মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দিলেও থেমে নেই অনুপ্রবেশ। নাফ নদী পাড়ি দিয়ে শাহপরীর দ্বীপে কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার - রয়টার্স
৪ অক্টোবর ২০১৭, বুধবার, ৮:৪৫

ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাসের মধ্যেই রাখাইন ছাড়তে মাইকিং

রাখাইনের গ্রামে খাদ্যাভাব প্রকট হচ্ছে * ‘মুসলিমমুক্ত এলাকা’ ঘোষণা দিয়ে পথে পথে সাইনবোর্ড * সীমান্তে ফের মাইন বিস্ফোরণে এক রোহিঙ্গা নিহত

রোহিঙ্গাদের রাখাইন ছাড়তে মাইকিং করছে সেনাবাহিনী ও উগ্র মগরা। তারা রাখাইনকে মুসলমানমুক্ত এলাকা ঘোষণা দিয়ে পথে পথে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে। এরপরও যারা সেখানে আত্মগোপনে ছিল তারা তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে। ফলে বাধ্য হয়ে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। সেনাবাহিনী ও মগদের নির্যাতনের ভয়ে পালাতে গিয়ে সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন এক রোহিঙ্গা।


এ পরিস্থিতিতে সু চির দফতরের মন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু তাতে ভরসা রাখতে পারছেন না পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। আস্থা রাখতে না পারায় বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গার ঢল থামছে না। প্রতিদিনই হাজার হাজার রোহিঙ্গা ঢুকছে। অপেক্ষায় আছে আরও কয়েক হাজার।

মঙ্গলবার ভোরে ও সোমবার রাতেও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, পৌরসভার নাইট্যংপাড়া ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া, উনচিপ্রাং ও লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমার সীমান্তে আরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা এপারে পালিয়ে আসার অপেক্ষায় রয়েছে।

শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে মঙ্গলবার ভোরে পালিয়ে আসা বুচিদং থাইম্যাখালীর সৈয়দুল আমিন জানান, তাদের গ্রামের পাশের মগদের গ্রাম। সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের চলে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। এখন সু চি তাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলছেন। সু চি বা তার মন্ত্রীদের কথা বিশ্বাস করা যায় না বলে জানান তিনি। কাজেই বৃদ্ধ মা ও পরিবারের ৬ সদস্য নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। দমন অভিযান শুরুর পর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামে পালিয়ে থেকেছেন। ভেবেছেন পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে। দেশে থাকতে পারবেন। কিন্তু এক মাস পার হয়ে গেলেও সে ধরনের কোনো অবস্থা না দেখে তিনি পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া রাখাইনের গ্রামগুলোতে খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে বলে তিনি জানান। আমিন বলেন, যেসব গ্রামে কিছু কিছু খাবার ছিল তা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছেন। আস্তে আস্তে খাবারের মজুদও ফুরিয়ে আসায় এপারে পালিয়ে আসেন। বাংলাদেশে এলে অন্তত না খেয়ে মরতে হবে না এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই তারা পালিয়ে এসেছেন।

মংডু গদুছড়া এলাকার মৌলানা ইউছুপ ৮০ বছরের বৃদ্ধ পিতা মোহাম্মদুর রহমান ও ৭০ বছরের বৃদ্ধ মা মাবিয়া খাতুনকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন রাখাইনের মংডু হাইচ্ছুরাতা খামারের বিল এলাকা থেকে। তিনি নিজে মংডুতে একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। সংঘাত শুরু হলেও এতদিন যেসব গ্রামে কিছু লোকজন ছিল এবং যেসব গ্রামে সেনা অভিযান শিথিল ছিল সেসব গ্রামে পালিয়ে থেকেছেন। নিজেদের তেমন কোনো টাকা-পয়সা না থাকলেও আশ্রয় নেয়া গ্রামের লোকজন তাদের খাইয়েছেন কিন্তু ধীরে ধীরে ওইসব গ্রামেও খাদ্যাভাব দেখা দেয়। গ্রামের লোকজন বাইরে যেতে পারছেন না। দমন অভিযানের কারণে কাজেরও সুযোগ নেই। জমিতে কৃষি কাজ করে ফসল ফলানোর অবস্থাও নেই। ফলে গ্রামে গ্রামে চলছে খাবারের সংকট। এ অবস্থায় বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে নিয়ে চলে আসেন বাংলাদেশে। তার পিতা হাঁটতে পারেন না। মজুরির বিনিময়ে দুই রোহিঙ্গা তার পিতাকে বহন করে নিয়ে এসেছেন। নাফ নদী পর্যন্ত পৌঁছে দিতে দু’জনকে ৫০ হাজার কিয়েট দিতে হয়েছে। নিজের পরিবারের স্ত্রী-সন্তানদের এখনও আনতে পারেননি। তারাও চলে আসবে আজকালের মধ্যে জানান তিনি।

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস সু চি সরকারের এক ধরনের প্রতারণা বলে মনে করেন তিনি। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেন মৌলানা ইউছুপ।

