৫ অক্টোবর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৪

গরু মেরে জুতাদানের কূটনীতি

মাসুদ মজুমদার

গণমানুষ ও বিশ্বসম্প্রদায়ের সাথে এবারই সমাজতান্ত্রিক ব্লকের দূরত্বটা উদোমভাবে ধরা পড়ল। একসময় এ অবস্থাটা ছিল না। পুঁজিবাদী বিশ্বের সাথে সমাজবাদী বিশ্বের তত্ত্বীয় দূরত্ব থাকলেও একটি জায়গায় মিল ছিল। মিলটা ছিল বিশ্বজনমতকে গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে। ‘বিশ্বসম্প্রদায়’ মানে কোনো বিশেষ গোষ্ঠী নয়; বিশেষ কোনো মতবাদে বিশ্বাসী নয়! তবে মানুষের দুঃখ-কষ্টে তারা সংবেদনশীলতা দেখায়। জনগণ ও ন্যায়ের পথে অবস্থান নেয়। এরা অসঙ্ঘবদ্ধ, কিন্তু এরাই বিশ্বজনমতের অঘোষিত মুখপাত্র। বিশ্বসম্প্রদায়কে কোনো দেশ ভাবা হয় না। পুঁজিবাদী বিশ্বের মোড়লেরা স্বভাবগতভাবে সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে সমাজবাদী রাষ্ট্রের মোড়লেরা এর মোকাবেলায় তৃতীয় বিশ্ব, বিশ্বসম্প্রদায় ও মজলুম জনগোষ্ঠীর প্রতি মমত্ববোধ পোষণ করতেন। স্বাধীনতাকামী জনগণ ও জাতিগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর একটা সাধারণ রীতি বা প্রবণতা দেখা যেত তাদের মাঝে। ব্যতিক্রম যে হতো না তা নয়।

এবার পরিস্থিতি একেবারে উল্টো। চীন-রাশিয়াকে এবারই সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে দেখা গেল। এর আগে গণচীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদের সমান্তরাল অবস্থান নিলেও বিশ্বসম্প্রদায় বিশেষত মজলুম মানুষের প্রতি, মুক্তিকামী মানুষ ও সাধারণ শ্রমজীবীদের প্রতি কূটনীতির ঊর্ধ্বে তাদের সহমর্মিতা প্রদর্শিত হতো। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে চীন-রাশিয়ার বিদেশনীতি সব সময় পরিচালিত হতো, এখনো হয়। কিন্তু গণমানুষের জন্য মার্কসবাদ ও মাওবাদের অনুকূল অবস্থানটা একেবারে আড়ালে থাকত না।

এখন মনে হচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্বের মোড়লদের চেয়েও সমাজতান্ত্রিক ব্লকের প্রধান দু’টি দেশের নেতৃত্বের অবস্থান আরো বেশি পূতিগন্ধময়। এটা যেন পোলাও পচলে ছুড়ে ফেলে দেয়ার মতো। কথায় আছে ভাত পচলে তিন ধোয়া দিয়ে খাওয়া যায়। কিন্তু পোলাও পচলে খাওয়া তো দূরের কথা, ছুড়ে ফেলে দিলেও দুর্গন্ধ ছড়ায়।

রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে চীন-রাশিয়ার রাষ্ট্রিক অবস্থান আমাদের এমন একটি ঋজু মন্তব্যের জন্য প্রস্তুত করেছে। একসময় পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ, এ দুটোর মধ্যে মন্দের ভালো বাছাই করার জন্য বলা হলে আমরা সমাজবাদকে একটু এগিয়ে রাখতাম। এখন দেখছি, পুঁজিবাদ হিংস্র, হায়েনার লালাতুল্য হলে সমাজবাদ তার চেয়ে কম নয়। ‘তারুণ্যে একবার বামপন্থী হওয়া মানুষের স্বভাব ধর্ম, চল্লিশোর্ধ্ব বয়স হলে মোহভঙ্গ হওয়াও বয়সের ধর্ম।’ এটি জার্মান প্রবাদ। প্রবাদ-প্রবচন অভিজ্ঞতা বিধৌত হয়ে স্থায়িত্ব পায়। তাই এসব প্রবাদ-প্রবচন ফেলনা নয়।

