৩ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:০১

আবার সঙ্কটে বিনামূল্যের পাঠ্যবই

৪৫ দিনেও দেয়া হয়নি কার্যাদেশ তিন দিন ধরে ছাপা বন্ধ

আগামী শিক্ষাবর্ষের (২০১৮) বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক সময়মতো প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছেই না। দুই সপ্তাহ আগে মুদ্রণ ধর্মঘটের পর টনক নড়লেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নতুন করে অচলাবস্থার সৃষ্টি করছে বলে আবার অভিযোগ এনেছেন মুদ্রণ শিল্প মালিকেরা। তারা বলছেন, মাধ্যমিকের পরিমার্জিত ও কথিত সুখপাঠ্য পৌনে তিন কোটি মূল পাঠ্যবইয়ের টেন্ডার আহ্বান করে ৪৫ দিন অতিবাহিত হলেও গতকাল পর্যন্ত কাউকেই কার্যাদেশ দেয়া হয়নি। তিন দিন ধরে প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপা বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন ছাপাখানায়। আর প্রাথমিকের যেসব বই ছাপা হয়েছে, সেগুলোর কাভার পেজের কাগজ সরবরাহ করছে না এনসিটিবি। এসব নিয়ে নতুন করে জটিলতা শুরু হয়েছে।

সুখপাঠ্যের কার্যাদেশের আরো যেসব প্রক্রিয়া ও ধাপ পার হতে হবে (এনসিটিবির অভ্যন্তরীণ অনুমোদন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন এবং সর্বশেষে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন শেষে কার্যাদেশ) সেগুলো অতিক্রম করে কার্যাদেশ দেয়া হলে সময়মতো অর্থাৎ ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বই সরবরাহ করা নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে। তবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বিলম্ব স্বীকার করলেও সময়মতো বই পাওয়া নিয়ে সমস্যা হবে না বলে মনে করছেন। তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহ দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষ করে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কাছে পাঠানো হবে। আশা করি আগামী সপ্তাহে মুদ্রণকারীদের ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া যাবে। তারা ৫৫ দিন সময় পাবে। সেটাও ডিসেম্বরের মধ্যে কাভার হয়ে যাবে। অন্য দিকে মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, কার্যাদেশ দেয়ার পর ২৮ দিনের মধ্যে চুক্তি করতে হলেও দুই মাসের মধ্যে বই সরবরাহ করতে গেলে জানুয়ারি গিয়ে পড়বে। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ অভিযোগ করেন, দেশীয় মুদ্রণকারীদের ব্যর্থ করে দিতে এনসিটিবির কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা চাইছেন, তারা চান না সময়মতো বই সরবরাহ করতে সক্ষম হোক দেশীয় মুদ্রণকারীরা। তা হলেই আগামীতে আবার পাঠ্যবইয়ের কাজ বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া যাবে। এতে তাদের সুবিধা ভোগ করতে সহজ হবে।

এনসিটিবি এবং মুদ্রণ শিল্প সমিতি ও মুদ্রাকরদের নানা সূত্রে জানা গেছে, আগামী শিক্ষাবর্ষের (২০১৮) বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে শুধু মাধ্যমিকের পরিমার্জিত ও কথিত সুখপাঠ্য বই নিয়েই সমস্যা সমাধান হচ্ছে না, প্রাথমিকের বই ছাপা কাগজের অনুমোদন নিয়ে চলছে নানা ধরনের টালবাহানা, তিন দিন ধরে প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপা বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন ছাপাখানায়, আর প্রাথমিকের যেসব বই ছাপা হয়েছে, সেগুলোর কাভার পেজের কাগজ সরবরাহ করছে না এনসিটিবি। এসব কাগজ আমদানি করে মুদ্রাকরদের সরবরাহ করার কথা টেন্ডারের শর্তানুসারে। কাভার পেজের কাগজ সরবরাহ না করার কারণে তিন সপ্তাহ ধরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের যেসব বই ছাপা হয়েছে, সেগুলোতে কাভার পেজ লাগানো যাচ্ছে না।
মাধ্যমিকের পরিমার্জিত ও কথিত সুখপাঠ্য বই ছাপা সম্পর্কে মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, গত ১৭ আগস্ট টেন্ডার ডাকা হলেও আজ ২ সেপ্টেম্বর (গতকাল) মোট প্রায় ৪৫ দিনের মতো অতিক্রান্ত হয়েছে, এনসিটিবি কার্যাদেশ দিচ্ছে না। দেশীয় কালো তালিকাভুক্ত ৩৫টি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তবে শোনা যাচ্ছে, এদের কাউকে কাউকে কার্যাদেশ দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা নিয়ে এনসিটিবির প্রশ্ন রয়েছে। তারা অন্য প্রতিষ্ঠানে ছাপার কাজ করতে গিয়ে সময়মতো সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে দায় কে নেবে?