মঙ্গলবার হোয়াইক্যং উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে এসেছেন দিল মোহাম্মদ। তিনি বুচিদং কেপ্রুদং এলাকায় থাকতেন। তার সঙ্গে আছে ভাই নুর মোহাম্মদের পরিবার। দুই পরিবারের নারী শিশুসহ মোট ১৩ সদস্য নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। দিল মোহাম্মদ পেশায় জেলে। জানান, ২০ দিনের বেশি সময় অবরুদ্ধ হয়েছিলেন গ্রামে। তার ওপর প্রতিনিয়ত মৃত্যুভয় কখন সেনা গুলি করে। এভাবে থাকতে থাকতে খাবার শেষ হয়ে যায় তাদের। এদিকে খবর পান বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের এদেশের সরকার খাদ্য ও বাসস্থান দিয়ে সহায়তা করছে তাই জীবন বাঁচাতে চলে আসেন এদেশে।

রাখাইন রাজ্যকে ‘মুসলিমমুক্ত এলাকা’ ঘোষণা পথে পথে সাইনবোর্ড স্থাপন : মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে বহু গ্রামের প্রবেশপথে দেখা মিলবে অদ্ভুত এক ধরনের সাইনবোর্ডের। তাতে বার্মিজ ভাষায় বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে, ‘মুসলিমমুক্ত এলাকা’। সঙ্গে রয়েছে আরও নানা মুসলিমবিদ্বেষী বার্তা। অবশ্য শুধু রাখাইন কিংবা আরাকান রাজ্য নয়, মিয়ানমারের অন্যান্য রাজ্যেও এমন সাইনবোর্ডের দেখা মেলে প্রায়ই। মিয়ানমারের মানবাধিকার সংগঠন ‘বার্মা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক (বিএইচআরএন), এ রকম ২১টি সাইনবোর্ডের ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করেছে। সংস্থাটির সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে এ নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, এ ধরনের মুসলিমবিদ্বেষী সাইনবোর্ডের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে।

এ ধরনের বিদ্বেষমূলক সাইনবোর্ড ঝুলানোর জন্য স্থানীয় সরকারি কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়ে থাকে। মিয়ানমারের শান প্রদেশের ইয়াসাউক শহর থেকে বিএইচআরএনের তোলা একটি সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘মুসলমানমুক্ত এলাকা’। তার নিচে তিনটি পয়েন্টে লেখা : ১. এই এলাকায় রাতে মুসলমানদের থাকার অনুমতি নেই। ২. মুসলমানদের সম্পত্তি বিক্রি বা কেনার অনুমতি নেই। কোনো মুসলমানকে বিয়ের অনুমতি নেই। এই বোর্ডটি লাগিয়েছে ‘দেশপ্রেমী যুবসংঘ’ নামে স্থানীয় একটি সংগঠন।

এ ধরনের নানা মুসলিমবিদ্বেষী সাইনবোর্ডের পাশাপাশি রয়েছে বৌদ্ধ ধর্ম ও জাতিকে ‘সবার চেয়ে সেরা’ হিসেবে তুলে ধরে বিভিন্ন বক্তব্য। বিএইচআরএনের নির্বাহী পরিচালক কিয়াও উইন বলেন, এ ধরনের বোর্ড লাগানোর ক্ষেত্রে সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা রয়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি-মিয়ানমার সীমান্তে আবারও মাইন বিস্ফোরণে এক রোহিঙ্গা নিহত : বাংলাদেশ-মিয়ানমার নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তের জিরো পয়েন্ট ৪৪ নম্বর সীমান্ত পিলার চাকঢালা বিওপি ওপারে মাইন বিস্ফোরণে এক রোহিঙ্গা নাগরিক নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তি হলেন মিয়ানমারের মংডু জেলার তাইংডেবা বলিবাজার গ্রামের বাসিন্দা মৃত কাছিম উদ্দিনের পুত্র নুরুচ্ছফা (৩০)।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ৩ অক্টোবর মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটার সময় সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় মাইন বিস্ফোরণে এ ঘটনা ঘটে।

স্থানীয়রা আরও জানান, নিহত রোহিঙ্গা নাগরিকসহ বেশ কয়েকজন সীমান্ত পেরিয়ে নিজ এলাকায় ফেলে আসা গরু আনতে যায়। গরু নিয়ে আসার সময় মাইন বিস্ফোরণে সে নিহত হয়েছে। নিহত ব্যক্তি নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বড়ছনখোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্ত্রী-পুত্রসহ অবস্থান করছিল। তারা সীমান্ত পেরিয়ে নিজ এলাকায় রেখে আসা গরু আনতে গিয়েছিল বলে অন্যান্য রোহিঙ্গারা জানায়।

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম সরোয়ার কামাল বলেন, মাইন বিস্ফোরণে এক রোহিঙ্গা নাগরিক নিহত হয়েছে। যেহেতু ঘটনাটি বাংলাদেশের ভেতরে নয়, তাই লাশটি গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

 

https://www.jugantor.com/first-page/2017/10/04/160471/