৪ অক্টোবর ২০১৭, বুধবার, ৮:৪১

৮ মাসেও জটিলতা কাটেনি ঢাকার সেই ৭ কলেজে

এখনো প্রকাশিত হয়নি অনার্স চতুর্থ বর্ষের ফল, শুরু হয়নি প্রথম বর্ষের ভর্তিপ্রক্রিয়া

রাজধানীর সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়েছে গত ফেব্রুয়ারিতে, তবে জটিলতা কাটেনি এখনো। আট মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত স্নাতক (অনার্স) চতুর্থ বর্ষের ফল প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।
ফলে শিক্ষার্থীরা স্নাতক শেষ করলেও চাকরির আবেদন করতে পারছে না। অনার্সে ভর্তির ক্ষেত্রে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এখন পর্যন্ত ভর্তি আবেদনপ্রক্রিয়া শুরু করা হয়নি। এমনকি এই সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গেলেও এখন পর্যন্ত সিলেবাস বা পাঠক্রমে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে পড়ালেখা করছে সাত কলেজের প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী।
সাত কলেজ হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এসব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনার্স চতুর্থ বর্ষের ফল প্রকাশে আমাদের আরো কিছু সময় লাগবে। তাই কবে প্রকাশিত হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে কলেজগুলোকে বলা হয়েছে, প্রয়োজন হলে তারা যেন শিক্ষার্থীদের অ্যাপিয়ার্ড সনদ দেয়।
এ ছাড়া ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারেও আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। সবাইকে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আশা করছি নভেম্বরেই ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারব। ’
অধ্যাপক আখতারুজ্জামান আরো বলেন, ‘কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়া সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত। এতে আমরা কিছুটা সংকটের মধ্যে পড়েছি। তবে সেখান থেকে উত্তরণের জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আশা করছি কয়েক মাসের মধ্যেই একটা জায়গায় পৌঁছতে পারব। তখন সব কিছুই একটা নিয়মের মধ্যে চলবে। ’
জানা যায়, এই সাত কলেজে ২০১১-২০১২ সেশনের অনার্স চতুর্থ বা শেষ বর্ষের রচনামূলক পরীক্ষা শেষ হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। এতে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশের দায়িত্ব পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ওপর। কিন্তু আট মাস পার হলেও সেই ফল আর প্রকাশ করা হয়নি।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে অন্য কলেজগুলোর যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে তারা গত ১৪ মে রেজাল্ট পেয়েছে। কিন্তু আমরা এখনো পাইনি। সরকারের শেষ সময়ে বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা বিসিএসসহ অন্যান্য নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছি না। আমরা এরই মধ্যে অনশন কর্মসূচি পালন করেছি। দ্রুত ফল প্রকাশ করা না হলে শিগগিরই আরো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। ’
জানা যায়, এরই মধ্যে বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও অনার্সে ভর্তির প্রথম মেধাতালিকা প্রকাশ করেছে। ১৫ অক্টোবর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজে এখন ভর্তিপ্রক্রিয়াই শুরু হয়নি। এসব কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় থাকা শিক্ষার্থীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়েও।
তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়েছিলাম পড়ালেখার মান উন্নত করার জন্য। কিন্তু এখনো এর কোনো প্রতিফলন পাইনি। সিলেবাস ঠিক হয়নি। কোনো রকমে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। আগের চেয়ে বেশি সেশনজটে পড়ে গেছি। সব মিলিয়ে আমাদের পড়ালেখার মান আগের চেয়ে আরো কমেছে। ’
নতুন সিলেবাস নিয়েও আতঙ্কে আছে অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। আদনান নামের তিতুমীর কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসেই আমি দুটি বর্ষ শেষ করেছি। এখন যদি আমাকে নতুন করে সিলেবাস দেয় তাহলে তার সঙ্গে তাল মেলানো কষ্টকর হবে। এ ছাড়া এত দিন হয়ে গেলেও আমরা এখন পর্যন্ত নতুন কোনো নির্দেশনা পাইনি। ফলে সব সময় চিন্তায় থাকি কখন কী পরিবর্তন হয়?’
তবে কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত। কারণ আগামীতে উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতে হবে। এ জন্য এই সাত কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আসা প্রয়োজন। ভর্তি পরীক্ষা, ফলাফল প্রকাশ, কারিকুলাম প্রণয়নসহ নানা বিষয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত সভা করছি। তবে নতুন একটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় লাগছে। ’
জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী নিয়েই প্রচণ্ড বেগ পেতে হয়। এর ওপর যোগ হয়েছে আরো সাত কলেজের দুই লাখ শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া, খাতা দেখা, ফলাফল প্রকাশ, রেজিস্ট্রেশন, ভর্তি, ফরম পূরণ, একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদের বড় ধরনের জনবল দরকার। কিন্তু এই আয়োজন এখনো পুরোপুরিভাবে করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ প্রায় দুই হাজার ১৫০টি কলেজে ২১ লাখ শিক্ষার্থী থাকলেও সরকারি ১৮৪টি কলেজেই অধ্যয়ন করে ১৩ লাখ শিক্ষার্থী। সরকারি কলেজ পৃথক করার এই সিদ্ধান্তে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আপত্তির পরও গত বছরের ২৮ অক্টোবর এক সভায় অধিভুক্ত সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৮৪টি কলেজকে ভাগ করে দিতেও সুপারিশ করে এ বিষয়ে গঠিত কমিটি। কিন্তু ১৭৭টি কলেজ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভাগ করা না হলেও গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাজধানীর সাত কলেজ দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, গত ২০ জুলাই পরীক্ষার রুটিন প্রকাশসহ নানা দাবিতে আন্দোলন করে এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। আর এতে পুলিশের টিয়ার গ্যাস শেলে চোখ হারান তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান। মূলত পাঁচ মাস সব পরীক্ষা বন্ধ থাকার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অধিভুক্ত হওয়ার পর আট মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/10/04/549731