৪ অক্টোবর ২০১৭, বুধবার, ৮:৩৬

সত্যি সত্যি এতিম হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে এতিম হয়ে গেছে। সত্যি সত্যি এই পৃথিবীর কোথায়ও বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কোনো স্বজন নেই। সরকার কেবলমাত্র চাপার জোর দেখিয়ে এতদিন জনগণকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছিল। আওয়ামী চামচারাও অবিরাম বলছিলেন যে, শেখ হাসিনা মানবতায় বিশ্ব মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু আমরা যা দেখতে পেলাম তাতে কিছুতেই প্রমাণিত হয় না যে শেখ হাসিনা বিশ্ব নেত্রী তো দূরের কথা সর্বত্রই বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে, সরকারের কাছা-খোলা পররাষ্ট্রনীতির কারণে এখন বাংলাদেশ এক অসহায় ভিকটিমে পরিণত হয়েছে। এই সরকারের পররাষ্ট্রনীতি বলতে ভারত-তোষণ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, মায়ানমার, ইরান, তুরস্ক, কাতার কোথায়ও কেউ এই সরকারের বন্ধু নয়। কোথায়ও কোথায়ও বাংলাদেশ নিষিদ্ধ। কোথায়ও শ্রমিক রফতানি বন্ধ। কোনো কোনো দেশে এমন কি বাংলাদেশীদের জন্য ট্রানজিটের অনুমোদনও নেই।
এগুলো নিয়ে সরকারের কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এসব বিষয়ে সরকার একেবারেই নির্বিকার। কোন দেশে শ্রমিক গেল কি না গেল, রেমিট্যান্স এলো কি এলো না, সেটি ভাবার সময় এই অনির্বাচিত গণবিরোধী সরকারের নেই। ফলে একে একে নিভে গেছে দেউটি। আওয়ামী লীগ সরকার মনে করেছিল, ভারতই হবে তাদের সকল সংকটের ত্রাতা। কিন্তু সেরকমটি হয়নি। কংগ্রেস আমলে সোনিয়া গান্ধী বা প্রণব মুখার্জি আওয়ামী লীগকে যেভাবে নির্লজ্জ সমর্থন দিয়েছেন এ রকমটি কোথায়ও দেখা যায় না। এতে সরকার বগল বাজিয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়েছিল। তারা ভেবেছিল যে বিপদই আসুক, ভারত তাদেরর রক্ষা করবে। আর সে কারণেই কংগ্রেস সরকারকে আওয়ামী লীগ যে সমর্থন দিয়েছিল, বিজেপি সরকারের আমলেও তা অব্যাহত রেখেছে। আশা একটাই, বিজেপি সরকারও কংগ্রেসের মতোই শেখ হাসিনা সরকারকে কোলে তুলে নিবে। কিন্তু তারা এটা উপলব্ধি করেনি যে, কংগ্রেস সরকার আর বিজেপি সরকার এক নয়। কংগ্রেসের অস্তিত্ব প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। এখন ভারতীয় লোকসভায় কংগ্রেসের বিরোধীদলের মর্যাদাও নেই। তাদের সর্বশেষ শিখন্ডি ছিলেন ‘প্রণব কাকা’। যদিও তার কোনো ক্ষমতা ছিলো না। কিন্তু ব্যক্তিত্ব ছিল। সে প্রণব কাকাও বিদায় হয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগ ভারতের কাছ থেকেও কার্যত এতিমে পরিণত হয়েছে।
সে কারণেই কী বলতে হবে এবং কী বলতে হবে না, সেই বিষয়ে কারো কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। কী বললে কী হবে, কোনটি বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল, কোনটি অনুকূল নয়- এই ধারণাও কারো নেই। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বে এক দ্বীপ-রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন, যেন ভিক্ষাপাত্র হাতে মাথায় অযাচিত বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে কেউ নেই। এমন কি এই যে ভারতকে সবকিছু দিয়ে দিলো সরকার, সেই ভারতও পাশে নেই। খুব প্রকাশ্যেই ভারত বলে বসলো যে, তারা মিয়ানমারকে তাদের কর্মকান্ডে সমর্থন করবে। এমনকি সর্বশেষ তারা এ-ও বলল যে, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে যে সংকট তার মধ্যস্থতাও করবে না ভারত। অথচ আমরা মনে করে থাকি যে, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক হিমালয়ের উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। এখন তিনি যে কী বলবেন, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট করিডোর দিয়েছে। সড়ক, রেল, নৌপথ ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। বন্দর ব্যবহার করতে দিয়েছে। ভারতীয় পত্রপত্রিকাও বিস্ময় প্রকাশ করেছে যে, না চাইতেই বাংলাদেশ ভারতকে সব কিছু উজাড় করে দিয়েছে। কিন্তু ফলাফল কী দাঁড়ালো? ফলাফল দাঁড়ালো এই যে, যেহেতু বাংলাদেশ থেকে আর পাবার কিছু নেই ভারতের, সেই কারণে তারা মিয়ানমারের পক্ষ অবলম্বন করছে।
কী করেছে মিয়ানমার! মিয়ানমার সর্বশেষ দফায় বাংলাদেশের ভেতরে ঠেলে দিয়েছে প্রায় ছয় লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানকে, যারা প্রায় পাঁচ শ’ বছর ধরে মিয়ানমারের নাগরিক। ১৯৮২ সাল থেকে এদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত সু চি’র প্রতি অনেকেরই শ্রদ্ধাবোধ ছিল। সু চি এখন কার্যত মিয়ানমারের সরকার প্রধান। কিন্তু তিনি যে কত বড় রক্তপিপাসু, কত বড় গণহত্যাকারী, রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের আগে সে কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। মিয়ানমারের ৭০ বছরের স্বাধীনতার ইতিহাসে ৫৫ বছরই সামরিক শাসন জারি ছিল। এখনও সমর নায়করাই মিয়ানমার