উখিয়া সীমান্তে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পাড়ায় আগুনের লেলিহান শিখা ও ধোঁয়া। গতকালের ছবি
৫ অক্টোবর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০৩

সীমান্তে এখনো জ্বলছে রোহিঙ্গাদের গ্রাম

ফের আসছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা

সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ থামছে না। এক সপ্তাহ ধরে রোহিঙ্গা প্রবেশ বন্ধ থাকলেও হঠাৎ করে টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া, লম্বাবিল ও শাহপরীর দ্বীপের নাফ নদী ও সাগর পয়েন্ট দিয়ে ফের আসছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এ দিকে গত রোববার ঢাকায় মিয়ানমারের সিনিয়র মন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মিয়ানমারের নতুন মংডু, রাচিডং ও বুচিডংয়ের গ্রামের শত শত বাড়ি পোড়ানো হচ্ছে। এপার থেকে আগুনের লেলিহান শিখা ও ধোঁয়া উড়তে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন।

গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আগুনে জ্বলছে পুরো আরাকান। প্রতিদিনই আরাকানের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত কোনো না কোনো গ্রামে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে। শত শত ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে, ২৫ আগস্ট থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত অন্তত দশ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন আরাকানে আসলে কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তা কোনো দিন প্রকাশ পাবে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। সব হারিয়ে জীবন বাঁচাতে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা।

গত মঙ্গলবার ও আগের দিন সোমবার রাতে টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া ও শাহরীর দ্বীপ নাফ নদী পয়েন্টের সীমান্ত দিয়ে ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রথমে চলে আসার জন্য মাইকিং করলেও এখন বাধা দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তাদের চলে আসার জন্য মিয়ানমারের সেনারা সহযোগিতা করেছে। তারা জানিয়েছেন, সেনারা লম্বাবিল ও উলুবনিয়া রাস্তার মাথা পয়েন্টে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ক্যাম্পে পৌঁছানোসহ বিভিন্ন সহযোগিতা দিচ্ছে।

সীমান্তের তিন উপজেলা টেকনাফ, উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ির সড়ক-মহাসড়ক কিংবা গ্রামের মেঠোপথে এখন রোহিঙ্গা ¯্রােত। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কাদায় একাকার হয়ে তারা সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নাফ নদী পার হতে গিয়ে তারা লাশ হচ্ছেন। রাতে নৌকায় করে পালিয়ে আসার সময় প্রতিদিনই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটছে। নাফ নদী কিংবা টেকনাফ সমুদ্র উপকূলে প্রতিদিনই রোহিঙ্গাদের লাশ ভেসে আসছে। সৈকতে আছড়ে পড়ছে নারী ও শিশুর লাশ।

কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ এবং বান্দরবনের নাইক্ষ্যংছড়ির পুরো সীমান্তজুড়েই হাজার হাজার রোহিঙ্গা তাঁবু টাঙিয়ে আশ্রয় দিয়েছেন। কিছু দিন বন্ধ থাকার পর আবার হঠাৎ রোহিঙ্গাদের আগমনে হতবাক এখানকার প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিজিবি, এবং জনপ্রতিনিধিরা। এ দিকে মিয়ানমারের বুচিডং এলাকায় সেনা-পুলিশ নতুন করে নির্যাতন শুরু করেছে। নির্যাতনের মুখে ওই এলাকার হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন। জানা গেছে, ১০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই রাখাইনের বুচিডং থানা এলাকার।

নতুন করে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার কারণ সম্পর্কে জানা যায়, রোহিঙ্গা গ্রামগুলোকে সেনারা অবরুদ্ধ করে রেখেছে কয়েক সপ্তাহ ধরে। গ্রাম থেকে তারা কোথাও বের হতে পারছেন না। কাজকর্মে যেতে পারছেন না। পাশাপাশি ত্রাণ দেয়ার কথা বলে সারিবদ্ধ করে প্রথমে ত্রাণ দিয়ে ভিডিও করা হয়। ভিডিও করা শেষে ত্রাণগুলো কেড়ে নেয়া হয়। ফলে তাদের গ্রামে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। আবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসা আত্মীয়স্বজনের সাথে মোবাইলে আলাপ করে তারা জানতে পারেন এপারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী ও খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। তাই অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে ও খাদ্যাভাবের কারণে তারা পালিয়ে এসেছেন।

মংডুর দাবাংসা এলাকার বৃদ্ধ লায়লা খাতুন জানান, এক সপ্তাহ আগে রাতের অন্ধকারে গ্রামের কয়েক শ’ লোক একসাথে পালিয়ে আসেন। তারও এক সপ্তাহ আগে থেকে গ্রাম অবরুদ্ধ করে রেখেছিল সেনা ও বিজিপি সদস্যরা। এভাবে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলে এক রাতে গ্রাম ছাড়েন তারা। লম্বাবিল এলাকার আবু শামা পরিবারের দশ সদস্য নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, কয়েক সপ্তাহ ধরে অবরুদ্ধ তাদের গ্রাম। বাড়িতে কোনো খাবার ছিল না। তাই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছিল। শেষে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

বুচিডং জব্বার পাড়ার আমিনা বেগম জানান, কয়েক সপ্তাহ ধরে সেনারা গ্রাম অবরুদ্ধ করে রেখেছে। মাঝে মধ্যে তাদেরকে ডেকে নিয়ে ত্রাণ দেয়া হয়। ত্রাণ দেয়ার দৃশ্য ভিডিও করে পরে আবার সে ত্রাণ কেড়ে নেয় সেনা ও তাদের সাথে থাকা মগ-নাডালা। মংডুর রইগ্যাবিল এলাকার মো: ছিদ্দিক পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। নৌকায় নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফের নাইট্যংপাড়া এলাকায় এসেছেন তিনি। এখানে পৌঁছার সাথে সাথে কয়েকজন মাওলানা তাদেরকে দেড় হাজার করে টাকা ও খাবার দেন। বাংলাদেশে পৌঁছতে পেরে ভালো লাগছে। একই নৌকায় পরিবারের ৬ জনকে নিয়ে টেকনাফের নাইট্যংপাড়া পৌঁছেন বুচিডং থাইম্যাংখালীর সৈয়দুল ইসলাম। তাদের গ্রামে সেনারা অভিযান না চালালেও অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। ফলে কাজকর্মের অভাবে গ্রামে খাদ্যাভাব দেখায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

কক্সবাজারের আইওএম অফিসের সংযুক্তা সাহনী জানান, পহেলা অক্টোবর পর্যন্ত ৫ লাখ ৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। এখনো সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে খুব দ্রুতই এ সংখ্যা সাড়ে ৫ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সরকারের নিয়মানুযায়ী আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরে আবাসন, স্যানিটেশন, ওষুধ ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। প্রতিদিন এসব মানুষের বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সার্বক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে আইওএম।

২৪ আগস্ট রাতে ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনার পর থেকে আরাকানে সেনা অভিযান শুরু হয়। ইতোমধ্যে আরাকানের তিনটি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জেলায় ৫ হাজার বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং তিন হাজার রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও এ সংখ্যা আরো বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/257212