা করছে। সে অত্যন্ত অমায়িক ছিলো। যত ধন ফেলে এসেছি সে আমার সব চাইতে বড় ধন। পালিয়ে আসার সময় তার লাশটি পর্যন্ত দাফন করতে পারিনি। সেখানে আমি নিজে প্রতি সপ্তাহে মুরগী জবাই করে গরীবদের খাওয়াতাম। আসার সময় বড় বড় গরু ছিলো ২২টি। চাউল ছিলো ২৭০ বস্তা। প্রায় ৮৯ কানি জমি জমা ছিল। হাস মুরগীতো ছিলো অনেকগুলো। আর এই ছেলে এখন আমার কাছে এসে ২/৩ বার টিটকারি মেরে জিজ্ঞেস করলো বিল দিতে পারবো কিনা; বলেই হু হু করে অজর নয়নে কাঁদতে লাগলো সালাম। আমি বললাম তোমাকে অল্প কিছু টাকা দেই। কাজে লাগবে। সে কোন ভাবেই নিতে চাইলো না। তাকে অনেক অনুনয় বিনয় করে বললাম দয়া করে টাকাটা নাও। ব্যবসার কাজে লাগবে। ঐ পানওয়ালা লোকের কাছে আর মূলধনের টাকা জমা দিতে হবেনা। অল্প কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম এই মূলধনে পান ক্রয় করে বিক্রি করলে কত টাকা লাভ হবে? সে কিছুক্ষণ ভেবে বললো ৫শ' টাকা মত লাভ হবে।

http://www.dailysangram.com/post/302410