এবারো মুক্তবিশ্বের সাধারণ মানুষ রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সৈন্যদের সীমাহীন বাড়াবাড়ির মুখে যে সহমর্মিতা দেখিয়েছে, সেটা রাষ্ট্রাচারের কোনো তোয়াক্কা না করেই করেছে। মানুষ মানুষের জন্য- এমন একটি ভাবনা সব দেশের জনগণের মধ্যে সক্রিয় দেখেছি। এমনকি চীন-রাশিয়া ও ভারতের সাধারণ জনগণও রাষ্ট্রের মুখপাত্রদের সাথে সুর মেলায়নি। বিশ্বমিডিয়ার অবস্থানটাও ইতিবাচক। তাই সহজ উচ্চারণ, জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে ফোরামটিকে আরো বিদ্রƒপের পাত্র বানিয়েছে চীন-রাশিয়া। বিশ্ববাসী এই উপমা কখনো ভুলে যাবে না। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজনমতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ঠকেনি। অপর দিকে, রাশিয়া-চীন বস্তুগত সম্পদ হারায়নি। যা হারিয়েছে সেটা নিজেরা যেমন কোনো দিন পূরণ করতে পারবে না, তেমনি পুঁজিবাদী বিশ্বের কাছে যে ইমেজটা খুইয়েছে তার খেসারত দিতে হবে অনেক দিন। ভারতের আরএসএস বলছে, রোহিঙ্গারা নিরাপত্তার প্রতি হুমকি। এমন বক্তব্য আরএসএসের সাথেই মানায়। রক্তখেকো বলে কথা। ভারতের মোদি সরকার এক দিকে বলছে তারা মানবিক দিকটা দেখছে। অন্য দিকে কথা বলছে মিয়ানমারের পক্ষে- এই চানক্যনীতি কৌটিল্য শাস্ত্রের, মানবতাবাদের নয়। রাশিয়াও ভারতের চটিতে পা ঢুকিয়ে দিয়ে পথ চলছে। চীনের কূটনীতি দুর্বোধ্য হলেও- এই তিন শক্তি গরু মেরে জুতাদানের মতো কূটনৈতিক আচরণ করছে বাংলাদেশের সাথে। এক দিকে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও রাষ্ট্রহীন করে দেয়ার ব্যাপারে নিশ্চুপ এবং নির্বিকার; অন্য দিকে ত্রাণের ভিক্ষারূপী প্রহসন! বাংলাদেশের সাথে এমন কূটনৈতিক চাতুর্য প্রকারান্তরে ধর্ষক, খুনি, হত্যাকারী, লুণ্ঠনকারী ও অগ্নিসংযোগকারীদের পক্ষে সাফাইয়ের কৌশল; মানবতার প্রতি বিদ্রƒপ। এই তিন দেশের ত্রাণ ওয়াক থু বলে প্রত্যাখ্যান করাই সমীচীন ছিল। ভারত, চীন ও রাশিয়ার সাথে আমাদের বন্ধুত্ব মিয়ানমারের রোহিঙ্গার শর্তে নয়। এটা জেনে মেনে এবং বিবেচনায় রেখেও আমরা হতবাক ও বিস্মিত। কারণ মানবতার গুরুত্ব তাহলে আর থাকে না।

সমাজবাদের প্রতি আমাদের যে দুর্বলতাটুকু ছিল সেটা অবশিষ্ট রইল না। চীন নিজের দেশে মুসলিমপ্রধান এলাকায় কতটা অসহিষ্ণু, সেটা কারো অজানা নয়। মুসলিম নাম রাখা, ঘরে পবিত্র কুরআন রাখার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করে চীন ইসলাম ঠেকাতে চাইলে ভুল করবে। বরং ইসলামের মানবিক ধারণা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং আন্তর্জাতিকতাবাদকে চীন উপভোগ করতে পারত। রাশিয়া আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে পরিণতি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে কী পেল, তার হিসাব মেলাতে বসলেই লাভবান হতো বেশি। ইসলামের নবীর একটি উক্তি রয়েছেÑ ‘জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে চীনে যাও।’ এটা দূরত্ব বুঝাতে বলা হলেও চীন কখনো আমাদের চোখে শত্রু ছিল না। বরং ’৭১-এর ক্ষত নিয়েও বন্ধু রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার বিদেশনীতিতে এবার শুধু অযোগ্যতার প্রমাণ দিলো না, কূটনীতির রাজ্যে এই সরকার যে দুগ্ধপোষ্য শিশুতুল্য, তাতে কোনো সন্দেহ রাখল না। বিশ্বজনমতকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে বেশ অক্ষমতার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। চীন, রাশিয়া, ভারত কেন বাংলাদেশের সাথে নেই- এই প্রশ্নটি আহাম্মকের। কারণ কোনো দেশই এই সরকারকে প্রকৃত অর্থে বন্ধু বানায়নি। পোষ মানিয়ে যার যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ব্যবহার করেছে- নিজের স্বার্থটা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে বন্ধুরা তা ছদ্মবেশী হোক আর আসল বন্ধুই হোক- তারা জেনে রাখুক, ১৬ কোটি মানুষ বানের পানিতে ভেসে আসেনি; ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য আর প্রকৃতির ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবেলা করে এই জনপদের মানুষগুলো টিকে আছে। টিকে থাকবেও ইনশাআল্লাহ।

