৪ অক্টোবর ২০১৭, বুধবার, ৮:৩৫

সহজ কথা

মিয়ানমারের ফাঁদে বাংলাদেশ

আলফাজ আনাম

স্বাধীন রাষ্ট্রের কোনো স্থায়ী বন্ধু থাকে না তা সম্ভবত বাংলাদেশের মানুষ এবার খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। সরকার বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের গল্প বানিয়ে পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের যে বেলুন ফুলিয়েছিল, তা ফুটো হয়ে গেছে। মিয়ানমারে জাতিগত নির্মূল অভিযানে লাখ লাখ রোহিঙ্গা যখন বাংলাদেশে ঢুকতে থাকে তখন দেখা গেল বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ভারত, রাশিয়া ও চীন কেউ বাংলাদেশের পাশে নেই। যেসব দেশের সাথে শীতল সম্পর্ক সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ ও তুরস্ক নিপীড়ত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কথা বলছে। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মূল অভিযানের অভিযোগে সেনাকর্মকর্তাদের বিচার ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব করেন। তবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় সমর্থন পেয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছ থেকে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির দফতরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য ঢাকা আসেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর ভাষায় ‘আমরা উভয়ে সম্মত হয়েছি। এই জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের কম্পোজিশন কী হবেÑ সেটা আমরা বাংলাদেশও ঠিক করব, ওরাও ঠিক করবে। সম্মতিটা হয়েছে এই আলোচনায়।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য বৈঠকে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলকে ওই চুক্তির খসড়াও হস্তান্তর করা হয়েছে। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে ‘নিরাপত্তা সহযোগিতার’ বিষয়েও ‘অত্যন্ত ফলপ্রসূ’ আলোচনা হয়েছে এবং বাংলাদেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ পুনর্ব্যক্ত করেছে বলে মাহমুদ আলী জানান।
এই বৈঠকের সাফল্য নিয়ে যেমন সন্দেহ আছে, তেমনি শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকা কী হবে তা স্পষ্ট নয়। মিয়ানমার জাতিসঙ্ঘকে সম্পৃক্ত করতে রাজি হয়নি। অতীত অভিজ্ঞতা বলে দ্বিপক্ষীয়ভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। কারণ মিয়ানমার আগেই জানিয়েছে যাদের নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র আছে তারা শুধু ফেরত আসবে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের আগেই নাগরিকত্ব হরণ করা হয়েছে। তারা গণহত্যার মুখে এ দেশে চলে এসেছে, ফলে তাদের কাছে তেমন কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। এ ছাড়া বৈঠকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ইস্যুটি যে বড় করে দেখানো হয়েছে তা সহজে অনুমান করা যায়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যে পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তার এক নম্বরে ছিলÑ রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধ করা। এই অভিযান বন্ধ হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বরং বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য মিয়ানমার সফরে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে নিরাপত্তা ইস্যু সামনে এনে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার দিকটি আগের মতো হিমাগারে পাঠাতে পারে। গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযানের দিকটি আড়াল করার একটি সুযোগ পাবে। আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারের ফাঁদে হয়তো পা দিলো বাংলাদেশ। আগামী দিনে বাংলাদেশের কথিত বন্ধুরাষ্ট্রগুলো সন্ত্রাসের প্রশ্নকে সামনে এনে মিয়ানমারের অবস্থানকে সমর্থন দিতে পারে।
এর আগে লাখ লাখ মানুষকে দেশছাড়া করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার পক্ষে প্রবল সমর্থন জানিয়ে দিয়েছে চীন, ভারত ও রাশিয়া। রোহিঙ্গারা যখন নাফ নদী পাড়ি দিয়ে স্রোতের মতো বাংলাদেশে ঢুকছে তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফরে যান। সেখানে তিনি মিয়ানমারের সেনা অভিযানের পক্ষে ভারতের অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয় নিয়ে ভারত টুঁ শব্দও করেনি। মিয়ানমারের পক্ষে চীনের অবস্থান অস্বাভাবিক ছিল না। এ দেশের মানুষ মিয়ানমারের পক্ষে চীনের অবস্থানে খুব অবাক হয়নি যতটা বিস্মিত হয়েছে ভারত ও রাশিয়ার অবস্থানে।
রাশিয়া শুরু থেকে মিয়ানমারের পক্ষে শুধু জোরালো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে না, রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে চীনের চেয়েও কঠোর অবস্থান নিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে চীনের প্রতিনিধি উ হাইতাও যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে তিনি বলছেন, ‘এই বিরোধ বহু দিন ধরে দানা বেঁধে উঠেছে এবং রাখাইন পরিস্থিতি শান্ত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মিয়ানমার সরকারকে যে অসুবিধা ও চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে দেখতে হবে। মুসলিম জনগোষ্ঠীর গণপ্রস্থানের কারণ চিহ্নিত করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনায় সহযোগিতা করতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। রাখাইনের পরিস্থিতি ক্রমেই স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে।’ রাশিয়ার প্রতিনিধি ভাসিলি এ নেবেনজিয়া চীনের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘সমাধানের অতীত অবস্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে পরিস্থিতি। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বেসামরিক লোকজনকে হত্যার অপরাধে অপরাধী এবং কট্টরপন্থীরা মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকেও বাড়িঘর ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। কোনো কিছুকে গণহত্যা বা জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করার আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই সাবধান হতে হবে। আমরা সব পক্ষের প্রতি সহিংসতা ও সহিংসতা উসকে দেয়া বন্ধের আহ্বান জানাই।’ দেখা যাচ্ছে রাশিয়া সরাসরি এ ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের নামে কথিত সশস্ত্র সংগঠন আরসাকে। একই সাথে রোহিঙ্গা উগ্রপন্থীরা হিন্দুদের হত্যা করছে অভিযোগ করে পুরো পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করছে।
অপর দিকে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র রাজিব কুমারের উদ্ধৃতি দিয়ে রাশিয়ার স্পুটনিক নিউজের খবরে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করবে না ভারত। নয়াদিল্লি শুধু বাংলাদেশকে মানবিক ত্রাণসাহায্য দেবে। তবে রাখাইনে হিন্দুদের গণকবর পাওয়ার খবরে হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে মিয়ানমারের প্রতি দাবি জানিয়েছে ভারত।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি আর রাশিয়ার প্রতিনিধির নিরাপত্তা পরিষদে দেয়া বিবৃতির মধ্যে আমরা মিল খুঁজে পাচ্ছি। হিন্দুদের হত্যা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যা ও শত শত নারীকে ধর্ষণ নিয়ে দুই দেশের কোনো বক্তব্য নেই। আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার জন্য ভারত সব সময় উদগ্রীব কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে মধ্যস্থতা করার সুযোগ নিতে রাজি নয়। প্রকৃতপক্ষে ভারত রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহত্যার নীতিকে সমর্থন করছে।
রাশিয়া, চীন ও ভারত কেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এর কারণ হিসেবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এই তিন দেশের বড় ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে মিয়ানমারে। রাখাইন প্রদেশে ভারতের ৪৮৪ মিলিয়ন ডলারের কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপ্রজেক্টের কাজ চলছে। আর চীনের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক অনেক পুরনো এবং দেশটিতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। চীনের একটি তেলের পাইপলাইন চলে যাবে রাখাইন প্রদেশ হয়ে। এ ছাড়া রাশিয়া এখন মিয়ানমারে শীর্ষ অস্ত্র বিক্রেতা দেশের অন্যতম। রাখাইন প্রদেশটি জ্বালানি ও খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ। এই প্রদেশে নিরাপত্তা সমস্যা দূর করতে মুসলমানদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে এমন কথা বলা হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে কি ভারত, রাশিয়া ও চীনের কোনো স্বার্থ নেই? মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে বিপুল অস্ত্র কিনে থাকে। কিন্তু এই দুই দেশ থেকে বাংলাদেশের অস্ত্র কেনার পরিমাণ কম নয়। চীনের শীর্ষ সমরাস্ত্র ক্রেতার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই প্রথম দিকে। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরের সময় ১০০ কোটি ডলার বা ৮ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনার চুক্তি হয়েছিল। এ সপ্তাহেই ভারতের ইংরেজি দৈনিক দি ইকোনমিক টাইমসের (৩০ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে পারমাণবিক স্থাপনায় ভারত বড় ভূমিকা রাখছে। যদিও রাশিয়ার সহায়তায় বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে। কিন্তু ইতিহাসে এই প্রথম ভারত কোনো বিদেশী মাটিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলছে। বাংলাদেশে রূপপুর আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ভারতীয় ফার্মগুলো রাশিয়া এবং বাংলাদেশী অংশীদারদের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওয়াকিবহাল সূত্র বলেছে, ঢাকার কাছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য ভারত ‘ম্যানুফ্যাকচার ইকুইপমেন্টস’ সরবরাহ করবে।’
রূপপুরে মোট ২৪০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুই ইউনিটের জন্য সই করা চুক্তিতে ব্যয় নির্ধারিত হয়েছে ১২৬৫ কোটি মার্কিন ডলার। এর বাইরে আমরা ইতোমধ্যে ৫৫০ মিলিয়ন (৫৫ কোটি) ডলার ব্যয় করে ফেলেছি। এটা যুক্ত করলে হবে ১৩২০ কোটি ডলার। বিপুল ব্যয়ে নির্মিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কতটা সাশ্রয়ী হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু ভারত ও রাশিয়ার যে বিপুল বাণিজ্য হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ছাড়া ভারতের পারমাণবিক বাণিজ্যের পরীক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যেখানে বড় ধরনের ঝুঁকি তো রয়েছেই। তাহলে দেখা যাচ্ছে চীন, রাশিয়া ও ভারতের কোনো স্বার্থ বাংলাদেশে নেই তা নয়। এ ছাড়া ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থসহ সব ধরনের চাওয়া-পাওয়া বাংলাদেশ অনেক আগেই পূরণ করেছে।
