১ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১২:২২

ব্যয়বহুল বিদ্যুৎই একমাত্র ভরসা খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণকে

মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা কাগজে কলমে

ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎই এখন একমাত্র ভরসা। সরকারের মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা কাগজে কলমেই রয়েছে। বাস্তবায়নের ধারের কাছেও যেতে পারছে না। ফলে গ্রাহকদের বাড়তি মূল্যেই বিদ্যুৎ সেবা নিতে হচ্ছে। এরও পর আবার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যয়ের বোঝা চাপানো হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের ওপর। ফলে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানোর জন্য সিরিজ গণশুনানির আয়োজন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পাইকারি ও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য বিইআরসির গণশুনানিতে তাদের প্রস্তাব দিয়েছে। আরো দু’টি বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও ডিপিডিসি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। তাদের প্রস্তাব আমলে নিয়ে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুপারিশও করেছে। এতে অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গেছে, গ্রাহকপর্যায়ে আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ছে।

২০০৯ সালে সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ নিয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে ছিল কুইক রেন্টাল। বিনা টেন্ডারে সরকার সমর্থিত ব্যবসায়ীদের কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছিল। তেলভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। এর দায় চাপানো হয় জনগণের ঘাড়ে। এসব কুইক রেন্টাল তিন বছরের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। তবে পরে বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় কুইক রেন্টালগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়। একই সাথে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও ফলপ্রসূ না হওয়ায় বিদ্যুতের একমাত্র ভরসা এখন ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। ফলে গ্রাহকেরা কুইক রেন্টাল চক্র থেকে বেরোতে পারছেন না।

এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বি ডি রহমত উল্লাহ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সরকারের মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা মূলত লোকদেখানো। যেটা বর্তমানে করা হচ্ছে সেটাই বাস্তবতা।
তিনি বলেন, বিনা টেন্ডারে দলীয় সমর্থকদের কুইক রেন্টালের যখন অনুমোদন দেয়া হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল এটা স্বল্প সময়ের জন্য করা হচ্ছে। মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলেই এসব ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে। তখন মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রায় আট বছর অতিক্রান্ত হলেও মধ্যমেয়াদি কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ এ সময়ে কুইক রেন্টালের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা সাধারণের পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ২০০৯ এর চেয়ে বর্তমানে তেলের দাম কমেছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৮০ শতাংশই পুরনো যন্ত্রপাতি। ফলে উৎপাদন ব্যয় কোনো ক্রমেই ৪-৫ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সেই প্রায় আগের দামেই এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। তিনি বলেন, এর ফলে ভর্তুকি আরো বাড়ছে। এ ভর্তুকির দায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জনগণের ওপরই বর্তাচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানান, বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হয়নি। এটি অনেক রদবদল করা হয়েছে। ফলে ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপরই নির্ভরশীলতা বাড়ছে। ইতোমধ্যে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে মোট বিদ্যুতের ৩২ শতাংশ। আর দুই হাজার ৮০০ মেগাওয়াট থেকে তিন হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নতুন করে যোগ হচ্ছে। এর বাইরে এলএনজি আসছে। গ্যাসের পরিবর্তে এলএনজি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরো ৬০ শতাংশ বেড়ে যাবে। সব মিলিয়ে পুঞ্জীভূত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ফলে বিদ্যুতের দাম আরো বাড়বে। জনগণকে এর খেসারত দিতেই হবে। এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় ছিল কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাড়ানো। সেটি সরকারের মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনায়ও ছিল। কিন্তু তা ঝিমিয়ে পড়ায় এ দুর্গতি হচ্ছে।
বিদ্যুৎ নিয়ে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় কুইক রেন্টালের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে এ কথা সরকারের পক্ষ থেকেও এখন স্বীকার করা হচ্ছে। ২৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানিকালে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ বলেছেন, আমরা বিদ্যুতের মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এর ফলে আমরা কুইক রেন্টালগুলোর নবায়ন করেছি। তিনি দাবি করেন, এ ক্ষেত্রে তাদের লাভ হয়েছে। ৫০ ভাগ কম দামে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নবায়ন করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে সিরিজ গণশুনানি শুরু করেছে বিইআরসি। ২৫ সেপ্টেম্বর পিডিবি পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিটে ৭২ পয়সা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। তবে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি তা ৫৭ পয়সা করা প্রয়োজন বলে মত দিয়েছে অর্থাৎ এ মতামত গৃহীত হলে বিদ্যুতের গড় পাইকারি মূল্যহার ৪ টাকা ৮৭ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৫ টাকা ৪৪ পয়সা। ২৬ সেপ্টেম্বর ব্যবসায়ী ও সব ধরনের গ্রাহকের বিরোধিতার মুখে পিডিবি খুচরা পর্যায়ে সাড়ে ১৪ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে অর্থাৎ পিডিবি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায় ৯৮ পয়সা। একই সাথে ডিমান্ড ও সার্ভিস চার্জও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে ৭২ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। এটি বিবেচনায় নিলে পিডিবির গড় খুচরা মূল্য ৬ টাকা ৭৬ পয়সা থেকে বেড়ে হবে ৭ টাকা ৪৮ পয়সা।

গ্রামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারলেও ২৭ সেপ্টেম্বর আরইবি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পৌনে ১১ শতাংশ। এর সাথে ডিমান্ড ও সার্ভিস চার্জ বাড়ানোরও প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটারি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি বিদ্যুতের ৭ দশমিক ১৯ শতাংশ বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে ৪৪ পয়সা দাম বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৪৩ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। প্রস্তাব বিবেচনা করে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি প্রতি ইউনিটে ১৫ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/256321