আমাদের সরকারকে সবাই অবমূল্যায়ন করেছে। কারণ সবাই জানে, এই সরকার ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত বা জনসমর্থিত নয়, জনগণের গ্রহণযোগ্য ভোটে নির্বাচিত নয়। ম্যান্ডেটহীন সরকার কোনো দিন কোনো অঞ্চলে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে সম্মানিত হয় না, বরং এই দুর্বলতাকেই তারা পুঁজি বানায়। অপর দিকে, যত দুর্বলই হোক একটি নির্বাচিত সরকার নিজের দেশের জনগণের দোহাই দিয়েই কূটনীতির টেবিলে বার্গেনিং ক্ষমতা বাড়ায়। জনগণের দোহাই দিয়েই নিজেদের অবস্থানটা দৃঢ় ও প্রশস্ত করে। তা ছাড়া আমাদের সরকার চীনকে কাছে টানতে গিয়ে ভারতকে নাখোশ করেছে। রাশিয়াকে পেতে পড়শিদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। ভারসাম্যটা রক্ষা করে কূটনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

একজন প্রবাসীর মন্তব্য, ত্রাণকাজেও সরকার সক্রিয় হলো না। সরকারি ত্রাণ চোখেই পড়ল না। এক ‘ড্যাব’ যদি পক্ষকালজুড়ে চিকিৎসাসেবা দিতে পারে- ‘স্বাচিপ’ কেন পারল না? পিজির বারান্দায় এত ডাক্তার ঘোরেন, তারা কি শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াতে পারতেন না? সরকার অনুগত বণিক দল ও পার্শ্ব সংগঠনগুলো এখন কোথায়!
ত্রাণকাজে আমাদের সেনাবাহিনী বিদেশে শান্তিরক্ষী হিসেবে জাতিসঙ্ঘ মিশনে সুনাম কুড়ায়, কিন্তু আমাদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় ত্রাণবিতরণে দুর্নাম বিশ্ববিদিত। কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অভিযোগ শুধু উপহাস ছিল না; সে সময়ের বাস্তবতাও ছিল।

বাংলাদেশের অনেকে বিদেশী দালাল না হোক, নানা কারণে বিদেশনির্ভরতা দেখায়। একসময় মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা তোলার প্রচুর লোক ছিল। পিকিংয়ে চীনা নেতারা কাশি দিলে ঢাকায় অনেকেই কান খাড়া করে দিতেন।

বাদশাহীতন্ত্রকে তীব্র ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যানকারীরা দেশে বসে খিলাফত মুলকিয়াত নিয়ে পাঠচক্র করতেন। অপর দিকে, স্রোতে গা ভাসালেন তারা। বিপ্লবের তরক্কির জন্য হাত পাততেন- এই অভিজ্ঞতা মিথ্যা বলার সাহস কার আছে? ব্রাদারহুড হামাস-কাতার কি টের পাচ্ছে না?

এসব কথা অভিমানের নয়, উপলব্ধির। তাই রোহিঙ্গাদের নিয়ে বড় রাষ্ট্রগুলোর খেলা বুঝতে কষ্ট হয় না। পৃথিবীতে এভাবেই মানুষ দাস হয়; রাষ্ট্রহীন হয়; শরণার্থী হয়। এভাবেই মানচিত্র পাল্টায়। ভূরাজনীতির ছক পাল্টে যায়। তাই অকপটে মেনে নেয়া উচিত- আদর্শিক মুক্তির পথ রচনা করতে হয় নিজস্ব বলে প্রতিকূলতার সাথে বুদ্ধির লড়াই করে। কোনো দেশের দালালি করে তা হয় না। যদি হতো, রুশপন্থীরা এখন বিরল প্রজাতি হতেন না। চীনপন্থীদের এতটা ‘নাই’ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল না। আরবপন্থীরা জিহ্বায় কামড় দিয়ে পস্তাতেন না। হামাস, ব্রাদারহুড নিয়ে গত সংখ্যায় লিখেছি। কাতার নিয়েও হাপিত্যেশ কম হলো না। সাদ্দামপন্থীরা এখন মুখে রাও করেন না। অথচ পূর্বাপর বাংলাদেশপন্থীরা খুব একটা খারাপ নেই। আল্লাহর ওয়াস্তে যারা পথ চলেন তারাও মন্দ থাকার কথা নয়।

আমরা নিশ্চিত, প্রতিটি দুঃখ দিনের পর সুদিন আসে। রাত গভীর হলে ভোরের আলো ফোটার সময় কমে আসে। মজলুম আহাজারি করলে রহমত একটু বিলম্বে হলেও বর্ষিত হয়। তা ছাড়া, প্রত্যেকটি ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া অনিবার্য। আমাদের উচিত আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সাধ্যমতো সচেষ্ট থাকা। ভাঙাগড়ার খেলায় সভ্যতা স্থান বদলায়, রূপও পাল্টায়। ব্রিটিশ রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, এখন যায়।

masud2151@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/257176