কূটনীতি হচ্ছে ক্ষুদ্ররাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার প্রথম লাইন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মহল জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট এই ইস্যুতে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের চেয়ে মিয়ানমার যে কূটনৈতিকভাবে অনেক বেশি তৎপর ও স্মার্ট, ভারত ও রাশিয়ার ভূমিকা তা প্রমাণ করে। ২৫ আগস্টের ঘটনার পর সরকার যেন হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল। রোহিঙ্গা ইসু্যুতে সম্ভবত বাংলাদেশ প্রথম দিকে ভারতের দিকে তাকিয়েছিল দেশটির মনোভাব বোঝার জন্য। কিন্তু ভারত যখন সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে তখন আমাদের কিছুটা হুঁশ ফিরে আসে। ভারতের কাছে মিয়ানমার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল তার উত্তর খুঁজে বের করতে হবে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের। বাংলাদেশ ১০ বছর ধরে ভারতের ইচ্ছা পূরণের কূটনীতি গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের অবস্থানের প্রতিধ্বনি করেছে বাংলাদেশ। সার্কের উদ্যোক্তা হওয়া সত্ত্বেও ভারতের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের জন্য সার্ক সম্মেলন পর্যন্ত বর্জন করেছিল। ভারতের সাথে দেনদরবার করার মতো কার্ড এখন বাংলাদেশের হাতে নেই। এখন ভারতের লিপ সার্ভিসের জন্য সরকারকে অপেক্ষা করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিক বা বৃহৎ শক্তি ক্ষুদ্ররাষ্ট্রের পাশে থাকার মৌখিক গ্যারান্টির কানাকড়ি মূল্য নেই তা আবারো প্রমাণ হলো।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হয়ে পড়ে একান্তভাবেই ভারতমুখী। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে একধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হয় সরকারের। অপর দিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ তুরস্কের সাথেও শীতল সম্পর্ক দেখা দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি নিকি হ্যালি রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নির্মূল অভিযানের শুধু অভিযোগই আনেননি, এ অপরাধে মিয়ানমারের সেনাকর্মকর্তাদের বিচার ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। ফ্রান্সও একই সূরে কথা বলেছে। অপর দিকে রোহিঙ্গাদের নির্মূল অভিযানের পর প্রথম সোচ্চার হয়ে ওঠে তুরস্ক। বলা যায় ইস্যুটির আন্তর্জাতিকীকরণে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্পষ্টত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরো শক্ত হচ্ছে। মিয়ানমারের মন্ত্রীর ঢাকা সফরে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে যে আলোচনার প্রস্তাব করা হয়েছে তা যে আন্তর্জাতিক চাপ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তা সহজেই অনুমান করা যায়।
সরকারের মন্ত্রীরা গত কয়েক দিন থেকে ভারতের দেয়া ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে দেখাতে চাইছে বাংলাদেশের পাশে আছে ভারত। প্রকৃতপক্ষে ভারতের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ত্রাণসাহায্য দেয়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নয়। বহু দেশ এ ধরনের ত্রাণসহায়তা দিচ্ছে। একজন সাংবাদিক ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, একদিন হয়তো মিয়ানমারও ত্রাণ নিয়ে হাজির হবে। বাস্তবতা হচ্ছে একসময় ত্রাণ কমে আসবে। জাতিসঙ্ঘ ইতোমধ্যে বিপজ্জনক তথ্য প্রকাশ করেছে, তিন লাখ শরণার্থীর হিসাব ধরে জরুরি সহায়তার জন্য প্রাথমিকভাবে যে অর্থ জাতিসঙ্ঘ চেয়েছিল, তার অর্ধেকও এখনো জোগাড় হয়নি, অথচ এরই মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে পাঁচ লাখ পার হতে চলেছে। জাতিসঙ্ঘের ঢাকা অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিকভাবে যে ধারণার ভিত্তিতে তারা রোহিঙ্গাদের সহায়তার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক জটিল আকার ধারণ করেছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছিল, ওই সময় পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গার জন্য সমন্বিত ত্রাণতৎপরতায় প্রাথমিক হিসাবেই অন্তত ৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার প্রয়োজন। এর মধ্যে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ৬৪ হাজার ডলার জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে, যা প্রাথমিক পরিকল্পনার ৪৭ শতাংশ। এই যখন অবস্থা তখন আমাদের মন্ত্রীরা ভারতের কয়েক টন ত্রাণ বিতরণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অথচ রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে। তখন কয়েক টন ভারতের ত্রাণ কোনো কাজে আসবে না। মনে রাখতে হবে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে ভারতকে তখনকার ক্ষমতাসীন মহল খুঁজে পায়নি। ডেনিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাংবাদিক আরলিং বিজল ছোট দেশগুলো বড় রাষ্ট্রগুলোর গ্রাস থেকে টিকে থাকার উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের কৌশল হবে পাইলট ফিশের মতো, শার্কের গ্রাসে পতিত না হয়েই কিভাবে শার্কের কাছাকাছি অবস্থান করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ নিজেই যেন হাঙ্গরের পেটে ঢুকে পড়েছে।
alfazanambd@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/256870