৩ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:০৪

খেলাপিতে ন্যুব্জ পোশাক বস্ত্র বাণিজ্যিক খাত

ব্যাখ্যা চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি * সোনালী ব্যাংকে খেলাপির ৫৫ শতাংশই এ তিন খাতের * অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের বাড়াবাড়িও দায়ী * অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হচ্ছে কি-না তা খতিয়ে দেখা উচিত -সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ
খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ দেশের ব্যাংকিং খাত। এসব খেলাপির বেশির ভাগই হচ্ছে তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও বাণিজ্যিক খাতের। কোনো কোনো ব্যাংকে মোট খেলাপির ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ এ তিন খাতের। এতে ঋণঝুঁকিতে পড়েছে সংশ্লিষ্ট খাতে বিনিয়োগ করা ব্যাংকগুলো।

এদিকে এ তিন খাতে কেন খেলাপির ছড়াছড়ি তার ব্যাখ্যা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত সপ্তাহে এক ডজন ব্যাংকের কাছে এ বিষয়ে পৃথক চিঠি পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক বাণিজ্যিক ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে কোনো ঋণ দেয়া হচ্ছে কি-না তা দ্রুত খতিয়ে দেখা উচিত। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি আরও জোরদার করার পরামর্শ দেন তিনি।
কয়েকজন ব্যাংক বিশ্লেষক জানান, যাচাই-বাছাই না করে দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ দেয়ায় এমনটি ঘটেছে। শক্ত তদন্ত হলে দেখা যাবে বেশির ভাগ ঋণে কোনো না কোনো ত্রুটি আছে। আবার ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের হদিসও মিলতে না পারে। এ ছাড়া অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের এখতিয়ারবহির্ভূত বিধিনিষেধ আরোপের কারণেও অনেক গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। সেসব প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই ব্যাংক ঋণ আছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত তৈরি পোশাক ও বস্ত্র মিলগুলোর মালিকরা এখন ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছেন। এজন্য অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের খবরদারি বন্ধে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। কেননা, ওদের বাড়াবাড়ির কারণে বড় বড় অনেক গার্মেন্টও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রকৌশল কোনো সমস্যা বা ঝুঁকি না থাকলেও অ্যাকর্ড অনেক প্রতিষ্ঠানের ভবনে ব্যাপক সংস্কার করার জন্য চাপ দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কার খরচের বাজেট দিয়ে নতুন করে ভবন নির্মাণ করা যায়।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও বাণিজ্যিক খাতে খেলাপি হয়েছে ছয় হাজার ২৪০ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ৫৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে মুঠোফোনে সোনালী ব্যাংকের এমডি ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

খাতভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, সোনালী ব্যাংকে তৈরি পোশাক খাতে খেলাপি দুই হাজার ৯২১ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ২৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ঋণে খেলাপি দুই হাজার ১৫২ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ১৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং বস্ত্র খাতে খেলাপি এক হাজার ১৬৭ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। একইভাবে চলতি বছরের জুন শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে খেলাপি হয়েছে ৫৭৯ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ।
জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান যুগান্তরকে বলেন, এসব ঋণ পুরনো। আগের দেয়া ঋণগুলো বর্তমানে খেলাপি। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ থেকে আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। তা ছাড়া খাত তিনটির অবস্থা একসময় অনেক ভালো ছিল। কিন্তু বর্তমানে আগের অবস্থান নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের কড়াকড়ির কারণে কিছু গার্মেন্ট বন্ধ হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে এসব কিছুর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি তদারকির অভাব থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে তদারকি আরও বাড়ানো।

জানা যায়, জুন শেষে বেসিক ব্যাংকে খেলাপি হয়েছে সাত হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও বাণিজ্যিক খাতে খেলাপি হয়েছে দুই হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ৩৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। ব্যাংকটিতে বেশি খেলাপি হচ্ছে পোশাক খাতে। তিন খাতের মধ্যে পোশাক খাতে এককভাবে খেলাপি হয়েছে এক হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির প্রায় ২৪ শতাংশ।

প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, বেসরকারি খাতের পূবালী ব্যাংকে জুন পর্যন্ত খেলাপি হয়েছে এক হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে তৈরি পোশাক ও বাণিজ্যিক খাতে খেলাপি হয়েছে এক হাজার ৩৩ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ৫৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
এ ছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের দুই হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা খেলাপির মধ্যে বাণিজ্যিক ঋণে খেলাপি ৬১৪ কোটি টাকা, সিটি ব্যাংকের এক হাজার ৫৩ কোটি টাকা খেলাপির মধ্যে বাণিজ্যিক ঋণে খেলাপি ৪৩৩ কোটি টাকা, ইউসিবিএলের এক হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা খেলাপির মধ্যে বাণিজ্যিক ঋণে খেলাপি ৯৬৬ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংকের এক হাজার ৪৮২ কোটি টাকা খেলাপির মধ্যে বাণিজ্যিক ঋণে খেলাপি ৬৯৭ কোটি টাকা, এসআইবিএলের ৮৯২ কোটি টাকা খেলাপির মধ্যে বাণিজ্যিক ঋণে খেলাপি ৪০৮ কোটি টাকা এবং এবি ব্যাংকের এক হাজার ২১৩ কোটি টাকা খেলাপির মধ্যে বাণিজ্যিক ঋণে খেলাপি ৪১৪ কোটি টাকা।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/10/03/160164