৩ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৫৬

অপসাংবাদিকতা ও রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের দুর্দশা

সাংবাদিকতা পেশায় যোগদানের শুরুর দিকে ঘটে যাওয়া আমার প্রত্যক্ষ করা দুটি ঘটনার কথা সম্ভবতঃ এর আগেও আমি উল্লেখ করেছিলাম। একটি ঘটনা হচ্ছে ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসের। সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগদান করেছি। আন্তর্জাতিক প্রেস ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিনিধিদল ফিলিপাইনের ম্যানিলা থেকে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সফর করে ম্যানিলা ফিরে গিয়েছিলেন। তারা এসেছিলেন এ দেশের সাংবাদিকতার মান ও সাংবাদিকদের চারিত্রিক সংহতির অবস্থা দেখতে। তৎকালীন পাকিস্তানের উভয় প্রদেশের রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর পত্রপত্রিকা ও সাংবাদিকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে তারা ম্যানিলা ফিরে যাওয়ার পর সেখানকার একজন সাংবাদিক প্রতিনিধিদলকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, How did you find press in Pakistan? তোমরা পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকা ও পেশাজীবী সাংবাদিকদের কেমন দেখলে? উত্তরে তারা বলেছিলেন, We did not find any press there. What we found was prostitution.

আমরা পাকিস্তানে কোনও পত্র-পত্রিকা বা পেশাজীবী সাংবাদিক দেখিনি; যা দেখেছি তা হচ্ছে বেশ্যাদের ন্যায় মনোরঞ্জনকারী একটি গোষ্ঠী। সাংবাদিকতা পেশায় নবাগত একজন তরুণ হিসাবে প্রতিনিধি দলের এই জবাবটি আমাকে অত্যন্ত পীড়া দিয়েছিল। একে আমি প্রান্তিক মন্তব্য হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। কেননা, এই পেশায় আমি সৎ, নিষ্ঠাবান ও ব্যক্তিত্বশালী অনেক লোককে জানতাম যাদের নিরপেক্ষ লেখনী ও চরিত্র আমাকে এই পেশায় যোগদানে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৬৯ সালে, এক বছর পর, তখন আমি একই গ্রুপের আরেকটি বাংলা দৈনিকের অর্থনৈতিক সংবাদদাতা। তিতাস গ্যাস কোম্পানীর তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুর রহমানের একটা সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য মতিঝিলে তার অফিসে গিয়েছিলাম। ঘণ্টাব্যাপি সাক্ষাৎকার শেষে তিনি আপ্যায়ন করলেন এবং চায়ের টেবিলে বসে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত কথা বার্তা হলো। তিনি সাংবাদিকদের সম্পর্কে তার এবং সমাজের অন্যান্য লোকদের ধারণার কথা বললেন। তাদের ধারণা অনুযায়ী বীমা কোম্পানির এজেন্ট এবং সাংবাদিক এরা বেশি মিথ্যাবাদী এবং প্রতারক। তিনি অনুমতি নিয়েই বললেন যে, সাংবাদিকরা মানুষের চরিত্র হনন করেন এবং মিথ্যা বলে মানুষকে বোকা বানান। লেখাপড়া তাদের বেশি নেই। কিন্তু কথা বানাতে তারা ওস্তাদ! আমি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে পরে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা নিয়েছিলাম। তার কথাগুলো আমার গায়ে কাঁটার মত বিঁধেছিল। তাকে আমার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলাম। কিছু সাংবাদিকের মিথ্যা ও ভিত্তিহীন এবং চরিত্র হননমূলক রিপোর্ট ও লেখালেখি তাদের এই ধারণা পোষণ করতে বাধ্য করেছিল বলে তিনি জানিয়েছিলেন। গত প্রায় অর্ধশতাব্দি ধরে জনাব হাবিবুর রহমানের উল্লেখিত ধারণার সত্যতা ও যৌক্তিকতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি এবং এও দেখেছি যে, এই পেশায় এমন লোকও আছেন যারা ব্যক্তিগত মতাদর্শ যাই থাকুক না কেন প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ নিবন্ধে তারা বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয় দেন, কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চরিত্র হনন করেন না। সত্যের অবমাননা করেন না।

