৪ অক্টোবর ২০১৭, বুধবার, ৮:৩৭

রাখাইনে ২০ দেশের কূটনীতিকরা

গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে মাটির সঙ্গে মিশে আছে

বাড়ির পর বাড়ি, গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে মিশে আছে মাটির সঙ্গে। কোনো জনমানব নেই সেখানে। চারদিকে এক ভৌতিক পরিবেশ। ২০টি দেশের কূটনীতিকরা এ দৃশ্য দেখলেন মিয়ানমারের রাখাইনে। এরপর তারা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, রাখাইনে সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। মিয়ানমার সরকারের আমন্ত্রণে সোমবার ওই কূটনীতিকরা রাখাইনের উত্তরাঞ্চল সফরে যান। সেখানে মংডু ও রাথেডাং এলাকা সফর করেন তারা। এরপর তারা যৌথ বিবৃতিতে বলেন, আমরা সেখানে গ্রামের পর গ্রাম দেখেছি পুড়ে মাটির সঙ্গে মিশে আছে। কোনো মানুষজন নেই। কোনো বৈষম্য না রেখে সব মানুষকে রক্ষা করতে বাধ্যবাধকতা রয়েছে মিয়ানমারের নিরাপত্তারক্ষীদের। সব রকম অগ্নিসংযোগ প্রতিরোধেও তারা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য। বিবৃতিতে তারা ২৫শে আগস্ট পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার নিন্দাও জানান। সহিংসতা ও তারপর থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ায় এতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, কূটনীতিকদের ওই সফর কোনো অনুসন্ধানী মিশন ছিল না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ করা হয়েছে তা নির্ধারণ করবেন বিশেষজ্ঞরা। এতে বলা হয়, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচির মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি কঠোর ন্যায় বিচারের আদর্শ অনুসরণ করে দেখার যে প্রতিশ্রুতি তাকে স্বাগত জানাই আমরা। পাশাপাশি ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে অপরাধীদের বিচার করার জন্য আমরা মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। একই সঙ্গে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনকে রাখাইন সফর করার অনুমতি দেয়ার জন্য আহ্বান জানাই আমরা। মিয়ানমার সরকারের আমন্ত্রণে এই মিশনে যাওয়া কূটনীতিকরা হলেন- অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত নিকোলাস কোপেল, কানাডার রাষ্ট্রদূত কারেন ম্যাক আর্থুর, চেক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূত জারোস্লাভ ডোলেসেক, ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত পিটার লাইশোলট হ্যানসেন, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত অলিভার রিচার্ড, ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত ইতো সুমারিদি, ইতালির রাষ্ট্রদূত জর্জিও আলিবারতি, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত উউটারস জুরগেনস, নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত স্টিভ মারচ্যাল, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত টোনি টিনেস, সার্বিয়ার রাষ্ট্রদূত মাইওড্রাগ নিকোলিন, সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত পল সেজার, তুরস্কের রাষ্ট্রদূত করিম দিভানলিওগ্লু, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত স্কট মাসিয়েল, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মর্যাদার ক্রিস্টিয়ান শমিডট, জার্মানির রাষ্ট্রদূত মর্যাদার ডরোথি জ্যানেটজকি-ওনেজেল, স্পেনের চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স বিবিয়ান জামোরা গিমেনেজ, সুইডিশ সেকশন অফিসের প্রধান জোহান হ্যালেনবর্গ, যুক্তরাজ্যের উপ-মিশন প্রধান ডেভিড হল ও ফিনল্যান্ড মিশনের উপ-প্রধান সিলজা রাজেন্দার। তারা মিয়ানমার সরকারের আমন্ত্রণে রাখাইন সফর শেষে সোমবার একটি বিবৃতি দেন। এতে বলা হয়, আমরা মংডু