মুদ্রাকররা বলছেন, দেশীয় মুদ্রাকরদের ব্যর্থ করতেই এনসিটিবি এখন এসব টালবাহানা করে চলেছে। মুদ্রণ শিল্প সমিতি ও মুদ্রাকরদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের কালো তালিকাভুক্ত কাগজ পরিদর্শক প্রতিষ্ঠান ‘কন্টিনেন্টাল বিডি লি.’-কে এবারো ছাপাখানাগুলোয় ছাপার কাগজ পরিদর্শনের দায়িত্ব দিয়েছে এনসিটিবি। পরিদর্শক প্রতিষ্ঠানের লোকজন সময়মতো ছাপাখানাগুলোয় যান না। ফলে ছাপা কাজে বিঘœ ঘটছে। আর ছাপাখানায় নির্ধারিত ৮০ গ্রামের কাগজ ৮৫ গ্রাম বা ৭৫ গ্রাম হলেও ছাপার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। ফলে ছাপা নিয়ে একধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ছাপার কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা বলেন, আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে ছাপার কাগজের ক্ষেত্রে ৪-৫ গ্রাম কম-বেশি স্বীকৃত। কিন্তু পরিদর্শক টিমের লোকজন অনুমোদন না দেয়ার এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে নিতে অস্বীকার করায় সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
তিশা প্রিন্টারের স্বত্বাধিকারী হায়দার আলী খান গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, এনসিটিবি কাগজ সরবরাহ করছে দেশীয় একটি বড় শিল্প গ্রুপের কাছ থেকে কাগজ নিয়ে। এবারের ছাপার কাগজের মান অত্যন্ত ভাল। কিন্তু এর পরও পরিদর্শক টিমের লোকজন সমস্যা সৃষ্টি করছেন। অন্য দিকে প্রাথমিকের কভার পেজের কাগজ সরবরাহ করছে না এনসিটিবি।
এ ব্যাপারে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, এনসিটিবির আশ্বাসে ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেও জটিলতা এখনো কাটছে না। এনসিটিবি দিন দিনই সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলছে বলে অভিযোগ তার। তিনি বলেন, সুখপাঠ্য বই নিয়ে এনসিটিবি যা ইচ্ছা তা করছে। প্রাইমারি কাগজে ছাড়পত্রে নতুন ইন্সফেনশন কোম্পানি নতুন জটিলতা তৈরি করেছে। এসবের ফলে যে জটিলতা তার দায় এনসিটিবিকেই নিতে হবে।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি সুখপাঠ্য বই নিয়ে টেন্ডার ও কার্যাদেশ বিলম্বকে স্বীকার করে বলেন, দরপত্রের একটু দেরি হয়েছে সত্য; তবে আগামী সপ্তাহ দরপত্রের অবশিষ্ট প্রক্রিয়া শেষ হবে। আশা করছি আগামী সপ্তাহে কার্যাদেশ দেয়া সম্ভব হবে। মুদ্রাকররা ৫৫ দিন সময় পাবে। সেটাও ডিসেম্বরের মধ্যে কাভার হয়ে যাবে। আর প্রাইমারি কাগজের ছাড়পত্রের ব্যাপারে তিনি বলেন, যেসব অভিযোগ মুদ্রাকররা করছে তার সব সঠিক নয়। নি¤œমানের কাগজসহ আরো অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয় জড়িত রয়েছে এখানে। ইচ্ছা করলেই টনের পর টন কাগজের ছাড়পত্র দেয়া যাবে না। তার পরও পরিদর্শক টিমকে আরো দ্রুত ছাড়পত্র দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আগামী শিক্ষাবর্ষে (২০১৮) প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ব্রেইল বই বিনামূল্যে বিতরণের ছাপা হবে ৩৪ কোটি ৯৩ লাখ ৭৮ হাজার ৮৫৭টি। ৫টি টেন্ডারে ভাগ করে এসব বই মুদ্রণ কাজ চলছে। মাধ্যমিকের পরিমার্জিত বই ছাপা হবে পৌনে ৩ কোটির মতো। সদ্য পরিমার্জন সম্পন্ন পৌনে তিন কোটি বই ছাড়া অপর প্রায় সব বইয়েরই টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/256679