কথাগুলো আমার মনে পড়লো এই কারণে যে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর শনিবার ‘দৈনিক কালের কণ্ঠ’ নামক একটি পত্রিকায় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু শিবিরে জামায়াত শিবিরের তৎপরতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ‘নাফতীরে জামায়াতের রোহিঙ্গা ক্যাম্প!’ শিরোনামে প্রকাশিত এই রিপোর্টটিতে প্রতিবেদক জামায়াত-শিবির বিদ্বেষের একটা নিটোল চিত্র আঁকার চেষ্টা করেছেন। জামায়াত শিবির দুর্দশাগ্রস্ত-অত্যাচারিত হয়ে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা মুসলিম উদ্বাস্তুদের সাহায্যার্থে তিনটি শিবির স্থাপন করে ১৫ হাজার উদ্বাস্তুর দেখা শোনা করছে এটাই রিপোর্টের প্রতিপাদ্য। কিন্তু রিপোর্টের ভাষাটা এমন যেন তারা এদের সাহায্য করে অপরাধ করেছেন বা করছেন। রিপোর্টে প্রতিফলিত এই বিদ্বেষ সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের ও পত্রিকাটির হীনম্মন্যতারই পরিচয় বহন করে বলে আমি মনে করি।

এখানে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কিছু কথা বলা দরকার, ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বৃটিশদের হাত থেকে স্বাধীন হবার এক বছর পর ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হয়। বর্তমানে যে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকার অত্যাচার নিপীড়নের স্টীমরোলার চালাচ্ছে এই রাখাইন রাজ্যটি মিয়ানমারের অপরাপর অঞ্চল থেকে অনুর্বর পাহাড় পর্বত দ্বারা বিচ্ছিন্ন একটি অঞ্চল। রাখাইন রাজ্য ঐতিহ্যবাহী একটি এলাকা। ১৪৩০ সালে মরাউক উ নামক শহরে রাজধানী স্থাপন করে এই রাজ্যটি বৌদ্ধ ও মুসলিম এশিয়ার সংযোগস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সুলতানী আমলের বাংলার শাসকদের সাথে এই রাজ্যের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ৩৫০ বছর অতিবাহিত করার পর ১৭৪৮ সালে বর্মীরা রাখাইন রাজ্যটি দখল করে নেয়। তাদের এই জবরদখল বেশি দিন স্থায়িত্ব পায়নি; ১৮২৪ সালে বৃটিশরা এই অঞ্চলটি দখল করে বৃটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ১৯৪৮ সালে বার্মার স্বাধীনতা অর্জনে রাখাইনের মুসলমানদের বিরাট ভূমিকা ছিল। দুর্ভাগ্যবশত: এবং তাদের নেতৃবৃন্দের কিছু ভুলে বৃটিশদের কাছ থেকে তারা স্বতন্ত্র অঞ্চল হিসেবে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়নি। বার্মা এই সুযোগটি গ্রহণ করেছে এবং তাদের বাস্তুচ্যুত করছে। এই অন্যায়ের প্রতিকার হওয়া দরকার।
রোহিঙ্গা উদ্বাস্তরা বাংলাদেশে বাধ্য হয়ে এসেছে। এখানে আসার আগে এমনকি এক বছর আগেও তারা কল্পনা করেনি যে তাদের এই দুরাবস্তা হবে। তাদের অবস্থা দেখতে গিয়েছিলাম।

পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াতের বাস্তব রূপ দেখে এলাম কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন লোকালয়ে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তিনি আমীরকে ফকির করেন, ফকিরকে আমীর বানান। যাকে ইচ্ছা ইজ্জত দান করেন, যাকে ইচ্ছা বেইজ্জত করেন। তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারেন, জীবিতকে মৃত করতে পারেন, তার হাতেই মঙ্গল। কক্সবাজার জেলার এই অঞ্চলগুলো মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মুসলমান মুহাজিরদের পদভারে একদিকে ন্যুজ্ব, অন্যদিকে এই রোহিঙ্গা মুহাজিরদের কান্নায় সেখানকার আকাশ-বাতাস স্তব্ধ। মিয়ানমারের সামরিক-বেসামরিক সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে জর্জরিত লাখ লাখ এসব মুহাজির তাদের শত শত বছরের স্মৃতি, ঐতিহ্য, বাস্তুভিটা, বাড়ি গাড়ি, জায়গা জমি, দোকানপাট, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি বাকরি ছেড়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে কেউ নৌকায়, কেউ সাঁতরিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে। রাস্তায় সন্ত্রাসীদের হামলায় অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। কেউ স্বামীহারা হয়ে, কেউ স্ত্রী-সন্তানহারা হয়ে, ভাই-বোনের মর্মান্তিক মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে নিজের জীবন নিয়ে কোন রকমে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে এসে ঢুকেছে।

তাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখা এবং তাদের মাঝে কিছু ত্রাণ বিতরণের জন্য গত ১০ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা শিবিরগুলো পরিদর্শনে কক্সবাজারের সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে গিয়েছিলাম। সেখানকার ভয়াবহ অবস্থা দেখে অশ্রু সংবরণ করা খুবই কঠিন ব্যাপার। শিবির তো নয় তারা আছে পাহাড়ের ঢালে, লোকালয়ের জনবসতির পাশে, গাছের নিচে এবং কোথাও কোথাও রাস্তার ধারে খোলা আকাশের নিচে। তাদের কোন আশ্রয় নেই, খাবারের কোন ব্যবস্থা নেই, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন নেই, রোগের চিকিৎসা সুযোগ নেই, বস্ত্রের ব্যবস্থা নেই, শিক্ষার ব্যবস্থার তো প্রশ্নই উঠে না। অর্থাৎ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে একজন মানুষের যে মৌলিক অধিকারগুলো আছে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা এর কোন সুযোগ-সুবিধাই তাদের নেই। এই অবস্থায় আমরা যারা অন্তত খেয়েপরে ভাল অবস্থায় আছি তাদের উচিত দুর্গত এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো। সবাই দাঁড়াচ্ছেনও। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, বিভিন্ন দেশের সরকার এবং শত শত বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের ত্রাণ নিয়ে সেখানে হাজির হয়েছেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ডের সদস্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি ও আধাসরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ ও তাদের পুনর্বাসনে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছেন। তাদের সাথে জামায়াত-শিবির যদি রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র ও খাবারের ব্যবস্থা করে আপত্তি কেন? এ কাজ তো আমার আপনার সবার। আমি নিজে করছি না বলে যে করছে তাকে বাধা দেব কেন। বিদ্বেষ সমস্যার সমাধান করে না, সমস্যার জন্ম দেয়। আবার কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য বিবেক বিক্রি করে দেয়াও কারুর কাম্য হতে পারে না।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার পর তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব আমাদের উপর এসে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের সাহায্যও দিচ্ছে। তাদের পুনর্বাসন শুধু আশ্রয় নয়। এর সাথে ভরন-পোষণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান প্রভৃতিও আসে। বসিয়ে বসিয়ে রিলিফ খাওয়ালে তাদের চরিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের পুঁজি ও উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে সহযোগিতা করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এটি আদায় করা কঠিন নয়।

রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে গিয়ে গণতন্ত্রের এক নতুন মুখ দেখেছি। গত ১২ সেপ্টেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার ও উখিয়ার রোহিঙ্গা মুহাজির অধ্যুষিত এলাকা সফর করেছেন। তার সফর উপলক্ষে স্থানীয় প্রশাসন এক অভূতপূর্ব ঘটনার অবতারণা করেছেন যাতে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। সব যানবাহন বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি রাস্তার ফুটপাত দিয়েও সাধারণ মানুষকে হাঁটতে দেয়া হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী উখিয়ার কর্মসূচি সম্পন্ন করে কক্সবাজার সার্কিট হাউজে দলীয় নেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠক শেষ করে তিনি বিমানে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেছেন। সোয়া পাঁচটার দিকে তিনি কক্সবাজার ত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারে থাকার পুরো সময়টিই কক্সবাজারের রাস্তাগুলো স্তব্ধ ছিল। রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলেনি, দূরদূরান্ত থেকে বাসযোগে কক্সবাজারে আসা বৃদ্ধ, শিশু ও মহিলারা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন। এই সময় বিমানবন্দরে কোন বিমান উড়েনি। দুপুর থেকে বিকাল সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত কোন বিমান যাত্রীকে এয়ারপোর্টে আসতে দেয়া হয়নি। এতে মানুষের যে ভোগান্তি হয়েছে তা বর্ণনার অতীত। স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক সৃষ্ট মানুষের এই ভোগান্তির বিষয়টি কেউ লিখলেন না কেন? এটা কি Prestitation নয়?

http://www.dailysangram.com/post/301957