চালায়। সু চি বোধকরি শিখন্ডিমাত্র। অথচ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের আন্দোলনের জন্য তাকে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছিল। আরও সম্মাননা তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু একে একে সবাই সে সব সম্মাননা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় টানানো ছিল সু চি’র ছবি। রক্তপিপাসুÑ এ অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সু চি’র ছবিটি সরিয়ে ফেলেছে। আরও অনেক সংগঠন, যারা তাকে সম্মাননা দিয়েছিল তারাও তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। রাখাইনে গণহত্যার অভিযোগে নিশ্চয়ই একদিন সু চি’কে আন্তর্জাতিক আদালতে দাঁড়াতে হবে। মাইলোসোভিচের মতো, গণহত্যার দায়ে তারও বিচার হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের কী হবে? কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ এখন ভিক্ষাপাত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গার বোঝা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের খাওয়াবেন। দেশে ২৮ টাকার চাল ৬০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। হাওরের বন্যা স্বাভাবিক বন্যা। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। গুদামে চাল নেই। বিশ্বব্যাঙ্ক বলেছে, সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে চালের দাম বেড়েছে। গুদামে যখন চাল নেই, তখন সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে খাদ্যমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী অবিরাম বিএনপিকে গালিগালাজ করেছে। সেসব গালিগালাজ অর্থহীন। খাদ্যের যখন সংকট, সে সংকট মোকাবিলা না করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া কেন লন্ডনে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাই নিয়ে তারা কথা বলেছেন, তিনি সেখানে ষড়যন্ত্র করছেন। এর ফলে খাদ্য পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং তা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
এক্ষেত্রে কূটনীতির কথা যদি বলি, তাহলে বাংলাদেশ এক কূটনীতিহীন রাষ্ট্র। মিয়ানমার সুযোগ পেলেই রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার করে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। এবারও তাই দিয়েছে। দিয়ে এক বিশাল মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। আরাকানের রোহিঙ্গা অঞ্চলে তারা গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। নারী, শিশু, কিশোরীদের ধর্ষণ করেছে। তারপর তাদের গলা কেটে হত্যা করেছে। সে সব বীভৎস ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেটি শুরু হয়েছিল ২৫ আগস্ট থেকে। কিন্তু ২১ আগস্ট থেকেই প্রস্তুতি চলছিল। মিয়ানমার বাহিনী ২১ আগস্ট রাখাইনের প্রধান শহর মংদুতে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ ঘটায় এবং রোহিঙ্গা মুসলিম এলাকায় অকারণে ত্রাসমূলক অভিযান চালায়। তখনও তারা হত্যাযজ্ঞ শুরু করেনি। কিন্তু সে সময়ই বাংলাদেশের বোঝা উচিত ছিল যে মিয়ানমার বাহিনী নতুন করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর হামলা পরিচালনা করবে। তাহলে সেদিন থেকেই বাংলাদেশ সরকার কেন সারা বিশ্বে এই বলে শোরগোল তুলতে পারলো না যে, মিয়ানমার বাহিনী পুনরায় বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। সেটা যদি তারা করতে পারতো, তাহলে হয়তো আজকের পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। দরকার ছিল সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবীতে, জাতিসংঘে, ওআইসিতে, মুসলিম বিশ্বে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বাংলাদেশের শোরগোল তোলা- আমরা আর শরণার্থীর ভার বহন করতে পারবো না। এখন যারা আমাদের ‘বন্ধু’ তারা সবাই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের থাকার ব্যবস্থা করার কথাই কেবল বলছে। ফিরিয়ে নেবার কথা কেউ বলছে না। আগে যে ৪ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল, মিয়ানমারের ভন্ড, মিথ্যাবাদী প্রতারক সরকার চুক্তি সত্ত্বেও তাদের ফিরিয়ে নেয়নি। এবারও মিষ্টি কথা যতই বলুক এদের ফিরিয়ে নেবে না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বৈঠক ব্যর্থ। আমরা আশা করে আছি। চীন, রাশিয়া, ভারত বলেছে, তারা ত্রাণ দেবে। কিন্তু মিয়ানমারকে চাপ দিতে পারবো না। অথচ সরকার গৌরব করে বলেছে যে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব পর্বতপ্রমাণ, ভারতের সাথে বন্ধুত্ব হিমালয় সমান। রাশিয়ার সঙ্গেও আছে নানান চুক্তি। তাহলে কেউ কেন দাঁড়াচ্ছে না বাংলাদেশের পাশে। সেটি সরকারের কাছা-খোলা নীতির কারণে। এখন কূটনীতি নেই। আছে কেবল ভিক্ষাপাত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা- কে কতটা ত্রাণ দিচ্ছে।

http://www.dailysangram.com/post/302081-