ও রাথেডাংয়ে বেশকিছু গ্রামে গিয়েছি। সেখানে দেখতে পেয়েছি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। আমাদেরকে মিয়ানমার সরকার এমন সফরের আয়োজন করে দেয়। এর মাধ্যমে উত্তর রাখাইনের সব সম্প্রদায়ের প্রতি, যারা দুর্ভোগে ভুগছেন এবং এখনো মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, তাদের প্রতি তারা সমর্থন দেখাতে চেয়েছে। ওই বিবৃতিতে কূটনীতিকরা বলেন, ২৫শে আগস্ট আরসা যে হামলা চালিয়েছে আমরা আবারো তার নিন্দা জানাই। এর পরের সহিংসতা এবং গণহারে বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানাই। আমাদের এই মিশনটি কোনো তদন্ত মিশন ছিল না। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আমরা দেখতে পেয়েছি গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গ্রামগুলো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সেখানে কোনো জনমানব নেই। এই সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদেরকে আচরণবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে, সব রকম পরিস্থিতিতে বিরত থাকতে, ক্ষয়ক্ষতি ও বেসামরিক মানুষের ক্ষতি এড়িয়ে চলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে স্টেট কাউন্সেলর যে বিবৃতি দিয়েছেন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, কয়েক লাখ জাতিগত রোহিঙ্গা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। তাদেরকে দ্রুততার সঙ্গে স্বেচ্ছায়, মর্যাদার সঙ্গে ও নিরাপদে দেশে ফেরার ব্যবস্থা নিতে আমরা মিয়ানমার সরকারকে উদ্বুদ্ধ করি। এতে আরো বলা হয়, আমাদের সফরের সময় দেখতে পেয়েছি করুণ পরিণতি। সেখানে জরুরিভিত্তিতে মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। তাই রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে আমরা বাধাহীন মানবিক সুবিধা পৌঁছে দিতে অনুমতি দেয়ার আবেদন জানাচ্ছি। কোনো রকম বৈষম্য ছাড়াই রাজ্যজুড়ে জীবন রক্ষাকারী সেবা শুরু করার অনুরোধ জানাচ্ছি। এরই মধ্যে মিডিয়াকে সেখানে যাওয়ার যেটুকু অনুমতি দেয়া হয়েছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু আরো একবার আমরা সেখানে আরো সাংবাদিকের পূর্ণ প্রবেশের অনুমতি দেয়ার আহ্বান জানাই। তারা যেনো বাধাহীনভাবে রাখাইনের সব অংশে যেতে পারেন। আমাদের সফরের সময়ে আমরা মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে গুরুত্ব দিয়ে একটি বিষয় তুলে ধরেছি। তা হলো, এই সফরের সময় আমরা যেসব মানুষকে দেখেছি তারা যেন কোনো রকম প্রতিশোধমূলক আচরণ, যেমন শারীরিক হামলা অথবা খেয়াল-খুশি মতো গ্রেপ্তারের শিকার না হন, তাদেরকে যেন সুরক্ষা দেয়া হয় এ আহ্বান জানিয়েছি। ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, মিয়ানমারের বন্ধু হিসেবে আমরা সরকারের সঙ্গে রাখাইনে সহায়তা দিতে প্রস্তুত। (জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান নেতৃত্বাধীন) এডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট ওই রাজ্যে সব সম্প্রদায়ের স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য সুপারিশ দিয়েছেন। জাতি, ধর্ম, নাগিরকত্বের বিষয়ে কাজ করার সুপারিশ করেছে ওই কমিশন। ওই রিপোর্টের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সমর্থন করি আমরা। বিবৃতিতে বলা হয়, আন্তরিকতার সঙ্গে আমরা আশা করি, আমাদের এই সফর হলো রাখাইনে সবার জন্য প্রবেশের সুযোগ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার জরুরি পদক্ষেপের প্রথম ধাপ। এতে মিডিয়া সহ সব মহল রাখাইনের পুরো উত্তরাঞ্চলে প্রবেশের সুবিধা পাবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।

 

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=85847&cat=2/