১ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১২:৩৮

মজুদ আলু নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক

৫ হাজার কোটি টাকা লোকসানের শঙ্কা

নতুন আলু বাজারে আসবে দু'মাস পরই। অথচ গত মৌসুমের ৩০ লাখ টন আলু অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে হিমাগারে। এই আলু নিয়ে কী করবেন, তা বুঝে উঠতে পারছেন না কৃষক। যার বর্তমান বাজার দর প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। বাজারে দাম কম থাকায় লোকসানের আশঙ্কায় হিমাগার থেকে আলু বের করছেন না তারা। আলু ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগামী দুই মাসে পাঁচ লাখ টন বিক্রি হতে পারে। বাকি ২৫ লাখ টন অবিক্রীত থাকবে। ফলে পাঁচ হাজার কোটি টাকা লোকসান হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হিমাগার থেকে এখন প্রতি বস্তা আলু ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা বা ৮ থেকে ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে বস্তাপ্রতি প্রায় ৬০০ টাকা লোকসান হচ্ছে কৃষকের। এর পরও ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছেন না কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় খুচরা বাজারেও দাম কমে ১৮ থেকে ২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে আলু। হিমাগারে সংরক্ষিত এ আলু বিক্রির বিষয়ে এখনই সরকারি পর্যায়ে কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া না হলে বছর শেষে ২০ থেকে ২৫ লাখ টন ফেলে দেওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষক ও হিমাগার মালিকরা।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এবার আলুর দাম কমে হিমাগার থেকে ৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর ১৫ টাকা ছিল। দাম কমে যাওয়ায় মজুদ আলু নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন কৃষক। বর্তমানে বাজারে বিক্রির জন্য ৩১ লাখ টন আলু হিমাগারে মজুদ রয়েছে। আগামী দু'মাসে অর্থাৎ নতুন আলু ওঠার আগে আরও পাঁচ লাখ টন বিক্রি হতে পারে। ফলে হিমাগারেই থেকে যাবে প্রায় ২৬ লাখ টন। যার বর্তমান বাজারমূল্য পাঁচ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এই আলু বিক্রি না হলে নতুন আলু ওঠার পর ফেলে দিতে হবে।

জানতে চাইলে ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকরা জানান, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আলু রফতানিতে অগ্রগতি না হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গত বছর দাম ভালো থাকায় বেশি পরিমাণে চাষ হয়েছে। চাহিদার তুলনায় বাড়তি আলুর চাপে বাজারে দাম নিল্ফম্নমুখী রয়েছে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, ডিসেম্বরে আগাম আলু বাজারে উঠলেও জানুয়ারির শেষ থেকে নতুন মৌসুমের আলু মিলবে পুরোদমে। এ সময়ের মধ্যে আলু বিক্রি না হলে ফেলে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। এ পরিস্থিতিতে সরকারিভাবে আলু কিনে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি এবং বন্যাদুর্গত ও রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় ত্রাণ হিসেবে বিতরণের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। এদিকে সংগঠনের উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের জন্য ১০০ টন আলু ত্রাণ হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। ৩০ টনের মতো বিতরণও করা হয়েছে।

কৃষক, ব্যবসায়ী ও অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, দেশে চলতি বছর এক কোটি টন আলু উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সারাদেশে ৩৯০টি হিমাগারে ৫৩ লাখ টন সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেখান থেকে সর্বশেষ পাঁচ মাসে মাত্র ১৩ লাখ টন বিক্রি হয়েছে। ৮ থেকে ১০ লাখ টন বীজ আলু হিসেবে ব্যবহার হবে। সংরক্ষিত বাকি আলুর প্রায় ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ৩১ লাখ টন নতুন মৌসুমের আগেই বিক্রি করতে হবে।

চলতি বছর উৎপাদন, পরিবহন ও বাজারজাতকরণের খরচসহ প্রতি বস্তা আলুর দাম পড়েছে এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকা। এর সঙ্গে হিমাগারের ভাড়া হিসেবে যোগ হবে ৩০০ টাকা। ফলে এলাকাভেদে এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা দাম পড়ে প্রতি বস্তার। অথচ এখন তা প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মোশাররফ হোসেন হিমাগারে আলুর দুরবস্থা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর, অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি, খাদ্য, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে আলু সরকারকে কিনে নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সরকার এই আলু কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি ও ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করতে পারে। ওএমএস, ভিজিডি, ভিজিএফ, কাবিখাসহ বিভিম্ন কর্মসূচি ও ত্রাণে আলু বিতরণ করা হলে হিমাগারে সংরক্ষিত আলু সময়মতো বিক্রি করা সম্ভব হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আলু রফতানি বাড়াতে নতুন বাজার সৃষ্টি ও প্রণোদনা বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে। এতে কৃষক লোকসানের মুখে পড়বেন না এবং হিমাগার মালিকরাও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন। এরই মধ্যে অনেকে পুঁজি হারিয়েছেন উল্লেখ করে চিঠিতে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, এ সুবিধা না পেলে নিরুৎসাহিত হবেন কৃষক। যার প্রভাব আগামী বছর আলুর উৎপাদনে পড়তে পারে।

কারওয়ান বাজারের আলু ব্যবসায়ী মো. সবুজ মিয়া সমকালকে বলেন, পাইকারি ও খুচরা উভয় বাজারেই দাম দিন দিন কমছে। এভাবে দাম কমলে কৃষক আলু তোলা বন্ধ করে দেবে। বর্তমানে হিমাগার থেকে কেজি প্রতি সাত টাকাতেও আলু মিলছে। ভালো আলুর দাম যদিও দুই টাকা বেশি। তিনি বলেন, খুচরায় সবজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ টাকায়। অথচ আলুর কেজি ১৫ টাকা।

কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রতি একরে আলু উৎপাদন হয় ২৫০ থেকে ৩০০ মণ। বেশি উৎপাদন হওয়ায় কৃষক আরও বেশি করে উৎপাদনে ঝুঁকছেন। আবহাওয়া ভালো থাকায় উৎপাদনও ভালো হচ্ছে। বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ ছাড়াও রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহসহ দেশের প্রায় প্রতিটি এলাকায় আলুর উৎপাদন বেড়েছে। বিশ্বেও আলু উৎপাদনে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান অবস্থান বিশ্বে সপ্তম ও এশিয়ায় তৃতীয়। তবে রফতানির দিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। রফতানিকারকদের কাছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় আলু রফতানিতে সুফল আসছে না।

http://www.samakal.com/economics/article/17104